জে.জাহেদ, কলকাতা থেকে…

বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ খুব বেশি। অনেকে বলেই ফেলেছেন, ডেঙ্গু মহামারিতে রূপ নিয়েছে। কিন্তু যে সময় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশনগুলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছেন। ঠিক তখনই পাশের রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা শহরে ডেঙ্গু একদম নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কথাটি জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে।

বাস্তবেই গত কয়েক বছর ধরে কলাকাতা সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ রাখতে সক্ষম হয়েছেন বলে দাবি। তাঁর গল্প শোনতে গিয়ে জানা যায়, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের শুধুমাত্র ম্যাজিক ছিল সারা বছরে নিবিড় নজরদারি আর নালা, নর্দমায় গাপ্পি মাছ ছাড়ার ইতিকথা।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর তাণ্ডব চোখে পড়ার মতো। প্রতিদিন মরছে মানুষ। গতকাল কলকাতার বিভিন্ন খবরের কাগজ পড়ে জানা গেছে ফের কলকাতায়ও ডেঙ্গুতে লোক মারা যাচ্ছে।

গত পরশু এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রাণ গেল ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির। স্বাভাবিকভাবেই খাস কলকাতায়ও এখন একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় আতঙ্ক আরও বাড়ছে। মৃতের নাম পরশ সাউ। বয়স ৬৩ বছর। ঠাকুরপুর এলাকার বাসিন্দা।
গত কয়েক দিন ধরে জ্বরে ভুগছিলেন তিনি।

২৯ সেপ্টেম্বর থেকে জ্বর নিয়ে নিউ আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। ২ অক্টোবর সন্ধেয় পরশ সাউয়ের মৃত্যু হয়। ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গু শকের উল্লেখ করেছেন চিকিৎসকরা। বেসরকারি হিসাব বলছে, কলকাতায় ডেঙ্গু মৃত্যুর সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়েছে। যদিও সরকারের তরফে মৃতের সংখ্যার কোনও হিসেব মেলেনি।

এরপর পাটুলিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০ বছরের বালিকার মৃত্যু হয়েছে কলকাতায়। নাম তার তিথি হালদার। কলকাতা পুরসভার ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের, পাটুলির বাসিন্দা ছিল সে। বুধবার সকালে বালিগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।

নিহতের পরিবার জানিয়েছেন, গত কয়েকদিন ধরেই জ্বর ছিল তিথির। স্বাস্থ্যের অবনতি হতেই বালিগঞ্জের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হয়। বুধবার সকালে মৃত্যু হয় তার। তার ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গুর কথা উল্লেখ রয়েছে।
উল্লেখ্য, এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হল ৫৩ জনের। রোজ কলকতায় এখন লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। কিন্তু সংখ্যায় খুবই নগন্য। বাংলাদেশে এরমধ্যে দৈনিক ১৮/১৯ জনের মৃত্যু হচ্ছে। সে হিসাবে বলা যায়, কলকতা সম্পূর্ণ নিরাপদে।

তবুও রাজ্যের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে কলকাতা হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে (মঙ্গলবার)। মামলাকারীর দাবি, রাজ্যের ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান কেন্দ্রকে দিচ্ছে না রাজ্য। পাশাপাশি রাজ্যের জমে থাকা আবর্জনা ও জল দ্রুত পরিষ্কারের নির্দেশ দদেন আদালত। এমন আবেদন করে জনস্বার্থ মামলা করা হয়েছে।

ডেঙ্গু মশা নিয়ন্ত্রণে কলকাতার পদক্ষেপ:

বাংলাদেশ যখন ডেঙ্গুর প্রকোপে ভুগছে, তখন কলকাতা শহরে ডেঙ্গু গত কয়েক বছর ধরেই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তবে একেবারেই যে ডেঙ্গু নেই। সে রকম কিছু নয়। কিন্তু জনসংখ্যা অনুপাতে ডেঙ্গু ৯৫ থেকে ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণে বলা যায়।

কলকাতা কর্পোরেশন বলছে, তাঁরা সারা বছর ধরে নিবিড় নজরদারি চালায়-যাতে কোথাও জল না জমে থাকে। এর জন্য বহু কর্মীও যেমন রয়েছেন, তেমনি আকাশে ওড়ানো হয় ড্রোনও। অন্যদিকে শহরের প্রতিটা হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা পরীক্ষাগারে রোগীদের কী কী রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে, কী ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রতিদিনের হিসাব রাখা হয়, যাতে ডেঙ্গু রোগীর খোঁজ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।

তবে একটা সময়ে ছিল বর্ষা শুরু হলে কলকাতা কর্পোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে নামতো। কিন্তু ততদিনে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ত শহরের নানা অঞ্চলে। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতা কর্পোরেশন সারা বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে শুরু করেছেন।

কলকাতার ডেপুটি মেয়র ও স্বাস্থ্য দপ্তর বলছিলেন, তাঁরা কয়েকটা স্তরে পুরো বছর ধরে নজরদারি চালান। প্রথমত, ১৪৪ টির প্রতিটি ওয়ার্ডে ২০ থেকে ২৫ জন করে কর্মী নিয়োগ দিয়েছিলেন। যাদের মধ্যে একদল প্রচারের কাজ চালায়, আর অন্য দল জল জমছে কী না কোথাও, সেটার ওপরে নজর রাখে।ডেঙ্গু নিযন্ত্রণে তাৎক্ষণিক ফোর্স হিসেবে কাজ করেছিলেন র‍্যাপিড অ্যাকশন টীম। তাতে ৮ থেকে ১০ জন লোক থাকে সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে, গাড়িও থাকে তাদের কাছে। শহরের যেকোনও জায়গায় ডেঙ্গুর খবর পাওয়া গেলে অতি দ্রুত তারা সেখানে পৌঁছে এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছিলেন।

যেসব জায়গায় জল জমে থাকতে দেখছে কর্পোরেশনের নজরদারী কর্মীরা, সেই ভবনগুলির ওপরে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ধার্য করার জন্য আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। আবার জল পরিষ্কার করে দেওয়ার খরচ বাবদ বিল, বাড়ির বার্ষিক করের বিলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছে কর্পোরেশন।

ভারতের বেশীরভাগ ল্যাবরেটারিই এখনও বেসরকারী। তাদের কাছ থেকে ঠিকমতো যখন তথ্য কখনই পাওয়া যায় না। টিক তখনই ১৪৪টা ওয়ার্ডেই একজন করে কর্মী রেখেছেন, যার একমাত্র কাজ হল ওই এলাকায় যত হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, সেখানে একটা খাতা নিয়ে হাজির হবেন।

কত রোগীর রক্ত পরীক্ষা হলো, কী কী পরীক্ষা হলো, পরীক্ষার ফল কী, সেগুলো নোট করে আনবেন তারা। সঙ্গে সঙ্গেই সেই তথ্য অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে পৌঁছিয়ে যায় এলাকা ভিত্তিক মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ টীমের কাছে। এসব ব্যবস্থা নেওয়ার পরে বর্তমানে কলকাতা শহরে ডেঙ্গু কমেছে।

ডেঙ্গু দমনে কলকতা শহরে গাপ্পি মাছ:

গত কয়েকদিন ধরে কলকতায়ও বৃষ্টি বেড়েছে। উপদ্রব বাড়ছে ডেঙ্গু মশার‌। কিছুদিন পরেই দূর্গাপুজা। তাই করোনার আবহে ডেঙ্গুর হাত থেকে বাঁচতে মশারি টাঙানো, জমা জল পরিষ্কার করার পাশাপাশি গাপ্পি মাছেই ভরসা রাখতে হচ্ছে শহরবাসীর। কলকতা সিটি কর্পোরেশন ডেঙ্গু মোকাবিলায় দুই বছর আগেই নালা নর্দমায় এ মাছ ছেড়েছেন।

তখন বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন কলকাতা পৌরসভার প্রশাসনিক প্রধান ফিরহাদ হাকিম। ডেঙ্গু প্রতিরোধের জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের জন্য এই গাপ্পি মাছকে কাজে লাগিয়েছিলেন।

গাপ্পি মাছ কিভাবে কাজ করেন?

গাপ্পি মাছ গিলে নেয় এডিশ বা অন্য মশার লার্ভা। বর্ষার সময় ডেঙ্গু প্রতিরোধ করার জন্য গাপ্পি মাছের বিকল্প কিছু ছিলো না তখন। তাই বিপুল পরিমাণের গাপ্পি মাছ ছেড়েছিলেন। কলকাতা পৌরসভার তরফ থেকে ১৪৪ টি ওয়ার্ডের সমস্ত জায়গায় সমান ভাবে বিতরণ করেছিলেন গাপ্পি মাছ। কলকতায় মশা মারতে কামানের চেয়ে গাপ্পি মাছই বড় সমাধান ছিলো। নালা, নর্দমা, সৌন্দর্যায়নের ঝরনাসহ সমস্ত স্থানেই মাছটি ছেড়েছিলেন।

প্রসঙ্গগত, ২০০০ সালে প্রথম দেশে ব্যাপকভাবে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সে বছর প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মানুষ ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়। যদিও দেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬০ সালে, ঢাকায়। সে সময় ডেঙ্গুকে ‘ঢাকা ফিভার’ বলে ডাকা হতো। সময়ের পরিক্রমায় গড়িয়েছে প্রায় ৬২ বছর।

এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১২৫টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গুজ্বর। বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ৪০ কোটি মানুষের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে এবং ৪০ হাজার মানুষ এতে মারা যায়।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপক্রান্তীয় দেশগুলোর স্থানীয় অঞ্চলগুলো (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়া) বিশ্বের মোট ডেঙ্গুর ৭০ শতাংশের জন্য দায়ী। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের আনুমানিক অর্ধেকেরও বেশি ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ায়। যদিও কলকাতায় বসবাসকারী চট্টগ্রামের আলমগীর ও রানা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামের নালা নর্দমা, ড্রেন সব বন্ধ। পানি চলাচল করছে না। ফলে পঁচা আবর্জনা বেশি ও পানি জমছে। তার উপর ঢাকাসহ সারাদেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো সারা বছর কোন পদক্ষেপ নেন না। ডেঙ্গুর প্রাদূর্ভাব বেড়ে শুধু লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপ নেন। যা কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে।