সৈয়দ তানবীর মাহমুদ খোন্দকার
প্রথমে নব যোগদানকৃত শিক্ষককে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন। আপনারা সবাই যোগ্যতা অর্জন করে এই পেশায় এসেছেন। আপনারা সবাই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী। অর্থাৎ আপনারা রাষ্ট্রের সুনাগরিক। তাছাড়া আপনারা সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ। একেক জন শিক্ষক একেকজন দার্শনিক ও বিচারক। এই চাকরির ফলে আপনার যেমন সামাজিক মর্যাদা বেড়েছে তেমনি আয় রোজগার এর একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। মহান রবের নিকট আপনারা শোকরিয়া আদায় করবেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আপনারা যথাযথভাবে পালন করবেন। কারণ দায়িত্ব অবহেলা মানে হক নষ্ট করা। সুতরাং অন্যের হক নষ্ট করে আপনি ইবাদত করলেও তা কবুল হবে না। যেহেতু আপনি এই চাকরিতে জেনে শুনে এসেছেন সেহেতু আপনার পক্ষে এই চাকরির শর্তাবলী পালন করা ফরজ। আপনারা প্রাথমিক শিক্ষাকে একটা উন্নত মানদণ্ডে নিয়ে যাবেন এই প্রত্যাশা আমার। এই প্রাথমিক শিক্ষার আমুল পরিবর্তন আসবে আপনাদের হাত ধরে। কেননা আপনারা উচ্চতর ডিগ্রীধারী।
আমি ও আপনাদের মতো একজন শিক্ষক। আমার চাকরির বয়স ১৫ বছর। অর্থাৎ চাকরি জীবনের অর্ধেক কাল অতিক্রম করেছি। আমার জন্ম শিক্ষক পরিবারে। আমার বাবাও একজন আদর্শবান শিক্ষক ছিলেন। দীর্ঘ ৪২ বছর পালং হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। আমার প্রপিতামহ ও একজন বৃটিশ পিরিয়ড এর নামকরা শিক্ষক ছিলেন। সেই দৃষ্টিকোণ হতে আপনারা আমার আত্মার আত্মীয়। শুধু আপনারা নয় পৃথিবীর সব শিক্ষক আমার আত্মার আত্মীয়। সেই দৃষ্টিকোণ হতে আপনাদের প্রতি আমার কিছু মূল্যবান পরামর্শ রইল। অনেক ভেবেচিন্তে কথাগুলো লিখলাম। যা আপনাদের পেশাগত মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
# আগেকার শিক্ষকরা এই শিক্ষকতা পেশাকে নেশা হিসেবে নিয়েছেন। তারা কখনো চাকরি হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় আসেনি। এখন আমরা এই শিক্ষকতা পেশা কে জাস্ট চাকরি হিসেবে নিয়েছি। যদি চাকরি হিসেবে নেন তাহলে আপনি সাধারণ একজন মানুষ। আর যদি নেশা হিসেবে নেন তাহলে আপনি অসাধারণ একজন মানুষ। সিদ্ধান্ত আপনার।
# আপনাকে সরকার ডেকে আনেনি। আপনি নিজেই সরকারি চাকরিতে এসেছেন। তাই এই চাকরির মর্যাদা রক্ষা করা আপনার নৈতিক দায়িত্ব। কাজেই কোন অবস্থাতে এই চাকরি ছোট, এই চাকরি তে আমি এমনি এসেছি আবার চলে যাব ইত্যাদি ইত্যাদি মূল্যহীন কথা বলবেন না। এতে নিজের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। এই চাকরি ভালো না লাগলে সহজে অন্য পেশায় চলে যান।
# এই চাকরির আগে আপনি সাধারণ একজন। আর এখন আপনি একজন শিক্ষক। আপনি এখন নিয়মকানুনের অধীন। যা ইচ্ছে তাই করতে পারবেন না। অর্থাৎ রুলস এন্ড রিগুলেশন এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। শিক্ষক হিসেবে আপনার কি করা উচিৎ, কি করা উচিৎ নয় তা আপনার পূর্ব জ্ঞান থাকতে হবে। অর্থাৎ ভাবিয়ে করিও কাজ করিয়ে ভাবিও না।
# একজন শিক্ষক এর টেবিল টকিং কি হবে এই বিষয়ে বিস্তর জানতে হবে আপনাকে। অফিস আমাদের বাড়ি নয় যা ইচ্ছে তাই করব। নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কথা কেন অফিসে করবেন। মনে রাখবেন এটা আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি নয় সরকারি অফিস। তাই অফিসে শিক্ষামুলক আলোচনা করা শ্রেয়। অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন এবং বাজে আলোচনা অফিসে করবেন না। এতে নিজের গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। আপনি সবার কাছে মূল্যহীন একজন ব্যক্তা হিসেবে থাকবেন। সাধারণত মহিলা শিক্ষকরা বাজে বিষয় তথা পরিবারের নানা ঘটনাবলি নিয়ে অফিসে গল্প গুজবে সময় অতিবাহিত করেন। আবার ও বলছি অফিসে আপনার পারসোনাল বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করবেন না। আপনার দেখাদেখি অন্যরা ও করবে।
# মানুষ এখন কাউকে সম্মান করে না। কারণ মানবিকতা, সামাজিকতা, ভদ্রতা ও নম্রতা মানুষের মাঝে নেই বললে চলে। কেউ আপনাকে সম্মান করে না বলে আপনি নিজে মূল্যহীন তথা হীনমন্যতায় ভুগবেন না। নিজের মর্যাদা নিজেকে ধরে রাখতে হবে। আপনি নিজের ভাগ্যবিধাতা। নিজের মূল্যায়ন নিজেকে করতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ হল ব্যক্তিত্ব ও আত্মমর্যাদা। এই দুটো জিনিস ধরে রাখতে পারলে আপনি সম্মানিত হবেন। আর যদি না পারেন তাহলে আপনি হতভাগা একজন। নিজের মর্যাদা যদি নিজে নষ্ট করেন এতে অন্যকে দোষারোপ করে লাভ নেই।
# সিনিয়রকে শ্রদ্ধা করতে শিখুন। আপনি যদি সিনিয়র কে সম্মান দিতে না জানেন তাহলে আপনি কিভাবে অন্যের কাছে সম্মান আশা করবেন। সিনিয়রদের সাথে কথা বলার সময় দূরত্ব বাজায় রেখে চলবেন। মনে রাখবেন, Respect brings bigger respect.
# কখনো অন্যের অনুপস্থিতিতে কারো সমালোচনা ও নিন্দা করবেন। হিংসা বিদ্বেষ অযোগ্যদের মূলধন। যোগ্য ব্যক্তির মূলধন হল কর্মদক্ষতা। আপনি আপনার পেশাগত দক্ষতা অর্জন করুন। দেখবেন আপনার সুনাম ফুলের সুবাসের মত ছড়িয়ে পড়ছে। সমালোচনা করবেন সামনাসামনি আর পেছনে করবেন সুনাম। বলাবাহুল্য, যোগ্যব্যক্তির সমালোচনা থাকবে। অযোগ্য ব্যক্তিরা করে সমালোচনা। কারণ তারা Inferiority complex এ ভুগেন। লেনসন ম্যান্ডেলা বলেন, সমালোচনা করতে যোগ্যতা লাগে না সমালোচিত হতে যোগ্যতা লাগে।
# আমরা চোখে সবকিছু দেখি। তবে এই চোখ দিয়ে সব সময়ই অন্যের দোষ দেখি, নিজের দোষ দেখিনা। এটাই আমাদের মূল সমস্যা। সাবেক সচিব আউয়াল মজুমদার লিখেছেন – “আমার মা নিরক্ষর ছিলেন। তিনি আমাকে বলতেন- সবসময় নিজের দোষ দেখবে অন্যের গুণ দেখবে। চাকরি জীবনে আমি আমার মায়ের আদেশ সবসময়ই পালন করেছি। ” তাই আমরা যদি নিজের দোষ বের করতে পারি সমাধান একেবারেই সহজ।
# তিনজন বসে আড্ডা দিচ্ছেন। কোন সমস্যা নেই। তবে সবার সামনে দুজন কানাকানি করবেন না। যারা এই ধরনের নিকৃষ্ট কাজ করে তারা narrow minded.
# নিজের বাচ্চার খেতমতের জন্য স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করবেন না। ঐ শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে ডাক্তার, ম্যাজিস্ট্রেট, শিক্ষক অথবা কূটনীতিক হতে পারে। তখন সে আপনার রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। নিজের মর্যাদা কখনো নষ্ট করবেন না। মহিলা শিক্ষকরা এই কাজগুলো বেশি করে।
# বিদ্যালয়ের শিক্ষক এর চেয়ার ও টেবিলে নিজের বাচ্চাদের বসাবেন না। অনেক মহিলা শিক্ষক তাদের বাচ্চা কে জুতো নিয়ে টেবিলে বসান। এটা খুবই অমানবিক ও নিম্ন মানসিকতার লক্ষণ।
# খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। মুরগির রানের মাংস সবসময়ই কি আপনার ছেলের পাতে যাবে? এই বদঅভ্যাস হতে আমাদের বের হতে হবে। আপনার প্লেটে ও কেন মুরগির রানের মাংস বরাদ্দ থাকবে? এই বদ অভ্যাস পরিহার করুন। শেখার ও জানার কোন বয়স নেই। যেকোন বয়সে শেখা যায়। সাবেক সচিব আউয়াল মজুমদার লিখেছেন – My mother was illiterate but self educated. She told me- “Give in others plate first then you take in your own plate. Give the biggest one in others plate when you’re distributor, take a small piece in your plate.” সম্মানিত শিক্ষকরা এই নিয়মটা ফলো করার চেষ্টা করুন আর অন্যকে ও উৎসাহিত করুন।
# High thinking, simply living. প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ এটা Principle হিসেবে নেন। আপনি কে এটা আপনার কপালে লেখা নেই তবে আপনার ব্যবহারে লেখা আছে। তাই চিন্তা চেতনা সবসময় উঁচু রাখবেন। সবসময় positive চিন্তা করবেন।
# জীবনকে ঢেলে সাজাতে হলে ভালো মানুষের সাথেই মিশতে হয়। হাজারো পাঠ্যপুস্তক হতে যা জানতে পারবেন না একজন ভালো মানুষ হতে অধিক জানতে পারবেন। আমার মা আমাকে বলেছিলেন – অপুত সবসময় ভালা মাইনষ্যর পোয়াতি আড়িবিদে। আসলে জীবন কে বদলাতে হলে ভালো মানুষের সাথেই চলতে হয়। ভালো মানুষের গালি হতে অনেক কিছু শেখার আছে। ভালো মানুষের সাথেই যতই মেলামেশা করবেন ততই মন মানসিকতা ও চিন্তা চেতনা উন্নত হবে।
# কারো বয়স কত, বেতন কত, কি করে না করে এই সব বিরক্তিকর প্রশ্ন করবেন না। এটা চরম ব্যক্তিত্বহীনতা। ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় কাজে -কর্মে, চিন্তা-চেতনা এবং মেধা ও মননে।
# শিক্ষক সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বেশি কথা বলা। এরিস্টটল বলেন – বেশি কথা বলা তা যত মূল্যবান হোক নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ। মনে রাখবেন, কথায় আচরণ প্রকাশ পায়। জ্ঞানী লোকেরা নীরব থাকে। মূর্খরা বেশি কথা বলে ও তর্ক করে।
# কখনো কাউকে ছোট করে কিছু বলবেন না। কাউকে ছোট করা মানে নিজেই ছোট হওয়া। কোন সুস্থ বিবেকবান মানুষ এই ধরনের নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে না।
# অফিসে বসে বসে গীবত চর্চা করবেন না। এটা নিন্দনীয় কাজ। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, অনেক মহিলা শিক্ষকরা অফিসে বসে বসে অন্যের গীবত চর্চায় সময় পার করেন। কার বাড়িতে কি হয়েছে, কার ছেলেমেয়ে কেমন, দেখতে সুন্দর না, ওরা ভালো মানুষ না ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে আপনি কোন লেভেলের মানুষ যা সহজে পরিমাপ করা যায়। আমার মা বলতেন- কখনো সাপকে লম্বা আর ব্যাঙকে বেটে বল না। আমি তা মেনে চলি। আপনারা চাইলে অনুসরণ করতে পারেন।
# অন্যায় অনাচারের প্রতিবাদ করতে হবে। সরকারি টাকা যথাযথভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখতে হবে। So to say, There is a beautiful side to protest.
# কর্মক্ষেত্রে ও চলার পথে আপনি অনেক নেগেটিভ মানুষ পাবেন। এর মধ্যেই আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে। বলাবাহুল্য, Good men know how to remain good and fit in all difficulties.
# আরেকটি কথা না বললে নয়, কর্মক্ষেত্রে কখনো দলাদলি করবেন না। এটা খুবই নিন্দনীয় কাজ। এতে আপনি মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যেমন হবেন তেমনি হতাশায় ভুগবেন। আপনি কারো পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেবেন না। আপনার মতো আপনি থাকবেন। স্বীয় বিবেককে সবসময়ই প্রশ্ন করবেন আপনি সঠিক কিনা। মনে রাখবেন, অসৎ মানুষের শেষটা সুন্দর হয় না। সৎ মানুষের মানুষের জীবনে কষ্ট থাকলেও দিনশেষে মানসিক শান্তি আছে।
পরিশেষে বলব, Your certificate is just a piece of paper but real education is seen in your behavior.
লেখক: সহকারী শিক্ষক
মধ্য রাজাপালং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উখিয়া।