– এহ্সান উদ্দিন

টেকনাফ উপজেলার প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার  জামাল আহমদ ছিলেন সীমান্ত জনপদের আলোসঞ্চারী বটবৃক্ষ। জ্ঞানে-মননে-সৃজনে একটি আলোর পাঠশালা। সোনার চামচ মুখে নিয়ে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ফুলের ডেইল গ্রামে মাওলানা আবুল হাশেম ও গুলফরাজ বেগমের ঘর আলোকিত করে ১৮ই নভেম্বর, ১৯৫৬ সালে জন্ম নেওয়া এ মানুষটি সময়ের পরিক্রমায় হয়ে ওঠেছেন দেশসেরা কার্ডিওলজিস্ট। ৫ ভাই, চার বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ সন্তান। ব্যক্তিজীবনে ২ মেয়ে ও এক ছেলের জনক। একমাত্র ছেলে বাবার মতোই ডাক্তার হয়েছে। বড় মেয়ে আর্কিটেক্ট ও ছোট মেয়ে অর্থনীতি বিষয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট।

এতদ্বাঞ্চলে তাঁর পরিবারের রয়েছে তিন পুরুষের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক লিগ্যাসি। তাঁর জ্যাঠা আব্দুল গফুর চৌধুরী উখিয়া-টেকনাফের এমপি, জ্যাঠাত ভাই জালাল উদ্দিন চৌধুরী ও খালাত ভাই এইচকে আনোয়ার ছিলেন হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। হ্নীলা ইউনিয়নের প্রথম মুসলিম প্রশাসক মাওলানা আব্দুর রশিদ চৌধুরীও ছিলেন তাঁর জ্যাঠা। এক বুনিয়াদি পরিবারের উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর বোধের জায়গায় কেবল এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা কিলবিল করতো। পিতার ইচ্ছে ছিলো ছেলে ডাক্তার হয়ে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিবে। এলাকার মানুষের পাশে থাকবে সবসময়। পিতার বাসনা ও জন্মজনপদের প্রতি এ অমোঘ নিবেদন থেকে ১৯৯৮ সালের ০৫ই মার্চ মা-বাবার নামে গড়ে তুলেছিলেন বহুমাত্রিক সামাজিক সংগঠন ‘হ্নীলা গুলফরাজ হাশেম ফাউন্ডেশন’।

গতবছর নিজে উপস্থিত থেকে খুবই উৎসবমুখর পরিবেশে ফাউন্ডেশনের ২৫ বছর পূর্তি উৎসব উদযাপন করেছেন। আজ তিনি চিরজীবিতদের দলে। মেডিকেল ডে-কেয়ার, আউটডোর, মিনি অপারেশন, ফ্রি খৎনা, উপজেলাভিত্তিক বৃত্তি পরীক্ষা, গরীব মেধাবী বৃত্তি, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, গণ-পাঠাগার ও ডায়াবেটিস সেন্টারসহ নানামুখী জনসেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে টেকনাফ তথা কক্সবাজারের মানুষের কাছে ‘হ্নীলা গুলফরাজ হাশেম ফাউন্ডেশন’ পরিচিত লাভ করেছে একটি প্রদীপ্ত ইনস্টিটিউশন বা আস্থার ঠিকানা হিসেবে।

চট্টগ্রাম শহরে বেসরকারি চিকিৎসায় অবদান রাখা সিএসসিআর হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা কয়েকজন ডাক্তার বন্ধু মিলে এবং দীর্ঘদিন সেখানে এমডির দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। চট্টগ্রামে অবস্থানরত টেকনাফিয়ানদের ঐক্য, সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য সাঁকো হিসেবে ‘টেকনাফ সমিতি’ গঠনে ছিলো তাঁর অগ্রণী ভূমিকা। আমৃত্যু টেকনাফ সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন এ মহৎপ্রাণ মানুষটি। সাংগঠনিক দক্ষতা বা সুচারুভাবে সংগঠন সামলানো, শান্ত মেজাজে সবকিছুকে সেটল করা তাঁর জন্য ছিলো মামুলি ব্যাপার। কাজের চাপে কখনও ভেঙ্গে পড়তেন না; খুবই ধীরস্থিরভাবে ট্যাক্টফুলি হ্যান্ডেল করতেন সবকিছু। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো সবার নজর এড়ালেও তাঁর চোখ ফাঁকি দেওয়া বেশ মুশকিল ছিলো। ভীষণ স্মৃতিধর ও নান্দনিক বোধসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। জনে জনে সবার খোঁজখবর রাখতেন। আপাদমস্তক একজন সামাজিক মানুষ বলতে যা বুঝায়; ডা. জামাল আহমদ ছিলেন ঠিক তার প্রতিবিম্ব।

পেশাগত কারণে পৃথিবীর বহুদেশে সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ করেছেন। সেখানকার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দিয়ে এলাকার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের চিন্তা করতেন। যার ফলশ্রুত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে অনগ্রসরতাকে পদদলিত করা প্রতিষ্ঠান ‘হ্নীলা গুলফরাজ হাশেম ফাউন্ডেশন’ একটি বৈপ্লবিক নামে পরিণত হয়েছে।

ভ্রমণপিয়াসী মানুষ হিসেবে একধরণের ঘোরগ্রস্ত হয়ে সময় পেলে পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়িয়ে আসতেন নিজের পছন্দের দেশে। দ্বীনদার মানুষ ছিলেন বটেই; ইসলামের হারানো গৌরব-ঐতিহ্য নিয়ে বিস্তর জানাশোনাও ছিলো তাঁর। দ্বীনকে বুঝে ভেতরে ধারণ করে প্রাত্যহিক জীবনে চর্চা করতেন সহীহ্ভাবে। মিশর, তুরস্ক, স্পেনসহ বহুদেশে ইসলামের গৌরবগাথা ঘুরে ঘুরে দেখে নিজের মানসপটে এঁকে জীবনাচারে মেনে চলেছেন প্রত্যহ।
কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ সাদা মনের মানুষ হিসেবে গোটা দেশে পরিচিত পান তিনি। কর্ম স্পৃহা, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, সমাজের প্রতি দরদ, শেকড়ের প্রতি টান তাঁকে গণমানুষের মণিকোঠায় অমর করে রাখবে অনন্তকাল।

লেখক: প্রভাষক, কক্সবাজার সিটি কলেজ ও জীবন সদস্য, হ্নীলা গুলফরাজ হাশেম ফাউন্ডেশন