ডেস্ক নিউজ:

পৃথিবীতে দুই ধরণের মানুষ রয়েছে। এক ধরণের মানুষ কারও দ্বারা অপমানের শিকার হলেই খুব সহজে ভেঙে পড়ে এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। অন্য শ্রেণীর মানুষেরা অপমানকে নতুন কিছু করার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে নেয়, অপমানের জ্বালানিকে কাজে লাগিয়েই সাফল্যের নতুন সিঁড়ি গড়ে তোলে। বলাই বাহুল্য, পৃথিবীতে দ্বিতীয় শ্রেণীর মানুষের তুলনায় প্রথম শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা ঢের বেশি। সেজন্যই তো, সব মানুষ জীবনে সফলতা অর্জন করতে পারে না। কেউ কেউ পারে পারে। আজ আপনাদেরকে বলব সেরকমই একজন মানুষের গল্প, যিনি আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত অপমানিত হয়েও হাল ছেড়ে দেননি, বরং এমন কিছু করে দেখিয়েছেন যাতে ওইসব নিন্দুকদের মুখেই চুনকালি পড়েছে।

তার নাম সত্যপাল চন্দ্র। সে জন্মগ্রহণ করেছিল বিহারের এক প্রান্তিক গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। গ্রামটি বরাবরই ছিল নকশাল আর উগ্রবাদীদের আখড়া। কোন বাবা-মাই চাইবেন না তাদের সন্তান এমন একটা পরিবেশে বেড়ে উঠুক। তাই সত্যপালের বাবা-মাও তাকে পড়াশোনা করতে ঝাড়খন্ডে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে খুবই শোচনীয় অবস্থায় দিন কাটতে থাকে সত্যপালের। শুধু স্কুলে যেত আর স্কুল শেষে বাসায় ফিরে আসত সে। অন্য ছেলেদের মত স্কুল থেকে বেরিয়ে এটা-ওটা কেনার সামর্থ্য তার ছিল না। এবং তার বাবা-মায়ের আর্থিক অসঙ্গতির কথা খুব ভালোভাবেই জানত সে। এজন্যই মুখ ফুটে তাদের কাছে কখনও টাকা-পয়সা চাইতেও পারত না।

অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করতে হয়েছে সত্যপালকে। কিন্তু তার মধ্যে রোখ চেপে গিয়েছিল যে ভালো করে লেখাপড়া করে তাদের দুঃসময়কে যে করেই হোক পিছনে ফেলতে হবে। খুব ভালো ফলাফল নিয়েই গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে সে। আর তারপর একটা বেশ ভালো কোম্পানিতে চাকরিও জুটে যায় তার। সেখানে চাকরির সুবাদে আর্থিক অবস্থার ক্রমশ উন্নতি হতে থাকে তার। কিন্তু সে জানত না যে টাকাপয়সাই জীবনের সব কিছু নয়। অঢেল টাকাপয়সা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে মানুষের পরিহাসের পাত্র হওয়ার সুযোগ থাকে।

যেমন একবার বেতন পেয়ে সত্যপাল ঠিক করল বড় রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে। বেছে বেছে শহরের সবচেয়ে দামি রেস্টুরেন্টটাতেই যাওয়া মনস্থির করল সে। তার পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকায় বেশ নিশ্চিন্ত ও উৎফুল্লই বোধ করছিল সে। কিন্তু এ ধরণের বড় রেস্টুরেন্টে আগে কোনদিন আসার অভিজ্ঞতা না থাকায়, সেখানকার আচার-ব্যবহার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তার। ওয়েটার যখন তার কাছে অর্ডার নিতে আসল, সাধারণ আর দশটা রেস্টুরেন্টে সে যেভাবে হিন্দিতে খাবারের অর্ডার করে থাকে, এখানেও ঠিক সেটাই করতে শুরু করল। কিন্তু হঠাতই সে ওয়েটারের মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেখতে পেল। নিয়মিত এলিট শ্রেণীর মানুষদের কাছ থেকে দেখা ওয়েটার সত্যপালের কথাবার্তায় বুঝে ফেলেছে যে হয় সে এমন জায়গায় আগে আর আসেনি, নয়ত ইংরেজি ভাষাটা সে জানেই না। আর সেজন্যই তাকে নিয়ে এমন বিদ্রুপাত্মক হাসি।

প্রথমে সত্যপাল বিষয়টাকে খুব একটা পাত্তা দিল না। কিন্তু সেদিন রাতে বাসায় ফিরে সে টের পেল, অবচেতন মনে সে সারাক্ষণ রেস্টুরেন্টের ওই ঘটনাটাই চিন্তা করে চলেছে। সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করে কাটাল সে, ঠিক মত ঘুমাতে পর্যন্ত পারল না। এখানেই শেষ নয়। পরবর্তী কয়েক মাসে সে এধরণের আরও অনেকগুলো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলো। এলিট শ্রেণীর মানুষদের সাথে চলার মত এটিকেট ও ইংরেজি জ্ঞান না থাকায় সে পদে পদে হেনস্তা হতে লাগল। এবং তাকে যে অন্যরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, সেটাও সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিল।

মানসিক চাপে একদম যেন জর্জরিত হয়ে গেল সত্যপাল। সে তখন ভাবছিল, এত কষ্ট করে লেখাপড়া করে এত বড় একটা কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে কী লাভ হলো? মানুষের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো অন্যের কাছ থেকে শ্রদ্ধা অর্জন। আর সেটাই সে পাচ্ছে না। কিন্তু তারপরও সে হাল ছেড়ে দিল না। সে ঠিক করল, যেভাবেই হোক, ইংরেজিতে কথা বলায় দক্ষ হয়ে উঠবে সে। পাশাপাশি এলিট শ্রেণীর মানুষদের সাথে ওঠাবসার জন্য প্রয়োজনীয় এটিকেটও যত দ্রুত সম্ভব আত্মস্থ করে ফেলবে।

এখন স্বাভাবিকভাবেই পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সত্যপাল কি সফল হয়েছিল? সে যে শুধু সফলই হয়েছিল তা বললে অনেক কম বলা হবে। সে তার ইংরেজি জ্ঞানকে এতটাই নিখুঁত করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল যে ২০১১ সালে, ২৪ বছর বয়সে সে তার প্রথম উপন্যাস গ্রন্থ প্রকাশ করে, যেটি ইংরেজি ভাষায় রচিত! ‘দ্য মোস্ট এলিজিবল ব্যাচেলর’ নামের সেই উপন্যাসটিতে ধর্ম, সন্ত্রাসবাদ আর ভালোবাসার কথা উঠে এসেছিল, এবং তা পাঠকদের মাঝে এমন সাড়া জাগায় যে খুব অল্প সময়ের মাঝেই সেটি বেস্ট সেলারে পরিণত হয়। এর পরের বছরই সে একটা-দুইটা না, ছয়টা উপন্যাস লিখে ফেলে! এবং সেগুলোর প্রতিটাই কমবেশি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। ফলে সত্যপাল পরিণত হয় ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় ইংরেজি লেখকে। যেই মানুষেরা এক সময়ে তাকে নিয়ে উপহাস করত, এখন তারাই তার পেছন পেছন ঘোরে একটা অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য, কিংবা তার সাথে একটা সেলফি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করার জন্য।

সত্যপালের জীবনকাহিনীর শুরুর সাথে অনেকেই হয়ত নিজেদের জীবনকে মেলাতে পারবেন। এমন অনেকেই আছেন যারা একাডেমিকভাবে অনেক ভালো ফলাফল করে চাকরিজীবনে প্রবেশ করেছেন, কিন্তু পরবর্তীতে অন্য সবার সাথে তাল মেলাতে না পেরে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। আর সেখান থেকে শুরু হয়েছে নিজের প্রতি হীনম্মন্যতা ও আত্মবিশ্বাসহীনতা। কিন্তু সত্যপালের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে সে কিন্তু হাত গুটিয়ে নেয়নি, বরং নিজের চেষ্টায় সে তার দুর্বলতার জায়গাটাকে সবচেয়ে বড় শক্তিমত্তার জায়গায় রূপান্তরিত করেছে। তাই কারও অপমানে ভেঙে পড়া নয়, বরং সেই অপমানের কীভাবে দাঁতভাঙা জবাব দেয়া যায়, সেজন্যই নিরন্তর কাজ করে যেতে হবে সবাইকে।