জে. জাহেদ, চট্টগ্রাম:

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী হলো এই বন্দর নগরীর অর্থনীতির চালিকাশক্তি। দূষণে এ নদীকে ধীরে ধীরে গলাটিপে মেরে ফেলা হচ্ছে বলে পরিবেশবাদীদের জোর দাবি। নদীর দূষণরোধে শিল্প কলকারখানায় ইটিপি স্থাপনের তাগিদ সরকার প্রধানের।

কেননা, কর্ণফুলী নদী মরলে চট্টগ্রামও মরবে। এমনকি নদী সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, প্রধানমন্ত্রীর কড়া বার্তার পরে কর্ণফুলীর দখল ও দূষণমুক্ত করার কার্যক্রমে গতি আসবে। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে নদীতে পলি জমে কর্ণফুলী নদীর বুকে চর জেগেছে। ফলে, জাহাজ চলাচলে হুমকির মুখে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল।

আর বহাল তবিয়তে এখনো দুই পাড়ে রয়ে গেছে দুই হাজার অবৈধ স্থাপনা। প্রতিনিয়ত কলকারখানার রাসায়নিক ও গৃহস্থালির বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলী নদী নানামুখী দখল আর দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে মরতে বসেছে।

রাসায়নিক দূষণ থেকে নদীকে রক্ষায় শিল্প কারখানায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব নেই কারো। এ ছাড়া দূষণ বহুগুণ বাড়াচ্ছে ৬০ লাখ নগরবাসীর গৃহস্থালির বর্জ্য। নদীটিকে বাঁচাতে যে রূপ জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখা দরকার, ততটা নেই তাঁদেরও। দু’পাড়ের অনেকেই বলেছেন, উচ্ছেদ করে লাভ কী পরে যদি আবারো দখল করে।
হাইকোর্টের নির্দেশের পরও নানা সংস্থার গাফিলতির কারণে দুষলেন শহরকুলের মানুষ।

কর্ণফুলী নদী দুপাড়ে গড়ে উঠা নানা কলকারখানা, প্রতিষ্ঠান ও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীর আগ্রাসী থাবায় নদী আজ বিপর্যস্ত। কর্ণফুলী নদীর দুপাড়ে চোখ মেলে তাকালেই দখলবাজির চিত্র স্পষ্ট দেখা যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, নদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির সম্মুখীন। চট্টগ্রামের অনেক শাখা নদী ইতোমধ্যেই হারিয়ে গেছে। দখল ও দূষণের কারণে বিলুপ্ত হওয়ার পথে কর্ণফুলী। পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই এটা ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ।

পরিবেশ সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনগুলো, একেবারে শীর্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের পদাধিকারীরা নানা কথা বলে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আদালতের নির্দেশেও খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ১১ ধরনের ক্ষতিকর ধাতুর দেখা মিলেছে।

গবেষণায় যে-সব নদী, হ্রদ বা খালের দূষণের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বংশী, ধলাই বিল, মেঘনা, সুরমা, কর্ণফুলী, হালদা, খিরু, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা, পশুর, সাঙ্গু, কাপ্তাই লেক, মাতামুহুরী, নাফ, বাকখালি,
কাসালং, চিংড়ি, ভৈরব, ময়ূর, রাজখালি খাল। আর এসব জলাধারের পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক, কপার, আয়রন, লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কার্বন মনোক্সাইড ও মার্কারির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, গত ৪০ বছরে চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। নদীগুলো যে দখলই হচ্ছে তা নয়, শিল্পবর্জ্যের ভারী ধাতু পানিতে মিশে নদীর তলদেশে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে নদীর পানিতে ক্ষতিকর ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যায়।

সবশেষে দেশে নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে ২০১৯ সালে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)। প্রায় চার বছর কাজ শেষে গত ১০ আগস্ট সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ৯০৭টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়। এ সংখ্যা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন নদী গবেষকরা। এমনকি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত নদ-নদীর তথ্যের সঙ্গেও এনআরসিসির খসড়ার তথ্য মিলছে না।

এদিকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদী নিয়ে ২০১১ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ নিয়ে ছয় খণ্ডের বইও প্রকাশ করেছিল সংস্থাটি। ওই ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে ১৩৯টিই এনআরসিসির খসড়া থেকে বাদ পড়েছে। ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ নামে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত ওই সিরিজের সঙ্গে এনআরসিসির খসড়া তালিকার নদ-নদীর তথ্যে ব্যাপক গরমিল আছে বলে দাবি করেছে নদীবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)।

সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, পাউবোর সমীক্ষার অন্তত ১৩৯টি নদীর নাম এনআরসিসির খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এরমধ্যে সিলেট বিভাগের আমরি, ইসদার, উমিয়াম, কর্ণঝরা, কর্ণবালজা, কাঁচামাটিয়াসহ ২৭ নদীর নাম তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি। একইভাবে রাজশাহী বিভাগের ১৬, রংপুরের ১০, ময়মনসিংহের ২৭, বরিশালের সাত, ঢাকার ৩০, চট্টগ্রামের ১২ ও খুলনা বিভাগের ১০টি নদী তালিকাভুক্ত করেনি এনআরসিসি।

উপর্যুক্ত তথ্যে খুবই সহজেই অনুমেয় কী হচ্ছে নদী নিয়ে। আসলেই কি দেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য কাজ করা হচ্ছে টেকসই উন্নয়নে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। গবেষণায় জানা যায়, ২০০৯ সালে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহৃত হয়েছে ৬৮ বিলিয়ন টন। ২০৫০ সালে ব্যবহৃত হবে ১৪০ বিলিয়ন টন, যা পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট করবে।

বাংলাদেশে আবাসন ও মানুষের কারণে ২০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি, ৩০ শতাংশ বনভূমি এবং ১০ শতাংশ চারণভূমি হারিয়ে গেছে। শিল্পায়নের কারণে প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষিজমি কমছে। জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। অর্ধেকেরও বেশি নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলো দখলে বিপর্যস্ত। টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি আমাদের প্রয়োজন, সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে নদীকে তার হারানো গৌরব ও যৌবন ফিরিয়ে দিতে হবে। কেননা, নদী আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।

নদী দখল, নদী দূষণসহ যখন যেভাবে প্রয়োজন, তখন সেভাবেই নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিটি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি রয়েছে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে। তাদের কাজ কী তারা আসলে কী করে নদী ভরাট ও অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে সবাইকে নিয়ে কাজ করছে এই কমিটি, নদী খননের প্রশাসনিক কার্যাদি সম্পাদন ও নদী রক্ষায় নানা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজও করছে এ কমিটি। কিন্তু শুধু জেলা প্রশাসন অথবা পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী বাঁচাতে পারবে না। ডিসিদেরও সরকারসহ উচ্চাদালত থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও তাদের নীরব ভূমিকা দেখা গেছে।

এক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের ক্ষমতাসীন দলের নেতাদেরও অন্যতম ভূমিকা রয়েছে। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারকে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পগুলোর কাজের গতি ত্বরান্বিত করতে হবে। আবার এসব কাজের জবাবদিহি বাড়াতে হবে। দেশের নদী রক্ষা, জলাশয় ও খাস সম্পত্তি সংরক্ষণ এবং নদী দখল রোধে সরকার ও উচ্চাদালতের কঠোর নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ডিসিরা তা মানছেন না।

আদালতের নির্দেশনার পাশাপাশি জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার্যাবলি-২০১১ প্রজ্ঞাপনের ১৫ দফায় সম্পত্তি অধিগ্রহণ এবং হুকুম দখলের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে ডিসিদের ওপর। নদী ও জলাশয়ে রয়েছে অনেক সম্পদ। আমাদের অসচেতনতার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। জীবনধারণের স্থান ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। পরিবেশ রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজ উদ্যোগে, নিজের স্বার্থে নদীকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সবাই সচেতন না হলে শুধু আইন প্রয়োগে খুব বেশি সফলতা আসবে না।

এ ব্যাপারে নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি আলিউর রহমান বলেন, ‘কর্ণফুলী হচ্ছে দেশের অর্থনীতির সঞ্চালক। দেশের অর্থনীতির ৯২ শতাংশ খাত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্ণফুলীর ওপরে নির্ভরশীল। কিন্তু অতি দূষণে ৩৫ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির পাশাপাশি ইতোমধ্যে কর্ণফুলী নদীর প্রশস্ততা কমেছে প্রায় ৫০০ মিটার। ভরে গেছে ২০ শতাংশ নদীর তলদেশ।

চট্টগ্রামের পরিবেশবাদী লেখক দয়াল কুমার বড়ুয়া বলেন, কর্ণফুলী নদীকে ঘিরে চট্টগ্রামের ইতিহাস। কর্ণফুলী নদী চট্টগ্রামের হৃৎপিণ্ড। এই নদী বাঁচলে চট্টগ্রাম বাঁচবে। কর্ণফুলী নদী মরলে চট্টগ্রামও মরবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই বলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনেরও দাবি।

বিশিষ্ট পরিবেশ গবেষক ড. ইদ্রিস আলী বারবার বলছেন, মানুষ যেমন হৃৎপিণ্ড না থাকলে বাঁচে না, তেমনি নদী না থাকলে দেশও বাঁচানো সম্ভব নয়। যেভাবে নদী মরছে, আর যেভাবে নদীগুলো কাঁদছে, তাতে একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে দেশ। একটি দেশকে বাঁচাতে হলে এবং টেকসই উন্নয়ন করতে হলে নদীগুলো সংরক্ষণ করার বিকল্প নেই।