সিবিএন ডেস্ক:
বাড়ির পাশে নীরবে শুয়ে আছে আবরার। প্রতিদিন ছেলের কবরের পাশে ছুটে যান আবরারে মা। ডুকরে ডুকরে কাঁদেন। কারো পায়ের শব্দ পেলেই আঁচলে মুখ ঢাকেন। বাড়িতে ফিরে আনমনা থাকেন। কাজকর্মে মনোযোগী হতে পারেন না। এই বুঝি মা বলে ডাক দিলো আবরার!

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর শিবিরের তকমা লাগিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ রাব্বীকে (২২) ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। কষ্টের পাথর বুকে নিয়ে এভাবেই কেটে গেল মা রোকেয়া খাতুনের দুটি বছর।

ছেলের স্মৃতি তাকে তাড়া করে বেড়ায়। প্রতিটি ক্ষণই তার কাছে অসহ্য মনে হয়। এক মুহূর্তের জন্যও প্রিয় সন্তানকে ভুলে থাকতে পারেন না। ছেলে হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খায় তাকে।

আবরারের জন্মের সময়ের কথা স্পষ্টই মনে আছে রোকেয়া খাতুনের। যেদিন তার জন্ম হয়েছিল- সেদিন চারিদিকে হইচই পড়ে যায়। ‘পুত্র সন্তানের মা হয়েছেন রোকেয়া।’ এমন কথা হাসি মুখে গর্ব করে অনেকেই বলেছিল।

আবরারের দাদা বলতেন, ‘বউমা তোমার ছেলে একদিন অনেক বড় হবে।’ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সেসব কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন রোকেয়া খাতুন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘তার দাদার কথাই সত্যি হয়েছে। আবরার অনেক বড় হয়েছে। ওকে সবাই চেনে। সে এখন এলাকাবাসীর গর্ব। কিন্তু আমার বুক খালি। এই বুকের হাহাকার কে মেটাবে? আবরারকে তো ওরা মেরে ফেলেছে। সেদিন আবরারের সঙ্গে আমাকেও যদি মেরে ফেলতো তারা, তাহলে মুক্তি পেতাম। এত কষ্ট আর সইতে পারি না। এমন ছেলেকে হারিয়ে কে ভালো থাকতে পারে?’

অবদমিত কান্না চেপে রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘দেখতে দেখতে দুই বছর হয়ে গেলো আবরারকে হারিয়েছি। সন্তান যদি এভাবে মারা যায় তাহলে কোনো মা সহ্য করতে পারে? তারপরও বুকে কষ্ট চেপে নিয়ে কোনো রকমে চলছি। ওর কথা তো একটা সেকেন্ডের জন্যও ভুলতে পারি না। বাবা-মায়ের কাছে সবচেয়ে ভারী বোঝা সন্তানের লাশ। সেই ভার বুকে নিয়ে নিয়েই বেঁচে আছি। এই বেঁচে থাকার মতো কষ্ট আর কী হতে পারে?’

তিনি বলেন, ‘ওরা ওকে এত নিষ্ঠুরভাবে মেরেছে! সে কথা মনে পড়লে বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয় না। ওর ছোট ভাই আবরার ফায়াজ বলে— আম্মু তুমি আর আব্বু ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই। তখন কিছু বলতে পারি না। ফায়াজের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিল ওর ভাই। আমাদের সব শেষ হয়ে গেলো। ওরা যদি আবরারের একটা হাত বা পা কেটে ফেলতো, তাও তো সে বেঁচে থাকতো। আমার সন্তান আমার সামনে থাকতো।’

রোকেয়া খাতুন বলেন, ‘আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। আমার মতো সন্তান হারানো এক মায়ের কষ্ট ওরা কীভাবে বুঝবে? এত কিছুর পরও আমার মনে হয়, আবরার আবার আমার কাছে ফিরে আসবে। পরক্ষণেই যখন মনে পড়ে সে তো মারা গেছে। তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। ওদের (আসামি) কাছে আমার জানতে ইচ্ছে হয়, ওরা কেন আমার ছেলেকে হত্যা করেছে? তিলে তিলে কষ্ট দিয়ে ওরা আমার ছেলেকে হত‌্যা করেছে। কোনো মা এই কষ্ট কীভাবে সহ‌্য করবে? আল্লাহর কাছে প্রার্থণা করি, জান্নাতে যেন আমার ছেলের সঙ্গে আল্লাহ আমাকে দেখা করিয়ে দেন।’

আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ‘সমস্ত জাতি দেখেছে কীভাবে আমার সন্তানকে ওরা নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে। দুই বছর পার হয়ে গেলো। এখন মনে হয় সব জায়গায় পিছিয়ে যাচ্ছি। মামলার বিচার কিছু পিছিয়ে গেছে। সরকারের কাছে ন‌্যায় বিচার প্রত‌্যাশা করি। আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হোক সেটাই একমাত্র চাওয়া।’

তিনি বলেন, ‘যত দিন যাচ্ছে, ছেলের কথা তত বেশি মনে পড়ছে। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! করোনার কারণে দুই দফায় আদালত বন্ধ ছিল। এখন আবার বিচারক করোনায় আক্রান্ত। যাই হোক, এখন যেন বিচার কাজ বিলম্ব না হয় সেই প্রত্যাশা করছি।’

ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালতে আবরার হত‌্যার মামলাটি বিচারাধীন। আগামি ২০ অক্টোবর মামলাটি রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ধার্য রয়েছে।

উল্লেখ‌্য, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলার সিড়ি থেকে অচেতন অবস্থায় আবরার ফাহাদকে উদ্ধার করা হয়। দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওই রাতে হলের ২০১১ নম্বর কক্ষে আবরার ফাহাদকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ।

২০২০ সালের ১৩ নভেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ওয়াহিদুজ্জামান ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২৫ আসামির বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত। মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আত্মপক্ষ শুনানি হয়। কয়েকজন আসামি নিজেদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্যও দেন। এখন মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে রয়েছে।

আবরার বুয়েটের তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭ ব্যাচ) শিক্ষার্থী ছিলেন।