ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দিন

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা যেমন আজও নিশ্চিত হয়নি, তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষাও আজও পরিকল্পিত নয়। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। সাধারণ জনগণের চিকিৎসাসেবা গ্রহণে বিদেশগমন প্রবণতা এখনও উচ্চ হারে বিরাজমান। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা এখনো সর্বজনীন ও জনবান্ধব হয়ে ওঠেনি।

স্বাস্থ্যসেবা দেশের জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হলেও, এর বাস্তব প্রতিফলন এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্জিত হয়নি। একটি পরিকল্পিত স্বাস্থ্যনীতির অনুপস্থিতি, চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক উন্নয়নের অভাব, এবং ‘প্রতিরোধই প্রতিকারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ’—এই সত্যটি সমাজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।

যদিও বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তবে পরিতাপের বিষয়, ২০২১ সালে স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশ ১০০ স্কোরের মধ্যে পেয়েছিল মাত্র ৫২। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নিচে ছিল কেবল পাকিস্তান ও আফগানিস্তান।

এই প্রেক্ষাপটে, কক্সবাজার জেলার বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা এবং জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ। জেলায় বসবাসরত বিশাল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি রয়েছে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী, যারা স্বাস্থ্যসেবার উপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে।


FDMN (Forcibly Displaced Myanmar Nationals) এবং স্থানীয় জনগণের (Host Community) স্বাস্থ্যসেবায় চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়

চ্যালেঞ্জ ১: স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব

এ অঞ্চলের স্থানীয় জনগণ ও রোহিঙ্গাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত জ্ঞান খুবই সীমিত। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে তারা প্রায়ই অবগত নয়। ফলে অসংক্রামক ব্যাধির পাশাপাশি সংক্রামক রোগ—যেমন স্ক্যাবিস, এইডস, সিফিলিস ইত্যাদি—স্থানীয় জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে।

উত্তরণের উপায়:

(ক) সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে জনপ্রতিনিধি, মাঝি-হেড মাঝি, ইমাম, ও স্থানীয় ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করা।
(খ) স্বাস্থ্যবিধি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের ভয়াবহতা, প্রতিকার ও চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।


চ্যালেঞ্জ ২: স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে অনীহা

ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের কারণে রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণ আধুনিক চিকিৎসার চেয়ে ঝাড়ফুঁক বা লতা-পাতার ব্যবহারকে বেশি গুরুত্ব দেয়। পর্দাপ্রথা, গোপনীয়তা এবং নারীর চলাফেরায় বিধিনিষেধের কারণে অনেকেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসতে অনিচ্ছুক।

উত্তরণের উপায়:

(ক) স্থানীয়দের মাঝে প্রচলিত অপচিকিৎসার ক্ষতিকর দিক ও আধুনিক চিকিৎসার সুফল তুলনা করে উপস্থাপন করা—উঠান বৈঠক, নাটিকা, সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে।
(খ) “স্বাস্থ্যসেবা আপনার গৃহে”—এই স্লোগানে আউটরিচ প্রোগ্রামের মাধ্যমে ব্লকভিত্তিক ও বাড়িভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান। এর জন্য কমিউনিটি নার্সদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও মোতায়েন করা।


চ্যালেঞ্জ ৩: অপ্রতুল স্বাস্থ্যসেবা

কক্সবাজারে বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বসবাস করছে, যার জন্য ২৫০ শয্যার একটি মাত্র জেলা সদর হাসপাতাল রয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী আসে। জনবল সংকট প্রকট।

উত্তরণের উপায়:

(ক) ৫০০ শয্যার কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা। নার্সিং কলেজ স্থাপন ও উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শয্যা, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি বাড়ানো এবং সেগুলোর কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করা।
(খ) শূন্যপদের বিপরীতে দ্রুত জনবল নিয়োগ, বিশেষ করে নার্স নিয়োগ।


চ্যালেঞ্জ ৪: প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব

প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করার জন্য দক্ষ জনবল প্রয়োজন, যা বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।

উত্তরণের উপায়:

চলমান জনবলকে নিম্নোক্ত বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া:

  • Basic Life Support (BLS), Advanced Life Support (ALS), Basic Emergency Care (BEC)

  • সংক্রমণ প্রতিরোধ (Infection Prevention and Control)

  • হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

  • মানসিক সহায়তা (Psychosocial Support – PSS)

  • নবজাতকের শ্বাস প্রশ্বাস সহায়তা (Helping Baby Breathe)

  • নিরাপদ ইনফিউশন থেরাপি

  • প্রবীণ ও প্যালিয়েটিভ কেয়ার

  • শিশু ও মাতৃদুগ্ধ পুষ্টি (IYCF)

  • দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া (Disaster Response & Medical Emergency in Disaster)


উপসংহার

বর্তমানে অসংক্রামক ব্যাধির হার এই প্রান্তিক জেলাতেও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর ৬৭% ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যানসারের মতো রোগে হয়, অথচ জাতীয় স্বাস্থ্য বাজেটের মাত্র ৪.২% এই খাতে বরাদ্দ করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও আর্ক ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে শহরাঞ্চলে ‘ন্যাশনাল হাইপারটেনশন অ্যান্ড ডায়াবেটিস ম্যানেজমেন্ট প্রটোকল’ চালু করা হয়েছে। এ ধরনের প্রশিক্ষণ কক্সবাজারেও সম্প্রসারিত করা জরুরি।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (AMR) একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট। ২০১৯ সালে শুধুমাত্র বাংলাদেশেই ২৬,২০০ জন মানুষ এতে মারা যায়। এই সংকট মোকাবেলায় ‘One Health Approach’ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

বর্তমানে জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ মাত্র ৫.২% এবং স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আছে মাত্র ১% মানুষ। স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় সাশ্রয়ী ও নিয়ন্ত্রিত মূল্যের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে একটি জাতীয় নিয়ন্ত্রক কাঠামো গঠন অপরিহার্য।


লেখক:
ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দিন
নার্স ও পুষ্টিবিদ, কক্সবাজার।