নাহিদ শারমীন
জর্জিয়া, আমেরিকা।

জীবন একটি পদ্ম পাতার শিশির বিন্দুর মতন আজ আছে, কাল কি হবে জানি না। মানুষের জীবন ক্ষুদ্র এবং ক্ষনস্থায়ী। এক জীবনের অপূর্ণ সখ গুলো যদি সাধ্যের মধ্যে থাকে সেটি পুরন করে নেয়াই উত্তম কাজ। তাহলে মনের কোনে আফসোস থাকে না। আমি আমার জীবনে অনেক কিছুই না চাইতে পেয়েছি। অন‍্যদিকে খুব সাধারণ কিছু জিনিষ চেয়েছি কিন্তু পাইনি। আমি কখনো বড় কিছু পেয়ে ছোট কোন বিষয়কে তুচ্ছ মনে করি না। সেরকম কক্সবাজারের সমুদ্র পরিদর্শন আমার জীবনের একটি অপূর্ন শখ ছিল। সময় সুযোগ পেলাম তাই দীর্ঘ ৩৭ বছর পর বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর দেখতে কক্সবাজার ছুটে গেলাম। এই ভ্রমণটি ছিল, আমার অতীতের একটি অসমাপ্ত গল্পের সখ পুরন করা।

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ঢাকায় এলে নানা বেড়াজালে আটকে যাই কোনকিছু প্লান করা সম্ভব হয়না। তাই এবার সবকিছু পরিকল্পনা দেশে যাবার পূর্বেই সম্পন্ন করেছিলাম। বাংলাদেশ এমনেতেই সব কিছু খুব ধীর গতিতে চলে। কেউ পূর্বের থেকে কোন পরিকল্পনা করতে পারে না। ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি আবহাওয়াটা সুন্দর থাকে, সেকারনে কক্সবাজার ভ্রমণের ইচ্ছা পোষন করলাম।

বর্তমানে পুরো পৃথিবীটাই একটি দেশ। আধুনিক প্রযুক্তির কারনে যে কোন দেশ ভ্রমণে যাবার জন্য ঘরে বসেই অনলাইনে টিকেট ক্রয় বা হোটেল বুকিং করা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে যাবার পূর্বেই অনলাইনে প্লেনের টিকেট এবং হোটেল বুকিং শেষ করে ফেললাম। জাষ্ট ক্লিক ক্লিক করে ইউএস-বাংলা এয়ারওয়েজ এবং সায়মন বিচ হোটেল এন্ড রিসোর্ট বুকিং ডান হয়ে গেলো। সেখানে মাত্র দুই রাত থাকবো, এটাই পরিকল্পনা ছিল।

প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু ভাল লাগা মন্দ লাগা আছে। সমুদ্র আমার ভালবাসা। বাংলাদেশ থেকে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে আমেরিকা এসেও প্রতি বছর আমাকে সমুদ্রের নোনা জল দেখতে যেতেই হয়। আমি শেষবার কক্সবাজার গিয়েছিলাম ১৯৮৮ সালে।
ইতোমধ্যে, দীর্ঘ সাতত্রিশ বছর ব‍্যবধানে
পদ্মা মেঘনা যমুনার পানি অনেক দূরে এগিয়ে গিয়েছে। সেইসাথে বঙ্গোপসাগরের অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

তিন যুগ আগে আমার বয়স কুড়ির কোটায় ছিল। চোখে আমার রঙ্গীন স্বপ্ন, যা দেখি তাতেই মুগ্ধ হয়ে যাই। তবে সে সময় আমার সীমানাটি খুব বেশী বিস্তৃত ছিল না। সমুদ্র বলতে তখন শুধু বঙ্গোপসাগরই দেখেছিলাম। সমুদ্রের যে জাতকুল আছে এসব তথ‍্য আমার অজানা ছিল। প্রতিটি সমুদ্রের আলাদা নাম থাকে এবং এর পিছনে গল্প থাকে।
সমুদ্রকে সাগর, উপসাগর, মহাসাগর এসব শ্রেনী বিভাগে বিভক্ত করা হয়।

“জলের কাছে আছে
জলের গভীর পরিচয়
সমুদ্র তাই ঐক‍্যবদ্ধ
পাহাড় তত নয়।

২০২৪ সাল, পর্যন্ত যে কোন সমুদ্র দেখে আমার মনে তৃপ্তি আসতো না। সব সময়ই অন‍্য সমুদ্রের সাথে বঙ্গোপসাগরের তুলনা করতাম। মনে মনে বলতাম,
-নাহ! এটিও কক্সবাজারের মতন নয়।
ঐ যে কিশোরী বয়সের ভাললাগা মনে আটকে গিয়েছিল। বঙ্গোপসাগর ভৌগলিক অবস্হানের জন্য সূর্য‍্যাস্তের দৃশ‍্যটা সত্যিই অসাধারন ছিল এবং এখনো আছে। এছাড়া সমতল এবং দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এটিও প্রমানিত। এতো সমতল এবং লম্বা সৈকত আমি অন‍্য কোথাও দেখিনি। ঢেউ গুলো যখন কুলের দিকে এগিয়ে আসে তখন যেদিকে চোখ যায় সেদিকে দেখা যায় লম্বা একটি ঢেউ এগিয়ে আসছে।

আমার কিশোরী বয়সে বঙ্গোপসাগরের ঢেউ দেখে মনে হতো কি বিশাল!!
ঢেউ গুলো যখন দূর থেকে কূলের দিকে এগিয়ে আসতো , তখন এক অবাক বিস্ময়ে পলকহীন চোখে মূর্তির মতন তাকিয়ে থাকতাম। রীতিমতন ভয় পেয়ে যেতাম। অন‍্যদিকে, মনের কোনে একটু ক্ষীন আকাঙ্ক্ষা ছিল, একটি উথাল পাথাল পাগলা ঢেউ এসে বালুকা বেলায় আমার পা দুটো ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। পরবর্তী ঢেউ এর জন‍্য প্রতিক্ষায় থেকে ভাবছি এবারের এই ঢেউটি যেনো আগের চেয়ে আর একটু বড় হয়। এই ঢেউটি এসে আমার শরীর ভিজিয়ে আমাকে সিক্ত করে দিবে। জেনেশুনে নিজের গায়ে নোনা পানি এবং বালুর স্পর্শ মেনে নিতাম।

তখন মনে ছিল না কোন সংকোচ এবং ভয়। শরীরে বা চুলে বালু গেলে যে সেটা পরিষ্কার করতে অনেক সময় লাগবে সেটাও মাথায় ছিল না। শরীর ভিজে গেলে শরীরও যে দেখা যেতে পারে সেটারও কোন ভাবান্তর ছিল না। তখন শরীরে আব্রু বা পর্দার কোন বালাই ছিল না। আমার মনে আছে, ওড়না ভিজে যাবে দেখে কাকে যেনো আমার ওড়নাটি দিয়ে পানিতে নেমে গিয়েছিলাম। শরীর ভিজলে ভিজুক তবে ওড়না যেনো না ভিজে। এরকম বোকা মেয়ে কি আর হয়? সে সময় মনের স্বাদ মিটিয়ে বন্ধুরা মিলে পানিতে খেলা করেছি, ঝাউবনে লুকোচুরি করেছি।
তবে কিছু কিছু ঘটনা ছোট গল্পের মতন থেকে যায়।
-শেষ হইয়াও শেষ হইলো না।

আমি ১৯৮৮ সালে কক্সবাজার প্রত্যাবর্তনের সময় প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলাম, বিয়ের পর নব দম্পতি হানিমুনে বালুকা বেলায় আসবো। তবে আমার শখটি অপূর্ন ছিল।

আমার পরিকল্পনা এক ধরনের ছিল, তবে বিধাতার পরিকল্পনা অনেক বৃহৎ ছিল। তিনি আমার জন্য অনেক বড় কিছু দেখার সুযোগ করে রেখেছিলেন। পৃথিবীর প্রথম এবং দ্বিতীয় মহাসাগর আটলান্টিক মহাসাগর, প‍্যাসিফিক মহাসাগর দেখার সুযোগ করে দিলেন। এরপর ভূমধ‍্যসাগর, গাল্ফ অব মেক্সিকো, আরব সাগর, লোহিতসাগর, পার্সিয়ান গলফ, কৃষ্ণ সাগর, এজিএনসি সাগর এরকম আরো অনেক সাগর উপসাগরে গিয়েছি।

এতো সাগর দেখে কত অভিজ্ঞতা জীবনে সঞ্চয় করেছি বলাই বাহুল‍্য। সমুদ্র কন‍্যা পর্তুগালের আটলান্টিক মহাসাগর দেখে ভয় পেয়ে ছিলাম। কি বিশাল ঢেউ, কারেন্ট এবং বাতাস। আমি ভয়ে দৌড়ে কুলে চলে এসেছিলাম। স্পেনে আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মিলন স্হলের দৃশ্য কি ভয়ংকর ছিল!! ওপাড়ে আফ্রিকা মহাদেশ এপারে ইউরোপ মহাদেশ। যখন সূর্যটি অস্ত গেলো তখন মনে হলো, আগুনোর গোলা পানিতে নিক্ষেপ করা হলো, সেই মূহুর্তটি কিযে ভয়ংকর অনুভূতি ছিল বলাই বাহুল্য।
যাই দেখি না কেন পুনরায় বঙ্গোপসাগর না দেখার শখটি পুরনই হলো না। এই শখ মেটাতেই কক্সবাজার ভ্রমণ।

চলবে –