ডেস্ক নিউজ:
চট্টগ্রামের কিংবদন্তি আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী। তারা দুজনই ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। কেবল চট্টগ্রাম নয়, তারা বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের মৃত্যুর পর চট্টগ্রামের গণমানুষের নেতা হিসেবে আর কোন রাজনৈতিক নেতা গড়ে উঠেনি।

তবে এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে যিনি চট্টল বীর উপাধীর পাশাপাশি চট্টগ্রামের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন তিনি হলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী।

৭৪ বছর বয়সী মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে। তবে তার দোর্দণ্ড প্রতাপের কাহিনী শুরু ১৯৯৩ সালে। সে সময় বিএনপি ক্ষমতায় থাকলেও আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর ইশারাতেই চলতো চট্টগ্রাম। ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি টানা তিন দফা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। এখন তিনি চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি।

১৯৪৪ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্ম নেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ছোটবেলা থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ঊনসত্তর সালে পালন করেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই সান্নিধ্যে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন পাকিস্তান নৌবাহিনীর হাতে। সে সময় অমানবিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। সে ক্ষত আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে তার নিরলস কাজ করার কথা এখনও অনেকেই স্মরণ করেন।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর জীবনে রয়েছে নানা সংগ্রামী ঘটনা। নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। জীবনের তাগিদে তাকে করতে হয়েছে রেডিও মেকানিকের কাজও। সেই তিনি আবার চট্টগ্রামের লালদীঘিতে যখন হাজির হন তখন তার জ্বালাময়ী বক্তব্য শোনার জন্য হাজার হাজার মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মহিউদ্দিন চৌধুরী রাজনৈতিক জীবনে অনেকবারই কারাগারে গেছেন। ওয়ান ইলেভেনের সময়ও তাকে যেতে হয়েছিল কারাগারে। সেই সময় তার কন্যা ফৌজিয়া সুলতানা টুম্পার মৃত্যু তাকে ভীষণ রকম আবেগতাড়িত করে। ফেলে দেয় জীবনের মানবিকতার পরীক্ষায়। সেই পরীক্ষা এখনও মোকাবিলা করছেন তিনি। মেয়র থাকা অবস্থায় যখন যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, চট্টগ্রামের স্বার্থে আন্দোলন প্রতিরোধ গড়ে তোলতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করেননি তিনি।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সময়ে তিনি চট্টগ্রাম বন্দরসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে একাধিকবার আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। ২০১০ সালে তিনি বিএনপির প্রার্থী এম. মঞ্জুরুল আলমের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মেয়র নির্বাচনে পরাজয় বরণ করলেও জনগণ থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। শরীরের নানা রোগ-ব্যাধিকে উপেক্ষা করে অসীম সাহস, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত আর জনগণের সুখ-দুঃখে পাশে থাকার মাধ্যমে তিনি সকল শ্রেণি পেশার মানুষের আপনজনে পরিণত হয়েছেন। বর্তমান চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বেও রয়েছেন। তারপরও নগরবাসীর স্বার্থবিরোধী যে কোন কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়রের কঠোর সমালোচনাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামে গৃহকর বৃদ্ধি নিয়ে তিনি সম্প্রতি সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। যে আন্দোলন এখনো অব্যাহত রয়েছে। এভাবে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের অভিভাবকের আসনে অধিষ্ঠিত হন।

তার পারিবারিক সূত্র জানায়, প্রতিদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। এরপর ফজরের নামাজ আদায় করেন। তারপর সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে তার ড্রংই রুমে ভিড় করতে থাকেন অনেকে। একেকজনের একেক সমস্যা। সবার কথা শোনেন তিনি। তারপর সমাধানের রাস্তা বের করেন একসঙ্গে বসে। কাউকে হতাশ হতে নিষেধ করেন। তবে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী এই নেতাকে রাজনীতি করতে গিয়ে কম ধাক্কা সহ্য করতে হয়নি। স্বার্থের জন্য অনেক কর্মীও তাকে ছেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতেও কখনও পথ হারাননি মহিউদ্দিন। জনতার কাতারে ছিলেন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে চট্টগ্রামের ম্যাক্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।