মুহাম্মদ ওমর হামজা:
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য যিনি ঘোষণা করেছেন ” মু’মিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।” দরুদ ও সালাম বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লা্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরস্পর ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে ইসলামি সমাজের ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিলেন। তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি সালাম বর্ষিত হোক। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই,তাঁর কোন শরীক নেই এবং মুহাম্মাদ (সা) তাঁরই বান্দা ও রাসুল।অতঃপর….
সম্মানিত হাজেরীন,
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের অপার রহমতের উপর ভরসা করে আমি আজকের জুমু’আর আলোচনায় ইসলামি সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ‘ইসলামি ভ্রাতৃত্ব’ সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে বলার প্রয়াসী। ‘ ইসলামি ভ্রাতৃত্ব’কে আরবিতে বলা হয় ‘আল উখওয়াতুল ইসলামিয়া ‘ আর ইংরেজিতে ‘ Islamic brotherhood বা Islamic fraternity. ইহা আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামত ও অনুগ্রহ বিশেষ, যা তিনি স্বীয় বান্দাদের অন্তরে সমর্পিত করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে ‘ ভ্রাতৃত্ব’ হলো প্রথম ইট বা ভিত্তি যার উপর রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনা হিজরতের পর সুদৃঢ় একটি ইসলামি সমাজের গোড়াপত্তন করেছিলেন।প্রথমতঃ তিনি আনসার ও মুহাজিরগণের মাঝে ভ্রাতৃত্ব স্থাপন করে দিয়েছিলেন।আর এই ভ্রাতৃত্বকে প্রাধান্য দানের সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করেয়েছিলেন। ফলে প্রতিটি প্রয়োজনেই আনসারগণ নিজেদের উপর মুহাজিরগণকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এ প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা সূরা হাশরের ০৯ নম্বর আয়াতে বলেন: “আর তাদের জন্য ও মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা এই নগরীতে বসবাস করেছে ও ঈমান এনেছে, তারা মুহাজিরদেরকে ভালোবাসে এবং মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে তার জন্য তারা অন্তরে আকাঙ্খা পোষণ করেনা। আর তারা তাদেরকে নিজেদের উপর অগ্রাধিকার দেয় নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও যাদেরকে অন্তরের কার্পণ্য হতে মুক্ত রাখা হয়েছে; তারাই সফলকাম।”
সম্মানিত ভাইগণ,
ইসলামে দীনি ভ্রাতৃত্ব সকল সম্পর্কের উপর প্রাধান্য লাভ করেছে। এমনি বংশীয় সম্পর্কের উপরেও । ফলে মুসলমান স্বীয় সম্প্রদায় থেকে ও দায়িত্বমুক্ত হয়ে পড়েছেন।স্বীয় আপনজনদের থেকে বের হয়ে গেছেন। সন্তান বাবার সাথে দ্বন্ধে লিপ্ত হয়েছে। ভাই ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করেছে দীনের পরিবর্তনের কারণে।এদিকেই আল্লাহ তা’আলা স্বীয় বাণী সূরা মুজাদালার ২২ নম্বর আয়াত দ্বারা ইংগিত করেছেন: ” তুমি পাবে না আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী কোন সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীদেরকে, হোক না এই বিরুদ্ধাচারীরা তাদের পিতা,পুত্র,ভ্রাতা,অথবা এদের আত্মীয় গোত্র। ”
সমবেত মুসল্লী ভাইগণ,
নির্ভরযোগ্য অসংখ্য হাদীস দ্বারা নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে,সর্বাবস্থায় ঈমানী ভ্রাতৃত্ব রক্ষা করা, বিপদাপদে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা করা এবং একে অপরের প্রতি কোন প্রকার জুলুম- অত্যাচার না করার বিষয়ে মহানবী (সা) এর অমিয় বাণী থেকে এক গুচ্ছ :
(ক) হযরত আনাস(রা) থেকে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মু’মিন হতে পারবে না যতক্ষণ না নিজের জন্য যা ভালবাসবে তা অপর ভাইয়ের জন্য ও ভালোবাসবে। (বুখারী)
(খ)৷অপর একটি বর্ণনায় আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, প্রত্যেক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের রক্ত, সম্পদ এবং মান – সম্মানহানী করা হারাম।
(গ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, না সে তার প্রতি জুলুম করবে,না তাকে অন্যের হওলা করবে। যে কেউ তার ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মেটাবেন। (বুখারী)।
(ঘ) ইবনে হিশাম বিরচিত সীরতুন্নবী গ্রন্থে বর্ণিত বিদায় হজ্বের ভাষণের কিয়দংশে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন : হে লোক সকল! তোমরা আমার বক্তব্য শ্রবণ কর এবং তা অনুধাবন করতে চেষ্টা কর, জেনে রাখ,নিশ্চয় প্রত্যেক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। এবং সকল মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং কোন ব্যক্তির জন্য তার ভাইয়ের কিছুই হালাল নয়,কিন্তু শুধু তাই হালাল যা সে তার ভাইকে সন্তুষ্ট চিত্তে প্রদান করে। অতএব তোমরা একে অপরের প্রতি যুলুম করবে না।
(ঙ) সাহাবি হযরত নু’মান বিন বশীর(রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তুমি ঈমানদারদেরকে তাদের পারস্পরিক দয়া,বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতার ক্ষেত্রে একটি দেহের মত দখবে, যদি দেহের কোন একটি অঙ্গ ব্যথা পায় তখন গোটা শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ এর কারণে জাগরণ ও জ্বরে তার ব্যথায় সহ -অংশীদার হয়।
(চ) তিনি আরো বর্ণনা করেন,রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, সকল মু’মিন এক অখন্ড ব্যক্তির মতো যদি কোন ব্যক্তির চক্ষু ব্যথা হয়, তবে তার সর্বাঙ্গ ব্যথিত হয়, আর যদি তার মাথা ব্যথা হয়, তখন তার সারা শরীর ব্যথিত হয়। – (মুসলিম)
(ছ) আবু মুসা (রা) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, এক মু’মিন অপর মু’মিনের জন্য প্রাচীর বা ইমারতের মতো, যার একাংশ অপরাংশকে সুদৃঢ় করে।এটা বলে রাসূলুল্লাহ (সা) এক হাতের আঙ্গুলি অপর হাতের আঙ্গুলির মধ্যে প্রবেশ করালেন।(বুখারী ও মুসলিম)
আলোচিত হাদীসগুলো থেকে মোটামুটিভাবে আমরা মু’মিন- মুসলিমগণ যেই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি তা হলো:
১। মুসলমানগণ একে অপরের ভাই। তারা ইসলামি ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ।
২। মুসলমানগণ বিপদে আপদে একে অপরকে সাহায্য করবে।
৩।একে অপরের প্রতি কোন প্রকার অত্যাচার করবে না।
৪। জীবন, সম্পদ ও মান-মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদশর্ন করবে।
৫। একে অপরের প্রয়োজন মিটাবে।
৬। পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করে দেবে না।
৭। বিশ্বের সমস্ত মুসলিম একটি দেহ সাদৃশ্য।সুতরাং যেখানেই আক্রান্ত হোক না কেন সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা আবশ্যক।
৮। গোটা বিশ্বের ইসলামি সমাজের ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় থাকতে হবে।
৯। মু’মিনদের পারস্পরিক সম্পর্ককে বাতিল কোন শক্তি ছিন্ন করতে অক্ষম।
আমাদের আবেদন, সাম্প্রতিক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুদ্ধ- বিগ্রহসহ মারামারি – হানাহানি ও জাতিগত নিধন বিশেষত: মুসলিম নিধন ক্ষেত্রে মুসলমানদের সুরক্ষা দানে বিশ্ব মুসলিম নেতৃবৃন্দের উচিত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নীতির অনূসরণ করা। গোটা মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তন,মায়ানমার(বার্মা) এবং অপরাপর দেশের নির্যাতিত, বাস্তুহারা মুসলিমদের মানবাধিকার নিয়ে কার্যকর ভূমিকা পালনই হবে ‘ইসলামি ভ্রাতৃত্বের নমুনা বিশেষ।কার্যত: ইসলামি ভ্রাতৃত্ব অন্যায় ও অত্যাচারকে ঘৃণা করে এবং সাহায্য-সহযোগিতার প্রতি উৎসাহ প্রদান করে।ইসলাম হলো ভ্রাতৃত্বের ধর্ম।আর এ ভ্রাতৃত্ব মানুষের জীবনে ধনসম্পদে ও ইজ্জত সম্মানে শান্তি ও নিরাপত্তা কামনা করে।
মূলত: ভ্রাতৃত্বের ক্ষেত্রে মানুষ সকলেই সমান। চাই সে আফ্রিকী,হোক বা ইউরোপীয় কিংবা এশিয়, আমেরিকী, সাদা বা কালো,আরব হোক অনারব। তাতে ভৌগোলিক ও বর্ণালী পার্থক্য ধর্তব্য নয়। ইসলাম ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধকে ইসলামি রাষ্ট্রের মূলভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। বস্তুত ইসলামি ভ্রাতৃত্ববোধ হলো প্রভুপ্রদ বিশেষ দান। আর তিনি একে মুসলিম জাতি গঠনের মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এবং আল্লাহ তা’আলা এর দ্বারা তাঁর নবীকে ও মু’মিনগণকে সুদৃঢ় করেছেন।যেমন আল্লাহ তা’আলা সূরা আলে-ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতাংশে এরশাদ করেন: ” তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনূগ্রহ স্মরণ কর; তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সণ্চার করেন, ফলে তাঁর অনূগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে।”

মুহাম্মদ ওমর হামজা
অধ্যক্ষ (অবসরপ্রাপ্ত)
খুটাখালী তমিজিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা
২২/১১/২০২৪ খ্রীঃ, মোতাবিক ১৯/০৫/১৪৪৬হিঃ।