অাতিকুর রহমান মানিক

মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল ফিতর সমাগত। প্রতিবছর ঘুরেফিরে ঈদ আসে, ঈদ যায়। আর এ ঈদের সাথে যেন মার্কেটিং এর ব্যপারটা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। কে কত বেশী মার্কেটিং করতে পারে,ঈদ যেন এর প্রতিযোগিতা। মার্কেটিং নিয়ে প্রতিবছর ঈদের সময়টায় কেমন যেন দোটানায় পড়ে যায় কেরামত আলী। রমজানের শেষ দিকেই মূলতঃ ঈদ উদযাপনের প্রাক-প্রস্তুতি ও কেনাকাটা শুরু হয়। ঈদ উৎসব সার্বজনীন হলেও আমাদের সমাজ ব্যবস্হায় যেন এর বাস্তবতা খুঁজে পায়না কেরামত। বরং বিভিন্ন বৈষম্য প্রকট হয়ে ধরা পড়ে তার চোখে। ঈদ যেন এখানে দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে, ঈদের বেশ আগে থেকেই দেখা যায় শপিং মল গুলো বাহারী আলোকসজ্জায় ঝলমল করে, কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। একদাম, দুইদাম ও বহুদামের আউটলেটে হাবিজাবি যত্তসব পোশাকের গলাকাটা দামে  বিত্তবানদের হৈ-হোল্লোড় চোখে পড়ে। অন্যদিকে বিউটি পার্লারে ধনীর দুলালী-গৃহিনীদের লম্বা লাইন ও শেষে মোটা অংকের “বিউটিফিকেশন বিল”। আর সবশেষে ঈদের দিন বাসায় বাড়ীতে রকমারী সব নাম ও স্বাদের রান্নার আয়োজন। বিরিয়ানী, কোপ্তা, রোষ্ট, পোলাও, দরজা (জরদা) জানালা ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার ঈদের পরে কাছের ও দুরের বিভিন্ন ট্যুরিজম স্পটে এন্টারটেইনমেন্ট ট্যুর। এই হল একশ্রেণীর ঈদ উদযাপন, যারা সমাজে বিত্তবান হিসাবে পরিচিত। কে কত বেশীদামের জামা-জুতা কিনতে পারে, কত বেশী খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করতে পারে ঈদ যেন তারই মহড়া। এদের কাছে ঈদ মানেই আনন্দ।
কিন্তু সমাজের আরেকটা শ্রেনীর কাছে ঈদ মানে আতংক। অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত এদের কাছে ঈদ উৎসব কোন আনন্দের বার্তা বয়ে আনেনা। সীমিত আয়ের এসব লোকজনের আয় ঈদ উপলক্ষে বিন্দুৃমাত্রও বাড়েনা। ফলে জীবনধারনের জন্য নিয়মিত রুটি-রুজির বাইরে কিছু খরচাপাতি করা তাদের জন্য একপ্রকার দুঃস্বপ্ন বললেই চলে। কিন্তু চারদিকের অবস্হা উল্টো। এর সাথে তাল মেলাতে পারেনা তারা। বিত্তবানদের কেনাকাটার বাহার ও রকমারী আহার যেন তাদের বিদ্রুপই করে।
কেরামত অসচ্ছল অনেক দম্পতির কথা জানে, ঈদে নিজেরা কিছু কেনাকাটা না করেনা। কিন্তু তাদের অবুঝ সন্তানরাতো তা বুঝার কথা নয়। কারন রুক্ষ পৃথিবীর কঠোর বাস্তবতার সাথে এখনো পরিচিত হয়নি কোমলমতি এসব শিশু। তাই অন্য সবার মত তাদেরও জামা চাই জুতো চাই। কিন্তু অসহায় পিতামাতার কিইবা করার আছে ? তাদের কাছে আঙ্গিক সাজ-সজ্জার চেয়ে পেটে জামিন দেয়াটাই যে বেশী দরকারী। তাই তাদের কাছে ঈদ মানেই দীর্ঘশ্বাস। ঈদের দিন তারা সাজ-পোশাকে ঝলমল করেনা,  বাড়ীতে বিশেষ কোন অাইটেম রান্না হয়না, দুরে কোথাও বেড়ানো হয়না, এই হল তাদের ঈদ! এরা চায় ঈদটা তাড়াতাড়ি চলে যাক, আর জামা-জুতাসজ্জিত বিত্তবানরা অাফসোস করে এত তাড়াতাড়ি ঈদ শেষ হয়ে গেল? একই সমাজে দুইরকম অনুভূতি। এ কেমন সমাজ ব্যবস্হা আমাদের, কেরামতের মনে প্রশ্ন জাগে।
তাই প্রতিবছর ঈদ এলেই দোটানায় ভূগে সে। বাহারী পাঞ্জাবী-জামা-জুতা-আতর-গোলাপে সজ্জিত হয়ে ঈদ উদযাপন করা যেন গরীবদের বিদ্রুপ করারই নামান্তর,  এভাবে ঈদ করতে কেমন যেন বিবেকে বাঁধে তার। তবু ঈদ মার্কেটে মাঝে-মধ্যে ঢুঁ মারে সে। আলো ঝলমল শপিং মলগুলোতে এয়ারকন্ডিশনড আউটলেটসমূহে যেন “তিল ঠাঁই আর নাহিরে” অবস্হা। রাজ্যের হাবিজাবি পোশাক হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে গলাকাটা দামের ষ্টীকার লাগানো হয়েছে, ছেঁড়া জিন্সপ্যান্টের গায়েও কয়েক হাজার টাকার প্রাইসট্যাগ! ফুটপাতের নিলামী কাপড়ের শার্ট, টি-শার্টগুলো মোটা অংকের একদাম স্টীকার পরে এখানে এসি’র বাতাস খাচ্ছে। সেলসম্যান-গার্লদের যেন দম ফেলার ফুরসৎ নেই, সবাই মহাব্যস্ত। টিপটপ সাজের ধীরস্হির এক সেলসম্যানকে একটি পাঞ্জাবীর দাম জিজ্ঞেস করল কেরামত। কিন্তু জবাব না পেয়ে একটু জোরগলায় জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর না পেয়ে ভাল করে দেখে বুঝল আসলে এটা একটা প্লাস্টিকের মূর্তি ! মূর্তির গায়ে বাহারী পোশাক পরানোর মানে বুঝলনা সে। হেফাজতী হুজুরগন দেখলে মূর্তি সরানোর জন্য দোকানীকে আলটিমেটাম দিতে পারেন, মনে মনে বলল কেরামত।
সেখান থেকে বেরিয়ে অন্য একটা মার্কেটে গেল সে। সেখানে দুর থেকে বাল্যবন্ধু ও ডাকসাইটে ব্যাংক কর্মকর্তা তেজারত আলীকে দেখল। কিন্তু তেজারতের দুই হাতে-ঘাড়ে ও মাথায় কুলির মত একরাশ শপিং ব্যাগের বোঝা। কিন্তু তেজারত বেচারা কুলির কাজ ধরল কেন ? ব্যাংকগুলো যেভাবে একের পর এক লুট-দখল হচ্ছে, কর্মকর্তাদের চাকরী চলে যাওয়া আজকাল খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। এভাবে মনে হয় তেজারতের চাকরিও চলে গেছে, তাই জীবিকার খাতিরে কুলির কাজ করছে! আহারে বেচারা, মনে মনে আফসোস করে কেরামত। একটু সহানুভূতি জানাতেই হয়, কাছে গিয়ে ঘর্মাক্ত তেজারতের কুশলাদি জানতে চাইল সে। অমনি খান্ডারনী টাইপের এক মহিলা বাঁজখাই গলায় তেজারতকে ডাক দিল, তেজারত পড়িমরি করে দে ছুট। এতক্ষনে ভূল ভাঙ্গল কেরামতের। মহিলা তেজারতের বউ, ঈদ শপিং এ এসেছে। তেজারত আলীর ঘাঁড়ের বোঝাগুলো তার বউয়ের শপিং আইটেম ! তাহলে তেজারতের চাকরী আছে।
ঈদ মার্কেটিংয়ের নামে এসব বেলেল্লাপনা আর দেখতে ইচ্ছা হলনা কেরামত আলীর। সে নিজে কোনবছর ঈদে বিশেষ পোশাক নেয়না। কারন সারাবছরইতো কেনাকাটা করে, যখন ইচ্ছা কাপড়-চোপড়-জুতা নেয়। এখন ঈদে তাই তেমন দরকার নেই।
সদ্যগত ঘূর্নিঝড় মোরা’য় লন্ডভন্ড কক্সবাজার উপকূল। ভাঙ্গা বেড়িবাঁধের কারনে অনেক লোকালয়ে এখনো চলছে নিয়মিত জোয়ার ভাটা। দূর্গত এসব মানুষের ইফতার-সেহেরী’র নিশ্চয়তাও নেই, এবছর পানির সাথেই হবে তাদের ঈদ। এমতাবস্হায় ঝাঁকঝমক ও মার্কেটিং করে ঈদ পালনকারীরা যেন দূর্গত মানবতাকেই বিদ্রুপ করছে, কেরামত আলী উপলদ্ধি করে।
আচ্ছা মার্কেটিং করা নতুন বাহারী জামা-জুতাগুলো দূর্গতদের দিয়ে দেয়া যায়না ? তাহলে নতুন একটা ইতিহাস সৃষ্টি হত।
এমনিতেই প্রতিবছর একটু সাধারন ভাবেই ঈদ উদযাপন করে কেরামত আলী। কারন  সাধারণ সাজ-সজ্জায় যেন সমাজের সর্বশ্রেনীর সাথে মিশে যাওয়া যায়, কোন ভেদাভেদ থাকেনা। তাই ঈদ উৎসব সবার জন্য একই রকম কবে হবে, এর প্রতীক্ষায় দিন গুনে সে। একটা কবিতা মনে পড়ল তার,
“আমির-ফকির এক হয়ে যায় যে ঈদে,
আয়না সবাই এক হয়ে যাই সে ঈদে ।
এক থাকি সব এমনি করে জীবন ভর,
যাই ভুলে যাই উচু-নিচু আপন-পর।”
ঈদের সাজপোশাকে উঁচু-নিচু, ভেদাভেদমুক্ত একটা ঈদ দেখার শখ তার  অনেকদিনের।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গানটির প্রথম কলি মনে পড়ে তার “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ,
আজ আপনাকে তুই বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাকিদ”।
ঈদ উৎসব-আনন্দ সার্বজনীন করার  আসমানী তাগিদ আমাদের সমাজ ব্যবস্হায় বাস্তবায়ন কখন হবে ?
প্রহর গুনে কেরামত আলী।
সমাজের সর্বশ্রেনীর সবার জন্য একই রকম ঈদ হলে তাই হবে আসল ঈদ সম্মিলন, এই হোক আজ ও আগামীর  প্রত্যাশা।
পুনশ্চ, এ লেখার শেষে কেরামত জানতে পারল, ঈদ নাকি এখন ইদ হয়ে গেছে ! তাই সবাইকে ঈদ ও ইদের শুভেচ্ছা, ঈদ-ইদ মোবারক।
=====================
আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী।
চীফ রিপোর্টার,
দৈনিক আমাদের কক্সবাজার।
মুঠোফোন – ০১৮১৮ – ০০০২২০