বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ‘আপোষহীন’ নেতৃত্বের নাম।রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই এখন পর্যন্ত তিনি কোন আপোষ করেননি।তিনি ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আটক হন। আপোষ না করে আইনি লড়াই চালিয়ে ২০০৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তিনি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের নির্দেশে মুক্তিলাভ করেন।বেগম খালেদা জিয়ার কারামুক্তির এই বিশেষ দিনে ‘খালেদা জিয়ার কাছে রাজনীতিতে বার বার হেরেছেন শেখ হাসিনা’ শিরোনামে ধারাবাহিক কলাম লিখেছেন দৈনিক ‘আমার সংবাদ’ পত্রিকার বিএনপি বিটের সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জালাল আহমদ।
খালেদা জিয়ার কাছে রাজনীতিতে বার বার হেরেছেন শেখ হাসিনা!
– জালাল আহমদ
১) সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ :
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগের সীমাহীন দুর্নীতি ও ব্যর্থতার কারণে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু হয়। পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এর পরিবর্তে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ধারণ করে ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্ম হয় বিএনপির। বিএনপি’র পুরো নাম হচ্ছে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (ইধহমষধফবংয ঘধঃরড়হধষরংঃ ঢ়ধৎঃু )।যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’।বিএনপির রাজনৈতিক আদর্শ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ আদালত কর্তৃক স্বীকৃতি পায়।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসে।বিরোধীদলের আসনে বসে আওয়ামী লীগ।
২) রাজনীতিতে আবির্ভাব প্রক্রিয়া :
আওয়ামী লীগে নানা কোন কোন্দল,বিভাজন সৃষ্টি হলে
১৯৮১ সালে ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা কে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষ করে তিনি ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসেন।
দলের প্রাথমিক সদস্য ফরম পূরণ না করে সরাসরি রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটে শেখ হাসিনার।
অপরদিকে ১৯৮১ সালের ৩০ মে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান শহীদ হলে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মীদের আহ্বানে বেগম খালেদা জিয়া ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপিতে যোগ দেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হন।১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল দলের বর্ধিত সভায় তিনি প্রথম বক্তৃতা করেন। বিচারপতি সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে দলের চেয়ারপার্সন নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বেই মূলত বিএনপি পূর্ণ বিকশিত হয়।রাজনীতির ধারাবাহিক পর্যায় অতিক্রম করেই বেগম খালেদা জিয়া দলের শীর্ষস্থানে আসীন হন।
৩) আন্দোলনে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে যেভাবে হেরে যান শেখ হাসিনা :
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ১৯৮৩ সালের বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সাত দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়।বেগম জিয়া প্রথমে বিএনপিকে নিয়ে ১৯৮৩ এর সেপ্টেম্বর থেকে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন। একই সময় বেগম খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন পনেরো দলের সাথে যৌথভাবে আন্দোলনের কর্মসূচির সূত্রপাত করেন। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ দফা আন্দোলন চলতে থাকে।
সামরিক শাসক হুসেন মুহাম্মদ এরশাদ কে তাঁর ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য ১৯৮৬ সালের মার্চ মাসে হঠাৎ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তাই ১৯৮৬ সালের ১৯ মার্চ বুধবার বিএনপি, আওয়ামী লীগ সহ সকল দল ঘোষণা দেন যে,তারা এরশাদের অধীনে কোন নির্বাচনে যাবে না। সেদিন শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে ঘোষণা দেন যে, এরশাদের অধীনে যারা নির্বাচনে যাবে, তারা হবে জাতীয় বেইমান।”
এরশাদের ফাঁদে পা দিয়ে শেখ হাসিনা পরদিন ঢাকায় এসে চট্টগ্রামে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে সরে আসেন। ২১ মার্চ শুক্রবার হঠাৎ তিনি ঘোষণা দিলেন যে, আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যাবে।
আওয়ামী লীগ মনে করেছিল বিএনপি কে বেকায়দায় ফেলে নির্বাচনের বাইরে রাখতে পারলে বিএনপি একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ জোট গঠন করে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করলে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে।বিজয়ী হতে না পারলে এরশাদের সাথে সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করবে। তাও না পারলে বিরোধীদলের ‘নেত্রী’ হিসেবে জাতীয় সংসদে ভূমিকা পালন করবে।( বিস্তারিত বিবিসির সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের লেখা বই : ‘এক জীবন, এক ইতিহাস’ পৃষ্ঠা ২৩২)।
পরদিন ২২ মার্চ শনিবার বিএনপি,বিএনপি’র অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলো এরশাদের অধীনে শেখ হাসিনার নির্বাচনে যাওয়া কে ‘পাতানো খেলা’ অবহিত করে দেশের মানুষের মতামত নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। বিএনপি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি নিয়ে আপোষ করেনি।
নির্বাচনে ফলাফল প্রকাশের পর দেখা যায় যে, আওয়ামী লীগ তাদের প্রত্যাশিত আসন পায়নি।দলের নেতারা এই নির্বাচনকে ‘পুকুর চুরি’, ‘দীঘি চুরি’ বলে সমালোচনা করেন।আওয়ামী লীগ একই সঙ্গে ‘ঐক্যমত‘ ভঙ্গ করে নির্বাচনের অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের কারণে জনগণের কাছে ‘জাতীয় মুনাফেক পার্টি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
নির্বাচনে পরে শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে, তিনি সংসদের বৈঠকে যোগ দেবেন না। কিন্তু পরে আবারো হঠাৎ তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সংসদে যোগদান করেন। এ সময় গুজব রটেছিল যে, শেখ হাসিনাকে এরশাদ ‘লং ড্রাইভ’ এ নিয়ে যান। তারপর সেখানে রাজনৈতিক মতৈক্যে পৌঁছান। (বিস্তারিত সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের লেখা বই : এক জীবন, এক ইতিহাস , পৃষ্ঠা-২৩২)।
নির্বাচনে জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করায় বেগম জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দল, পাঁচ দলীয় ঐক্যজোট নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন চালিয়ে যায়।
১৯৮৭ সাল থেকে খালেদা জিয়া “এরশাদ হটাও” শীর্ষক এক দফার আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। ফলে এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। তারপর পুনরায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উপক্রম হয়।
শেখ হাসিনা তখনও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে মাঠে না এসে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। যেমন-১৯৮৮ সালে ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে শেখ হাসিনার উপর হামলার প্রতিবাদে ৩০ জানুয়ারি ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশের ঘোষণা দেন শেখ হাসিনা।প্রতিবাদ সমাবেশে কথা দিয়েও শেখ হাসিনা যাননি। সমাবেশ শেষে ৪০ হাজার লোকের একটি মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে।(বিস্তারিত সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের লেখা বই : এক জীবন, এক ইতিহাস , পৃষ্ঠা-২৩৮)।
তখন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের কাছে ছাত্রদল জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ছাত্রদল এককভাবে ১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে বিজয়ী হলে ‘ছাত্র আন্দোলন’ ছাত্রদলের হাতে চলে যায়। ছাত্রসমাজের দাবির মুখে বিএনপি,আওয়ামী লীগ সহ ‘রাজনৈতিক ঐক্য’ তৈরি হলে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হয়।
৪) নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার কাছে হেরেছেন শেখ হাসিনা :
অবশেষে দীর্ঘ ৯ বছর অবিরাম, নিরলস ও আপোসহীন সংগ্রামের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনে খালেদা জিয়া মোট পাঁচটি আসনে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জয়লাভ করেন।এরপর ১৯৯৬ সালের ১৫ফেব্রুয়ারী নির্বাচনে সর্বোচ্চ পাঁচটি আসন, ১৯ ৯৬ সালের জুনে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ পাঁচটি আসন, ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে বিজয় লাভ করেন। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংসদ নির্বাচনের নতুন আইন অনুযায়ী একজন ব্যক্তি ৩টির বেশি আসনে নির্বাচন করতে পারে নি। ফলে বেগম খালেদা জিয়া সর্বোচ্চ তিনটি আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। চট্টগ্রাম,ফেনী, লক্ষ্মীপুর, সিরাজগঞ্জ, রাজশাহী, বগুড়া — থেকে শুরু করে তিনি জীবনে যেখানে নির্বাচন করেছেন, সেখানেই মানুষের ভালোবাসায় ব্যালট বিপ্লবে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন।
অপরদিকে শেখ হাসিনা ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ঢাকার ২টি আসনে ও ২০০১ সালের নির্বাচনে রংপুরের শ্বশুরবাড়ীর আসন পীরগঞ্জে পরাজিত হন।
বাকী অংশ আগামীকাল
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।