ইমরুল শাহেদ

দোহাজারী থেকে ককসবাজার হয়ে ঘুনধুম (উখিয়াস্থ বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার) পর্যন্ত রেল লাইন সম্প্রসারণের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে। বলা হচ্ছে, ২০২৩ সালের শেষের দিকে এই লাইনে আধুনিক ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রেলগাড়ি চলবে। যদিওবা কালুরঘাট রেল সেতু আগের মতই রয়ে গিয়েছে, চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারীতে পূর্বের ধ্বজভঙ্গ লাইনই বহাল রয়েছে। ব্রিটিশ আমলের কালুরঘাট সেতু পার হয়ে, ধ্বজভঙ্গ দোহাজারী লাইন হয়ে কত দ্রুত গতিতে ককসবাজার নতুন লাইনে রেল আসতে পারবে, প্রশ্ন সাপেক্ষ। অবশ্য রেলওয়ে বলছে, শীঘ্রই দোহাজারী পর্যন্ত লাইন সংস্কার করা হবে এবং আগামী সরকারের মেয়াদেই কালুরঘাট রেল সেতু নির্মাণ করা হবে।

ককসবাজার রেল লাইন নিয়ে বহু যুগোপযোগী সুযোগ সুবিধা সম্বলিত আইকনিক স্টেশনের কথা বলা হচ্ছে। যার দৃশ্যমান কাজও আমরা দেখছি লিংক রোডস্থ প্রধান স্টেশনে। আমরা আশা করছি, নির্দিষ্ট সময়েই জনসাধারণ কল্পনায় ঘোড়া দৌড়ানো বাদ দিয়ে রেলে চড়ে ছুটবে।

উপরোক্ত কথাগুলোর প্রেক্ষাপট হচ্ছে রেল লাইন। লাইন না বানালে রেল গাড়ি চলতে পারে না। যেমন পারেনা বিমানবন্দর না করলে বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ। বাংলাদেশের অন্যতম বনাঞ্চল চট্টগ্রাম -ককসবাজার এলাকাও অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও অতি বিশালকার আবাদী জমিও লাইনের উপর ভরাট হয়েছে।

দোহাজারী পার হয়ে বাঁশখালী-সাতকানিয়ার পাহাড়ি অঞ্চল, চুনতি অভয়ারণ্যে, চকরিয়া-ফাঁসিয়াখালি বনাঞ্চল যেখানে অন্তর্ভুক্ত মেধাকচ্ছপিয়া অভয়ারণ্যে সহ প্রায় ৮০ কিলোমিটার বনাঞ্চল। রেলের জন্য লাইন করতে গিয়ে এই দীর্ঘ পথের হাজার হাজার বৃক্ষ নিধন করতে হয়েছে, বহু পাহাড়, টিলা কর্তন করে মাটি সরানো হয়েছে, বহু ঝোঁপঝাড় কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে যার দরুণ বনজ প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে, বহু ধানী জমি লাইনের নীচে বিলীন হয়েছে, বহু পুকুর, জলাধার ভরাট হয়েছে, চারটি বড় নদীতে ব্রীজ নির্মাণের ফলে নদীর নব্যতা হ্রাস পেয়েছে, অগণিত খাল-বিল মরে গিয়েছে, লক্ষ কোটি পাখির বাসা হারিয়েছে, অভিযোজন সার্কেল বিনষ্ট হয়েছে, মৎস্য সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, সর্বোপরি সার্বিকভাবে বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে।

এমনকি আগামীতে যখন রেল লাইন চালু হবে, শ্রবণোত্তর শব্দের প্রতিক্রিয়ায় আরো বহু বনজ উউদ্ভিদ, প্রাণী নির্বিচারে ধ্বংস হয়ে যাবে।

সবুজ বা বনাঞ্চল কতটুকু জরুরি যারা মধ্যে প্রাচ্যে ভ্রমণ করেছেন তারা জানেন। ওখানে তীব্র গরমের মাঝে, ধূ ধূ বালির ভূমির মধ্যে একটা সামান্য খেজুর গাছের কি অপরিসীম ক্ষমতা নিজে ভুক্তভোগী না হলে বুঝা যায় না। আমাদের দেশের শ্রমিক ভাইয়েরা টগবগে উত্তপ্ত গরমের মাঝে এক ইঞ্চি গাছের ছায়ার অভাবে হাঁসফাঁস করে৷ মিডল ইস্টের রাজা বাদশাহরা লক্ষ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করে একটু সবুজায়নের জন্যে, এক কলসি পানির জন্য।

সে জায়গায় আমরা বিনামূল্যে পাওয়া সবুজকে গুরুত্ব দেইনা। নির্বিচারে উন্নয়নের করাত চালিয়ে দেই চোখ বন্ধ করে। অথচ পরিবেশবিদরা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ছোঁয়ায় আমরা এখন নিমজ্জিত। আমাদের ছয় ঋতুর সেই পিঠাপার্বণের দিন আর নাই। হয় অতি বৃষ্টি, না হয় অনা বৃষ্টি। হয় অতি গরম, না হয় তীব্র শীত। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের মর্যাদা আমরা হারাতে বসেছি।

সুতরাং সময় থাকতে সাধন জরুরি। এর প্রধান উদ্যোগী হতে হবে সরকারকে। যে পরিমাণ বনাঞ্চল উন্নয়নের প্রয়োজনে নিধন করা হয়েছে, তার দ্বিগুণ বনায়ন জরুরী দরকার। দরকার সামাজিক বনায়ন। প্রয়োজন মানুষকে সবুজের মর্মকথা অন্তরে অনুধাবনের জন্য নার্সিং করা। বনদস্যুরা যাতে বাড়ন্ত হতে না পারে, নির্বিচারে বনখেকোরা যেন সামাজিক ক্ষমতার উচ্চ পর্যায়ে বসে জনপ্রতিনিধি হতে না পারে, আইন যেন বৃক্ষ কতলের জন্য কঠোর সামাজিক ও ব্যক্তিগত সাজার ব্যবস্থা করে, বিদেশীরা যেন এই দেশকে স্ট্যান্ডার্ড মেনে নিতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে।

গাছ অক্সিজেনের ফ্যাক্টরি। এক কিউবিক মিটার অক্সিজেনের কত মূল্য করোনা শিক্ষা দিয়েছে। এরপরেও যদি আমরা শিক্ষা না নেই, দোষ প্রকৃতির নয়, আমরা দু পেয়ে জন্তুদের।

ইমরুল শাহেদ
প্রকৌশলী