মমতাজ উদ্দিন আহমদ :
ঈদ মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অবিচ্ছেদ্য উৎসব। এটি শুধু আনন্দ-উল্লাস নয়, বরং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা, ত্যাগ, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক সংহতির প্রতীক। ইসলামে দুটি প্রধান ঈদ রয়েছে: ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। উভয় ঈদই মুসলিম জীবনে গভীর তাৎপর্য বহন করে।
নবী মুহাম্মদ (সা.) যখন মদিনায় আসেন, তখন স্থানীয়রা জাহেলিয়াত যুগে দুটি উৎসব পালন করত। এই উৎসবগুলোর নাম ছিল ‘নাইরোজ’ ও ‘মেহেরজান’। এগুলিতে অশ্লীলতা,
বেহায়াপনা ও অনৈতিক বিনোদন প্রচলিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, এগুলি ছিল তাদের পূর্বপুরুষদের উৎসব। তখন তিনি (সা.) বলেন: “আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুটি দিনের পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন-
ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ১১৩৪; সুনানে নাসায়ী, হাদিস ১৫৫৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১২০০৬)
এই হাদিস প্রমাণ করে, ঈদ আল্লাহর পক্ষ থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য নির্ধারিত এক বিশেষ উৎসব।
ঈদুল আযহা: ত্যাগের মহিমা ও পরিশুদ্ধি
ঈদুল আযহা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এটি ‘ত্যাগের উৎসব’ বা ‘কুরবানির ঈদ’ নামে পরিচিত। জিলহজ মাসের দশম দিনে এটি শুরু হয় এবং চার দিন ধরে চলে। এটি কেবল আনন্দ-উল্লাসের দিন নয়। বরং এটি আল্লাহর প্রতি সীমাহীন আনুগত্য, আত্মত্যাগ ও মানবপ্রেমের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
উৎপত্তি ও ইব্রাহিম (আ.)-এর ঘটনা:
ঈদুল আযহার মূল ভিত্তি হলো ইব্রাহিম (আ.)-এর মহান আত্মত্যাগ। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে স্বপ্নে প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে (আ.) কোরবানি করার নির্দেশ দেন। এটি ছিল ইব্রাহিম (আ.)-এর ঈমানের কঠিন পরীক্ষা। আল্লাহর প্রতি তাঁর অগাধ বিশ্বাস ছিল।
ভালোবাসা সুদৃঢ়। তাই তিনি দ্বিধাহীনচিত্তে কলিজার টুকরা পুত্রকে কোরবানি করতে প্রস্তুত হন।
কুরআন মাজীদে এই ঘটনা এভাবে বলা হয়েছে:
“যখন সে (পুত্র) তার সাথে চলাফেরার বয়সে পৌঁছল, ইব্রাহিম বলল, হে আমার পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে আমি তোমাকে যবেহ করছি। এখন তোমার কী মত দেখো। সে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তাই করুন।
ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” (সূরা সাফফাত, ৩৭:১০২) ইব্রাহিম (আ.) যখন পুত্রকে কোরবানি করতে গেলেন, তখন অলৌকিকভাবে একটি দুম্বা
ইসমাইল (আ.)-এর পরিবর্তে কোরবানি হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন:
“তারপর যখন তারা উভয়েই আনুগত্য প্রকাশ করল এবং সে তাকে উপুড় করে রাখল, তখন আমি তাকে ডাক দিয়ে বললাম, হে ইব্রাহিম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার বিনিময়ে এক মহান যবেহ (কুরবানি) দিলাম।” (সূরা
সাফফাত, ৩৭:১০৩-১০৭)
এই ঘটনা আল্লাহর প্রতি ইব্রাহিম (আ.)-এর পরিপূর্ণ আনুগত্যের প্রতীক। এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য ত্যাগের এক অনন্ত অনুপ্রেরণা।
কুরবানির নিয়মাবলী ও শর্তাবলি:
কুরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য ওয়াজিব।
এর কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্ত আছে:
সময়: কুরবানি ঈদুল আযহার নামাজ শেষে শুরু হয় এবং জিলহজ মাসের ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি (ঈদের) নামাজের পূর্বে জবেহ করল, সে যেন নিজের জন্য জবেহ করল। আর যে ব্যক্তি নামাজের পরে জবেহ করল, সে যেন তার কুরবানি সম্পন্ন করল এবং মুসলিমদের সুন্নাত অনুযায়ী আমল করল।” (সহীহ বুখারী, হাদিস ৫৫৬২; সহীহ মুসলিম, হাদিস ১৯৯৮)
পশুর প্রকার: উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানি জায়েজ।
পশুর বয়স: উটের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর, গরু ও মহিষের ২ বছর। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। তবে ৬ মাস বয়সী দুম্বা যদি ১ বছরের মতো দেখতে হয়, তবে জায়েজ।
পশুর সুস্থতা: পশুকে সুস্থ, সবল ও ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। গুরুতর অসুস্থ, অন্ধ, খোঁড়া বা কান কাটা পশু দ্বারা কুরবানি জায়েজ নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“চার প্রকার পশু দ্বারা কুরবানি জায়েজ হবে না: স্পষ্টত অন্ধ, স্পষ্টত অসুস্থ,
স্পষ্টত খোঁড়া এবং এতই দুর্বল যে তার হাড়ে মজ্জা নেই।” (সুনানে আবু দাউদ,
হাদিস ২৮০২)
অংশীদারিত্ব: একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা শুধু এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানি করা যায়। তবে উট, গরু বা মহিষে ৭ জন পর্যন্ত শরিক হতে পারে।
কুরবানির গোশত বিতরণের নিয়ম:
কুরবানির গোশত বিতরণ করা মুস্তাহাব। সাধারণত, একে তিন ভাগে ভাগ করা হয়: এক- তৃতীয়াংশ কুরবানিদাতা নিজের ও পরিবারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের জন্য, এবং এক-তৃতীয়াংশ দরিদ্র ও অভাবীদের জন্য। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর কুরবানীর পশু সমূহকে আমরা তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত
করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে। অতএব, সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় সেগুলোর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর যখন সেগুলোর পাশ (দেহ) মাটিতে পড়ে যায় (অর্থাৎ যবেহ সম্পন্ন হয়), তখন তা থেকে খাও এবং অভাবী ও প্রার্থীকে আহার করাও।” (সূরা হজ, ২২:৩৬)
ঈদুল আযহার দিনের সুন্নত আমলসমূহ:
ঈদুল আযহার দিনে মুসলিমদের জন্য কিছু সুন্নত আমল রয়েছে, যা বরকত বাড়ায়: গোসল করা ও পরিচ্ছন্ন পোশাক পরা, সুগন্ধি ব্যবহার করা, ঈদের নামাজ আদায় করা, জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজর থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাজের পর তাকবীরে তাশরীক পাঠ করা (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।)। কুরবানি করা, কোরবানির গোশত দিয়ে আহার শুরু করা, এবং পরস্পর “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম” বলে শুভেচ্ছা বিনিময় করাও সুন্নত।
ঈদুল আযহার সামাজিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা:
ঈদুল আযহা মুসলিম জীবনে গভীর সামাজিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা বয়ে আনে। এটি আল্লাহর প্রতি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য, আত্মত্যাগ ও ধৈর্যের শিক্ষা দেয়। কুরবানির গোশত বিতরণের মাধ্যমে ধনী-গরিবের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি হয়, যা মুসলিম সমাজে সাম্য, সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় করে। এটি মানবতার সেবা ও মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
ঈদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ঈদ মুসলিম সমাজে গভীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলে।
ঐক্য ও সংহতি: ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ, পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় ও পারিবারিক মিলন মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি বাড়ায়। হাদিসে এসেছে: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন ঈদগাহে গমন করে সেখানে তিনি প্রথম যে কাজ শুরু করতেন তা হল সালাত (নামাজ)। আর সালাত শেষ করে তিনি লোকদের দিকে মুখ করে দাঁড়াতেন এবং তারা তাঁদের কাতারে বসে থাকতেন। তিনি তাদেরকে নসীহত করতেন, অসিয়ত করতেন এবং বিভিন্ন আদেশ দিতেন।” (সহীহ বুখারী)
স্থানীয় সংস্কৃতি: বিভিন্ন দেশে ঈদ উদযাপনে স্থানীয় সংস্কৃতির প্রভাব দেখা
যায়। পোশাক, খাবার ও সামাজিক রীতিনীতিতে ভিন্নতা থাকলেও ঈদের মূল বার্তা একই থাকে।
অর্থনৈতিক প্রভাব: ঈদকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিতে গতিশীলতা আসে। নতুন পোশাক, মিষ্টি ও মুখরোচক খাবার, এবং যাতায়াতের কারণে বাজারে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়।
ঈদ শুধু আনন্দের দিন নয়। এটি আত্মিক পুনর্জাগরণ, সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা এবং মানবিক মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করার এক অনন্য সুযোগ। মুসলিম জীবনে ঈদ আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের এক সার্থক প্রতিফলন। এটি আমাদের শেখায় যে, প্রকৃত আনন্দ নিহিত আছে ভাগ করে নেওয়া ও
অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শনের মধ্যে।
লেখক: সভাপতি, আলীকদম প্রেসক্লাব, বান্দরবান পার্বত্য জেলা। momtaj.news@gmail.com