• মুফিদুল আলম

পড়ন্ত বিকেল। আমার দুই সহকর্মী নিয়ে চললুম। বায়েজিদ লিংকরোড ধরে এগুলুম। বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সড়ক দিয়ে অল্পটুকু যেতেই এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন। তার কিছুপরে ডান পাশ ঘেঁষে ছোট্ট একটা মেঠো পথ ধরে গাড়ি এগিয়ে চলল। চোখে পড়ল সীতাকুণ্ড উপজেলার সলিমপুর মৌজার ছিন্নমূল বাজার। নামের সাথে বাজারের মিলামিল আছে কি-নাই সে প্রশ্ন না হয় থাক। স্বর্ণের দোকান ও নজর কাড়লো। ভালো রেস্টুরেন্ট, গাড়ি মেরামত কারখানা কোনটাই বাদ নেই।

উদ্দেশ্য সিঙ্গাপুর দেখা। সিঙ্গাপুরে কখনো যাওয়া হয়নি। বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর বানানোর আয়োজন, তাও চট্টগ্রামে। দেহে, মনে টানটান উত্তেজনা। সহকর্মীদের সাথে অনেক বিষয়ে কথা চলছিল। আলাপের মাঝে আনমনা থাকায় খই হারিয়ে ফেলি। পাহাড়ের মাঝে পথ। মনে হল একদল শল্যবিদ নির্মমভাবে সেরেছেন হৃদরোগের অপারেশন। সরু গলি পেরিয়ে বিশাল সাইনবোর্ড। বাংলা হরফে লেখা-আলিনগর। কোন সে আলী? হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তো অনেক আগেই ওফাত হয়েছেন।

সরকারি গাড়ি দেখামাত্রই আটকে দিল। অনেকটা বিরোধী দলের সমাবেশ বানচাল এর মত। এলোপাতাড়ি সি,এন,জি, বাস-ট্রাক গুলো ডানে-বামে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে। পরিচয় দিলাম, আমি ম্যাজিস্ট্রেট। ভাবলেশহীন।কোন নড়াচড়া নাই। হোমরা চোমরা ফোন দিয়ে বড় ভাইদের পারমিশন চাই। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর বাংলা সিনেমার নায়ক হাজির। নাম -ফারুক। না, এ কোন অভিনেতা ফারুক নয়।পরিচয় দিয়ে যেতে চাইলাম। সীমিত আকারে পারমিশন দিল। আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলল গাড়ি। চতুর্পাশে পাহারাদার। দু’পাশে মোটর সাইকেলের বিশাল বহর। পাহারা দিয়ে সুসজ্জিত অস্ত্রে ছন্দের তালে তালে মোটরসাইকেল গুলো আমাদের সাথেই এগিয়ে চলছে। যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। আমি কোন রাজাধিরাজ !!! আমার জুনিয়র সহকর্মীরা মাঝে মাঝে ফুসফাস করলেও আমি নিশ্চুপ। উপলব্ধি করছিলাম। বুকের ভিতর অনুভূত হল জগদ্দল পাথর। শ্বাসটা মনে হয় বের হবার উপক্রম। নিজেকে সামলে নিয়ে আলতোভাবে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম।

নেতাজি, এভাবে পাহাড় কাটছেন কেন ?
থাকার জায়গা নেই, এক দন্ড আশ্রয়ের জন্য ।
পাহাড়-কাটাতো অপরাধ ?
পাল্টা প্রশ্ন- তাহলে রোহিঙ্গাদের জন্য এত পাহাড় কেটেছেন কেন?
বিশেষ পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য পাহাড় কাটা।
চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বড় বড় লোকেরা কর্তন করছে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু করেছেন?
করিনি কে বলল ? তাই বলে কি তোমাদের পাহাড় কর্তনের পাপ মোচনযোগ্য।

কথা বাড়ালাম না। সংখ্যায় অনেক। আমরা তিনজন। এদিক ওদিক হলে বিপত্তি নিশ্চিত। মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল । দুর্ঘটনা হলে রেসকিউ করা দূরুহ। রাগে সারা শরীর কটমট করছে। নরসুন্দর মাথার চুল কাটলে যেমন, পাহাড়গুলোর দৃশ্য অনুরূপ। বিশাল বিশাল পাহাড় –কাটছে, প্রকাশ্যে, টিনের বেড়ার আড়ালে । পাহাড় কেটে বানাচ্ছে সমতল মাঠ । বিরান মরুভূমি। ড্রেনেজ সিস্টেম ডেভলপ করছে। পাহাড়ের বুক চিড়ে প্লট বিক্রয় চলছে। জমির রেকর্ড আছে বলে দাবী করে। কয়েকজনকে দেখে মনে হলো- ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’। আশেপাশে যারা ঘুরঘুর করছে, অনেকেই পরিবেশের মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। বুক উঁচিয়ে হাঁটছে। আমাকে দেখে তীর্যক হাসি। খুঁটির জোর কাকে বলে? সব জায়গায় বিদ্যুতের আলোক ঝলসানি। দু’একটা সরকারি প্রকল্পও চোখে ধরা পড়ল। পাহাড় কেটে সমতল করে রাতারাতি সিঙ্গাপুর বানানোর আয়োজন। কার বুকের পাটা আছে, বন্ধ করার এ আয়োজন। দেখতে যেতে পারেন। প্রধান সড়ক দিয়ে দেখা যাবেনা। প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে ভিতরে না গেলে বোঝার কোন উপায় নেই, বিশাল আয়োজন, বিশাল কর্মযজ্ঞ।

সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এলাকায় প্রবেশ নিষেধ। প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নাকি অস্পৃশ্য। দুর্মুখেরা বলে থাকেন পুলিশের সাথে নাকি এদের দহরম -মহরম সম্পর্ক। এটা এক ভিন্ন জগৎ । পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার ছয় বছরের চাকুরীর অভিজ্ঞতা। অনেক গহীন অরণ্যে প্রবেশ করেছি। কখনো সেভাবে বুক কাঁপেনি। প্রদীপের নিচে এত অন্ধকার তা ভাবিনি । সারাদেশে পরিবেশ কর্মীরা বিপ্লবের ঢেউ তুললেও ছোঁয়া লাগাতে পারেনি এ জনপদে। ব্যর্থ, সত্যিই ব্যর্থ, অপদার্থ । আর কোনো বিশেষণ থাকলে তাও প্রযোজ্য। মস্তক অবনত হয়ে মেনে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই । আমরা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে সফল কে–রাষ্ট্র না দুর্বৃত্ত।

(লেখক : পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চল এবং সরকারের জ্যেষ্ঠ উপসচিব।)