নিজস্ব প্রতিবেদক:

এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত পার্লামেন্টারিয়ান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি, ভাষাসৈনিক, স্বৈরাচার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শীর্ষ নেতা, পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী ও কক্সবাজারের ভূমিপুত্র মৌলভী ফরিদ আহমেদের ৫৪তম শাহাদাত বার্ষিকী আজ মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর)। ১৯৭১ সালের এই দিনে তিনি অজ্ঞাত আততায়ীদের হাতে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।

পারিবারিক সুত্রমতে, ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর একদল দুষ্কৃতিকারি তাঁকে রাজধানী ঢাকা থেকে গুম করেন। পরে বদরে মুনীর নামক একজন বিদেশী সাংবাদিকের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, ক্ষুধার্থ ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ক্রমান্বয়ে হাত কেটে, পা কেটে, কান কেটে, চোখ উপড়ে ফেলে, ধারালো খঞ্জর দিয়ে তিলে তিলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবং পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে ২৩ ডিসেম্বর এই মহান নেতাকে হত্যা করা হয়।

দিনটি স্মরণে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে দিনব্যাপী কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে খতমে কুরআন ও দোয়া মাহফিল, বিকেল ৩টায় কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার মাছুয়াখালীর রত্নগর্ভা রিজিয়া আহমদ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। ফরিদ এন্ড রিজিয়া আহমদ ফাউন্ডেশন এসব কর্মসূচির আয়োজন করছে।

এছাড়াও দিনটিকে স্মরণ করে জাতীয় দৈনিক আমার দেশসহ স্থানীয় প্রিন্ট ও অনলাইন গণমাধ্যমে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে।

যেমন ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমেদ

মৌলভী ফরিদ আহমদ ১৯২৩ সালে কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলাধীন তৎকালিন বৃহত্তর জোয়ারিয়ানালা তথা, বর্তমান রশিদনগর ইউনিয়নের ধলিরছড়া গ্রামের সিকদার পাড়ার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নাদেরুজ্জামানের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি কক্সবাজার সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সারাবাংলার মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করে আইএসসি পাস করেন। পরে তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও ১৯৪৬ সালে শতকরা ৭৫ নম্বর পেয়ে স্নাতকোত্তর পাস করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে আইন ডিগ্রি বিএল. পাস করেন।

ছাত্র জীবন ও ছাত্র রাজনীতি : ১৯৪৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটার্স কাপে ফরিদ আহমেদ ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড় ও ব্রড জাম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ডধারি। ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৪৫-৪৬ সালেও ভারপ্রাপ্ত ভিপি ছিলেন তিনি।

পেশাগত ও কর্মজীবন : ১৯৪৭-৪৮ সালে ঢাকা কলেজে ইংরেজি বিষয়ে অধ্যাপনার মধ্যদিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে বাংলাকে অন্যতম ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি না দেয়ার প্রতিবাদে তিনি ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্টের প্রথম সারির আইনজীবী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। দীর্ঘকাল তিনি ঢাকা বার কাউন্সিলে নির্বাচিত সহ-সভাপতি ছিলেন।

সমাজসেবা ও সাংগঠনিক তৎপরতা : তিনি শুধু রাজনীতিই করেননি, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম মোটর ওয়ার্কস্ ইউনিয়ন, কক্সবাজার বার কাউন্সিল, কক্সবাজার ইনস্টিটিউট ও পাবলিক লাইব্রেরি, কক্সবাজার ফুড কমিটি ও কক্সবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে কক্সবাজার মিউনিসিপ্যাল কমিটির কমিশনার নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে তিনি কক্সবাজার পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

রাজনীতি : ১৯৫২ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে তৎকালিন অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল নেজামে ইসলাম পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে নিখিল পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল, ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান সম্মিলিত বিরোধীদলের চেয়ারম্যান, ১৯৬৭ সালে ৫টি বৃহৎ রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত পিডিএম এর কার্যনির্বাহী সদস্য, একই বছর সমমনা রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত পিডিপির সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান মনোনীত হন। ১৯৬৭ সালে পাকিস্থান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্টের সদস্য হিসেবে স্বৈরাচার আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে শীর্ষ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ, ন্যাপ, নেজামে ইসলাম, জামায়াত ইসলামী ও মুসলিম লীগ সহ ৮টি দল নিয়ে ডেমোক্রেটিক ন্যাশনাল কমিটি গঠিত হলে মৌলভী ফরিদ আহমদ এর কার্যনির্বাহী সদস্য ও পূর্ব পাকিস্থান শাখা আহবায়ক নির্বাচিত হন। তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্থান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও আইন পরিষদের চিফ হুইপ নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে পাকিস্থান গণ-পরিষদ সদস্য ও চুন্দ্রিগড় মন্ত্রী সভায় কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে ৩য় জাতীয় পরিষদ ও জাতীয় পাবলিক সার্ভিস কমিটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

লেখক ও সাংবাদিক : মোহাম্মদ আলী ক্লে (১৯৬৫), কারাগারে সাতাইশ দিন (১৯৬৬) ও দ্যা সান বাহাইন্ড দ্যা ক্লাউডস তাঁর সাহিত্য কীর্তির স্বাক্ষর বহন করে। এছাড়াও তাঁর লেখা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, নিবন্ধ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

বিদেশ সফর ও দেশের প্রতিনিধিত্ব : পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য হিসাবে মৌলভী ফরিদ আহমদ ১৯৫৬ সালে ইরান সফর করেন। ১৯৫৭ সালে লন্ডনে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন কংগ্রেস, একই বছর নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত আইএলও-র আঞ্চলিক সম্মেলন, ১৯৬০ সালে রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অলিম্পিক, ১৯৬৩ সালে বেলগ্রেডে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন কংগ্রেস এবং ১৯৬৪ সালে আলজিয়ার্সে আফ্রো এশিয়ান সলিডারিটি কংগ্রেসে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। তিনি রাজনৈতিক জীবনে বেশীর ভাগ সময় বিরোধী দলে থেকেও সরকারের নেতৃত্ব দেন।

হাসিক কাজ : তাঁরই প্রচেষ্টায় তৎকালে লবণের কর মওকুফ করা হয়। এর ফলে লবণ উৎপাদনকারি কক্সবাজারবাসীরা বার্ষিক আনুমানিক ৫ কোটি থেকে ৭ কোটি টাকার অধিক উপার্জন করতে সক্ষম হয়। তাঁরই প্রচেষ্টায় পাকিস্থান সরকারের প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগের অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কর্পোরেশ নিজের নির্বাচনী এলাকা বাঁশখালী হতে দক্ষিণে টেকনাফ পর্যন্ত তেল, গ্যাস, কয়লা ও ধাতব পদার্থের অনুসন্ধান কাজ চালানো হয়। জলদিতে ও উখিয়া উপজেলার বাইলাখালীতে তেল প্রাপ্তির সম্ভবনা দেখা দিয়েছিল। তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৫৬-৫৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকার চট্টগ্রাম আরকান রোড ও কক্সবাজার লিংকরোড পাকা করার জন্য প্রায় ৫০-৬০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করেছিল। এরই প্রেক্ষিতে কক্সবাজার চট্টগ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। তাঁরই প্রচেষ্টায় কক্সবাজারের প্রত্যেক দরকারী জায়গায় টেলিগ্রাফ ও পোষ্ট অফিস প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রত্যেক থানায় থানায় টেলিফোন যোগযোগ ব্যবস্থা ও কুতুবদিয়া, মহেশখালী দ্বীপে বেতার টেফিগ্রাফ ব্যবস্থা চালু হয়।

তাঁর উদ্যোগে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম বিমান সার্ভিস প্রবর্তিত হয়।

তাঁরই প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন কক্সবাজার ও উখিয়া পর্যন্ত সম্প্রাসারণে প্রাথমিক কাজে জরিপ পর্ব ১৯৫৭-৫৮ সালে শুরু হয়। পরে সামরিক আমলে রেল বিভাগ প্রাদেশিক সরকারের হাতে হস্তান্তরিত হওয়ার ফলে ওই কাজ ধামাচাপা পড়ে যায়।

মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর একদল দুষ্কৃতিকারী তাঁকে গুম করেন। এরপর বদরে মুনীর নামক একজন বিদেশী সাংবাদিকের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা যায়, ক্ষুধার্থ ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ক্রমান্বয়ে হাত কেটে, পা কেটে, কান কেটে, চোখ উপড়ে ফেলে, ধারালো খঞ্জর দিয়ে তিলে তিলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, পাশবিক নির্যাতন করে ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর তারিখে এই মহান নেতাকে হত্যা করা হয়।