সোয়েব সাঈদ, রামু:
কক্সবাজারের রামুতে মসজিদের ওয়াকফ সম্পত্তির আয়ের অর্থ মসজিদের উন্নয়নের পরিবর্তে নিজেদের সংসার চালাতে খরচ করছেন মুতওয়াল্লী। সম্পত্তির আয়ে মসজিদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের কথা থাকলেও এখানে তা বিন্দুমাত্র মানা হচ্ছে না। মসজিদ পরিচালনা কমিটির কাছে দেয়া হয়নি কোন হিসাব। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের পৃথক তদন্তে উঠে এসেছে অনিয়মের এ ভয়াল চিত্র।
অনিয়মের সত্যতা পেয়ে রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা মুস্তফা বিতর্কিত মুতওয়াল্লী প্রতিনিধিকে পরিবর্তন, ইমামের বকেয়া বেতন আদায়সহ অন্যান্য সমস্যা নিরসনে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ওয়াকফ প্রশাসক (অতিরিক্ত সচিব) এর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন সহ লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।
রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের জাউচপাড়া পুরাতন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুতওয়াল্লীর প্রতিনিধি জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে এসব অনিয়মের অভিযোগ করেছেন মসজিদ পরিচালনা কমিটি ও এলাকাবাসী। এ ঘটনায় কক্সবাজার জেলা ওয়াকফ অফিসের বিতর্কিত ভ‚মিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মসজিদ পরিচালনা কমিটি ও মুসল্লীরা।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোবারক আহমদ অনিয়মের সকল বিষয় স্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন- মসজিদের ওয়াকফকৃত বিপুল সম্পত্তি দীর্ঘদিন ভোগদখল করে আসছেন মুতওয়াল্লী কবির আহমদ ও তার প্রতিনিধি জিয়াউল হক। মসজিদের নামে রেজিস্ট্রি দলিলে উল্লেখ রয়েছে মুতওয়াল্লী কর্তৃক মসজিদের ঘেরা-বেড়া, অজুর পানি ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বিল ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন পরিশোধ করবেন। দীর্ঘদিন মুতওয়াল্লী ও তার পরিবারের সদস্যরা মসজিদের সম্পত্তি ভোগ-দখল করে আসলেও মসজিদের উন্নয়নে কোন ভ‚মিকা রাখেনি। নিরুপায় হয়ে মুসল্লীরা পরিচালনা কমিটির নেতৃত্বে ও স্থানীয় জনসাধারণের অর্থ সহায়তায় এ মসজিদ পরিচালনা করে আসছেন। ২ বছর পূর্বে এনিয়ে মসজিদ পরিচালনা কমিটি গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদেও তৎকালীন চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এরই প্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান
গ্রাম আদালতের মাধ্যমে মসজিদের ঘেরা-বেড়া, অজুর পানি ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ বিল এবং ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতনের বকেয়া টাকা পরিশোধ করার জন্য মুতওয়াল্লীর প্রতিনিধি জিয়াউল হককে নির্দেশ দিয়ে লিখিত রায় প্রদান করেন। পরে মুতওয়াল্লীর প্রতিনিধি এ রায়ের আংশিক অর্থ পরিশোধ করলেও এখনো অবশিষ্ট ৬৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেননি। এমনকি মুতওয়াল্লীর পরিবারের সাথে মসজিদ পরিচালনা কমিটিরও কোন সম্পর্ক বা সমন্বয় নেই। তাই নিরুপায় হয়ে তিনি গত ৩১ জানুয়ারি রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা মুস্তফার কাছে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি তদন্তের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সুপারভাইজার মো. সাইফুদ্দিন খালেদকে দায়িত্ব দেন।
তদন্তকারি কর্মকর্তা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সুপারভাইজার মো. সাইফুদ্দিন খালেদ জানিয়েছেন- তিনি বিষয়টি তদন্তের জন্য মুতওয়াল্লী কবির আহমদের বাড়িতে বৈঠক করেন। এতে এলাকার ইউপি সদস্য, মহিলা ইউপি সদস্য, স্থানীয় সাংবাদিক, গন্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। মুতওয়াল্লী কবির আহমদ অসুস্থ। তিনি কথাও বলতে পারেননা। মুতওয়াল্লী কবির আহমদের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন মুতওয়াল্লী প্রতিনিধি (মুতওয়াল্লী কবির আহমদের জামাতা) জিয়াউল হক। বৈঠকে মসজিদ কমিটির সভাপতি ইউএনও’র কাছে দেয়া লিখিত অভিযোগ পড়ে শোনান। এসময় মুতওয়াল্লীর প্রতিনিধি জিয়াউল হক প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে মসজিদ কমিটির সভাপতি মোবারক আহমদকে মারতে উদ্যত হন। এসময় বাড়ির কয়েকজন মহিলা সদস্য তাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে জিয়াউল হক সবার সামনে পরিবারের এসব মহিলাদের কিল-ঘুষি দেয় এবং আবারও সভাপতিকে মারতে তেড়ে আসেন। এসময় তিনি (তদন্তকারি কর্মকর্তা) পুলিশ ডাকার চেষ্টা করলে জিয়াউল হক শান্ত হন। পরে সকলের উপস্থিতিতে তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, জাউচপাড়া পুরাতন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ মুসল্লীদের গড়া। মসজিদ পরিচালনা কমিটিই সর্বসাধারনের চাঁদা নিয়ে মসজিদ পরিচালনা করে আসছেন। সম্প্রতি ১ তলা বিশিষ্ট মসজিদ পূননির্মিত হয়েছে। এতেও মুতওয়াল্লীর কোন অবদান নেই।
তিনি আরও জানান- ১৯৪৩ সালে বিপুল জমি মসজিদে ওয়াকফ করা হলেও সন ভিত্তিক আয়-ব্যয়ের হিসাব মুতওয়াল্লী পক্ষ দেখাতে পারেননি। মসজিদের জন্য এ পর্যন্ত তারা (মুতওয়াল্লী) কত টাকা ব্যয় করেছেন তাও জানাতে পারেনি। তদন্তে আরও প্রমানিত হয়েছে- মসজিদের ওয়াকফকৃত সম্পত্তির লাগিয়ত বা আয়ের অর্থ মসজিদে না দিয়ে মুতওয়াল্লী ও তার পরিবারের সদস্যরা আত্মসাৎ করেছেন। অর্থাৎ মসজিদের সম্পত্তির আয়ের অর্থ দিয়ে মুতওয়াল্লী ও তার স্বজনরা নিজেদের সংসার চালিয়েছেন। এজন্য তদন্তকারি কর্মকর্তা বৈঠকে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানালে, মুতওয়াল্লীর প্রতিনিধি জিয়াউল হক ও মুতওয়াল্লীর দুই মেয়ে বকেয়া টাকা পরিশোধের জন্য সময় চান। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় শেষ হলেও জিয়াউল হক ও তার পরিবারের কেউ বকেয়া টাকা পরিশোধ ও মসজিদের সম্পত্তি ও আয়ের বিবরণ হস্তান্তর করেনি। উল্টো জিয়াউল হক এলাকার জনপ্রতিনিধি ও জনসাধারণকে বলে বেড়াচ্ছেন- তিনি মসজিদ কমিটিকে কোন টাকা দেবেন না। কক্সবাজার ওয়াকফ অফিস তার পক্ষে আছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সুপারভাইজার মো. সাইফুদ্দিন খালেদ আরও জানান- উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে মসজিদের বিষয়টি তদন্তকালে কক্সবাজার ওয়াকফ অফিসের ভ‚মিকা ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। তদন্ত চলাকালেই ওয়াকফ অফিসের অফিস সহায়ক শরিফুল ইসলাম মুতওয়াল্লী প্রতিনিধি জিয়াউল হককে নিয়ে তাঁর অফিসে যান। এসময় তদন্ত প্রতিবেদন মুতওয়াল্লীর পক্ষে দেয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা চালান শরিফুল হক। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়েছে, কক্সবাজার ওয়াকফ অফিস মসজিদ ও মুসল্লীদের স্বার্থের চেয়ে মুতওয়াল্লীর ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষায় বেশী তৎপর।
গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. শাকের আহমদ জানান- তিনি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন, মুসল্লীদের মনোনীত ব্যক্তিরা অনুদানের অর্থে মসজিদটি পরিচালনা করে আসছেন। মুতওয়াল্লী কবির আহমদ ও তার প্রতিনিধি জিয়াউল হক বা তাদের পরিবারের কোন সদস্য মসজিদ পরিচালনায় কোনভাবেই সম্পৃক্ত নেই। মসজিদের উন্নয়নে তারা কোন সহযোগিতা করেনা।
গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৪,৫,৬ নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য কামরুন্নাহার জানান- ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সুপারভাইজার কর্তৃক তদন্তকালে ইমামের বেতন সহ মসজিদ পরিচালনার খরচ বহন করার অঙ্গীকার করেন মুতওয়াল্লী কবির আহমদের জামাতা মুতওয়াল্লী প্রতিনিধি জিয়াউল হক ও তার দুই মেয়ে জাহান আরা ও তফুরা বেগম। এজন্য তারা ১ সপ্তাহ সময়ও নেন। কিন্তু সময় পার হলেও তারা ইমামের বকেয়া বা মসজিদের উন্নয়নের জন্য কোন অর্থ পরিশোধ করেনি। উল্টো এলাকায় প্রকাশ্যে প্রচার করেছে- তারা মসজিদে কোন টাকা দেবেনা। কক্সবাজার ওয়াকফ অফিস তাদের পক্ষে রয়েছে। অর্থাৎ তারা মসজিদের বকেয়া টাকা পরিশোধে সম্মত নয়। তাই এলাকার মুসল্লীদের স্বার্থে মসজিদের ওয়াকফ সম্পত্তি আত্মসাৎকারি মুতওয়াল্লীর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে।
গর্জনিয়া পোয়াংগেরখিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি সাংবাদিক হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী জানান- মুতওয়াল্লীর প্রতিনিধি জিয়াউল হক খুবই উশৃঙ্খল ব্যক্তি। তার সাথে মসিজদ কমিটির কোন সমন্বয় নেই। তদন্তকালে জিয়াউল হক মসজিদ কমিটির সভাপতিকে মারধরের চেষ্টা ও হুমকী দিয়েছেন।
অনিয়মের এ ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত রামুর গর্জনিয়া জাউচপাড়া পুরাতন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুতওয়াল্লী প্রতিনিধি জিয়াউল হক জানান- ৮০ বছর আগে সাড়ে ৪ কানি জমির ওয়াকফ দলিলে মুতওয়াল্লী কর্তৃক মসজিদের দুটি সভা, ইমামের বেতন ও অন্যান্য খরচ বাবদ ধান দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ ছিলো। কিন্তু অনেকদিন তিনি সেটা করেননি। তবে এখন থেকে তিনি মসজিদের এসব পাওনা নিয়মিত পরিশোধের চেষ্টা করবেন। তদন্তকালে উত্তেজিত হওয়াটা তার ভুল হয়েছে। এছাড়াও তিনি মসজিদ কমিটি বা কোন অনুষ্ঠানাদিতে তার শাশুড় মসজিদের মুতওয়াল্লী কবির আহমদকে বিন্দুমাত্রও মুল্যায়ন করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন।
রামু উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফাহমিদা মুস্তফা জানিয়েছেন- রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের জাউচপাড়া পুরাতন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুতওয়াল্লী ইমামের বেতন, বিদ্যুৎ বিল সহ মসজিদ পরিচালনায় কোন ব্যয় করছেন না মর্মে মসজিদ কমিটির সভাপতি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। বিষয়টি তদন্তের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সুপারভাইজার মো. সাইফুদ্দিন খালেদকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি সরেজমিন তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন। তদন্ত চলাকালে কক্সবাজার ওয়াকফ অফিসের ভ‚মিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
ইউএনও ফাহমিদা আরও জানান- এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা ও মুসল্লীদের স্বার্থে মুতওয়াল্লী প্রতিনিধি জিয়াউল হককে পরিবর্তন করে ওয়াকফকারির ওয়ারিশদের পক্ষ থেকে অন্য কাউকে প্রতিনিধি নিয়োগ, ইমামে বকেয়া ও বর্তমান বেতন আদায় সহ অন্যান্য সমস্যা নিরসে কক্সবাজার ওয়াকফ কার্যালয়কে নিরপেক্ষ আইন বিধি মোতাবেক কাজ করার জন্য নির্দেশনা প্রদানের অনুরোধ জানিয়ে তিনি ওয়াকফ প্রশাসক (অতিরিক্ত সচিব) এর কাছে তদন্ত প্রতিবেদন সহ লিখিত আবেদন জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার ওয়াকফ পরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেন জানান- তিনি কক্সবাজার ওয়াকফ কার্যালয়ে সদ্য যোগদান করেছেন। তাই এসব নিয়ে তিনি অবগত নন। তবে এ বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নেবেন।
