-মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
বেগম খালেদা জিয়া। একটি নামই শুধু নয়-একটি প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মহীয়সী এই মহিলা নিজেকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। স্বৈরাচার একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি বছরের পর বছর লড়াই করেছেন, সংগ্রাম করেছেন-জনগণের কাতারে গিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তিনি জনগণকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজপথে সংগ্রাম করেছেন। কারাগারে গেছেন। গৃহে অন্তরীণ থেকেছেন। নিজ বাড়ি থেকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে উচ্ছেদ হয়েছেন। সন্তানেরা মিথ্যা অভিযোগ, মিথ্যা মামলায় জড়িত হয়ে-রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অভিযুক্ত হয়েছেন। নির্যাতিত হয়েছেন। চিকিৎসার কারণে দীর্ঘকাল বিদেশে অবস্থান করেছেন। সব কিছুকে উপেক্ষা করে দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য, গনতন্ত্রের জন্য, জন মানুষের মৌলিক অধিকার জন্য। অথনৈতিক মুক্তির জন্য এই নেতা নিজস্ব সুখ- স্বাচ্ছন্দ ব্যক্তিগত স্নেহ মমতাকে উপেক্ষা করে কাজ চলেছেন নিরন্তর। দিনের পর দিন দীর্ঘ সময় জনগণের সংগে তাঁর পথ চলা। দেশের স্বার্থ তার কাছে সবচেয়ে বড়। আর এই সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জন করেছেন গণতন্ত্রের বিজয়। প্রতিষ্ঠ করেছেন সংসদীয় গণতন্ত্র। মানুষের অধিকার । এই অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়েই অর্জন করেছেন বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বয়ম্ভর করার চলমান সাফল্য আর সে জন্যেই এই দেশের মানুষ তাঁকে দেশ নেত্রী বলে সম্বোধন করেন।
দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া একজন গৃহবধূ ছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষক, বীর মক্তিযোদ্ধা, আধুনিক বাংলাদেশের রুপকার বহুদলীয় গণতন্ত্রের পূনঃপ্রবর্তক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান-এর সহধর্মিণী ছিলেন তিনি। জিয়ার শাহাদৎ বরণের পরে এই গৃহবধূ বিএনপি -এর হাল ধরেছিলেন খুব দুঃসময়। স্বৈরাচার এরশাদ যখন অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। বিএনপিকে ভেংগে ফেলার জন্য সব রকম অপকৌশল অবলম্বন করেছেন যখন রাজনীতিতে একেবারে এই নেতা হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগিয়েছেন। গুটিয়েছেন নিজের দলকে। রাজনীতি বুঝেছেন। স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া ছুটে বেড়িয়েছেন। গণতন্ত্রেরগান গেয়ে জাগিয়ে তুলেছেন বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে। গ্রামে গ্রামান্তরে। দীর্ঘ ৯ বছর সংগ্রাম করেছেন রাজপথে। কখনও গৃহে অভ্যন্তীণ রাখা হয়েছে। কখনও তার সভা ভেংগে দেয়া হয়েছে গুলি ও পুলিশ দিয়ে। কখনও টিয়ার গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়েছেন তিনি। তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে- নির্যাতিত করা হয়েছে। এমনকি হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে দমাতে পারেনি কোন কিছু। কোন লোভ, অত্যাচার নির্যাতন তাঁকে দমাতে পারে নি। আপসহীনভাবে চুড়ান্ত লড়াইয়ে বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত লড়েছেন। জনগণকে সংগে নিয়ে বিজয় অর্জন করেছেন। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছেন। এই বিজয় ছিল অভূতপূর্ব। এই বিজয় ছিল আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের বিজয়। এরপর জনগণের অকুন্ঠ ভালোবাসা নিয়ে ১৯৯১-এর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন করেছেন। ফিরিয়ে দিয়েছেন মানুষের মৌলিক অধিকার। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছেন। গণতন্ত্রকে তার নির্দিষ্ট পথে চলতে দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন।
অর্থনীতির চাকাকে সচল করার জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ করেছেন। মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তন, বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ব্যক্তি মালিকানায় বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি করা, শিল্প ঋণ সহজতর করা- বিশেষায়িত শিল্প এলাকা নির্মাণ- শিল্প-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন।
কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ৫০০০ টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণের সুদ-আসল মওকুফ করেছেন। ১০,০০০টাকার সুদ মুওকুফ করেছেন। কৃষি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন। কৃষি গবেষণার পরিমাণ বৃদ্ধি করেছেন। বীজ, সার সেচ সহজলভ্য করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছেন।
শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। বিশেষ করে নারী শিক্ষায় ও প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিনা খরচে নারী শিক্ষার কর্মসূচি বেগম জিয়া শুরু করেন। এই কর্মসূচি বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে।
স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়া-মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়া, গড় আয়ু বৃদ্ধি পাওয়া এ সবই বেগম জিয়ার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতৃত্বেও সুফল।
বেগম জিয়া তিন বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। কখনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। এদেশের মানুষের মনের মণিকোঠায় তাঁর অবস্থান। তাঁর প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণে বাংরাদেশকে তুলনা করা হয়েছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বসবৎমরহম ঞরমবৎ হিসেবে।
আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশকে চিহ্নিত করেছিল সম্ভাবনাময় একটি অর্থনীতি হিসেবে।
একটি মুসলিম প্রধান দেশে হিসেবে বাংলাদেশ উঠে আসছিল একটি আধুনিক উদারপন্থী গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দীর্ঘতম সময় বেগম জিয়া তার প্রজ্ঞা, অধ্যাবসায়, পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং ঐকান্তিকতার সঙ্গে প্রভাব বিস্তার করেছেন। বিগত শতকের আশির দশকের প্রথম থেকেই রাজনীতিতে তার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। শহীদ জিয়ার রাজনীতিকে তিনি ধারণ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি অবিচল। গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিরামহীন সংগ্রাম করছেন। অর্থনীতিকে সচল রাখা উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর নেতৃত্ব বাংলাদেশকে ভিন্ন রূপ দিয়েছে।
দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা সেখানেই আঘাত করেছে। জিয়া পরিবারকে সেজন্যেই আঘাত করা হয়েছে। স্বাধীন, স্বকীয় রাজনীতি ধারণ করেন বেগম জিয়া। বেগম জিয়া গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ করতে চান। একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি করতে চান। তারেক রহমান সেই রাজনীতিকেই ধারণ করেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও স্বাধীন মুক্ত অর্থনীতির এই নেতৃত্ব যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেই কারণেই ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি একটি অবৈধ, অসাংবিধানিক সরকার আঘাত হানে বাংলাদেশের অস্তিত্বে। বেগম জিয়া, তারেক রহমান, আরাফাত রহমানসহ বিএনপি-এর অসংখ্যা নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। মামলা করা হয়। বেগম জিয়া অন্তরীণ থাকা অবস্থায় আর একটি লড়াই শুরু করেন। যত দিন গৃহবন্দী ছিলেন সেল ফোনের মাধ্যমে দলের তৃনমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দলের যোগাযোগ রেখে দলকে বাঁচিয়ে রাখেন তথাকথিত সংস্কার পন্থীদের ষড়যন্ত্র হতে। এরপর কারাগারে গিয়ে নীরব সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু করেন সেই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। জরুরি অবস্থা তুলে নির্বাচনের দাবি তোলেন।
এবং সরকারকে বাধ্য করেন রাজবন্দীদের মুক্তি দিতে এবং নির্বাচন ঘোষণা করতে। দৃঢ়চিত্তে ঘোষণা করেন জরুরি অবস্থা তুলে না নিলে নির্বাচনে যাবেন না। তারা বাধ্য হয় নির্বাচনের পূর্বে জরুরি অবস্থা তুলে নিতে।
দলের নিপর্যস্ত অবস্থায়ও শুধু গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে তিনি নির্বাচনে যান।
নির্বাচনের ফলাফল তাঁর পূর্বেই জানা ছিল। শুধু একটি অনির্বাচিত অবৈধ সরকারের চেয়ে নির্বাচিত সরকার শ্রেয় এই নীতিতে তিনি নির্বাচনে যান এবং নীল নকশার নির্বাচনের ফলাফল মেনে সংসদে যোগ দেন।
বেগম জিয়া শুরু থেকেই সরকারকে সহযোগিতা করতে চেয়েছেন। গণতন্ত্রের স্বার্থে। দেশের স্বার্থে। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে তিনি সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রের একজন অতন্দ্র প্রহরী। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার দেশনেত্রীর এই সহযোগিতার হাত গ্রহণ করেনি। উপরন্তু শুরু থেকেই চরম বৈরী এবং প্রতিহংসাপরায়ণ হয়ে জিয়া পরিবার ও বিএনপি-এর উপর চড়াও হয়ে সে। পুরোনো মিথ্যা মামলাগুলো চালু করে। ৪০ বছরের নিজস্ব বাড়ি থেকে বেগম জিয়াকে জোরপূর্বক বেআইনিভাবে উচ্ছেদ করে। আরাফাত রহমানকে বেআইনিভাবে সাজা দেয়, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে কোনো মামলায় সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করতে না পেরে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিতে থাকে এবং সর্বশেষ ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ৭ বৎসর পর তাঁকে জড়িয়ে চার্জশীট প্রদান করে। তারেক রহমান আরাফাত রহমান বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারেক রহমান পঙ্গু হয়ে যাওয়ার মতো অসুস্থ। শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে আওয়ামী লীগ ব্রুট মেজরিটির জোরে এই ব্রুট অত্যাচার নির্যাতন করছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ একে একে রাষ্ট্রের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করছে-পার্লামেন্টকে একদলীয় অকার্যকর পার্লামেন্টে পরিণত করেছে। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ দলীয়করণ করে ধ্বংস করছে।
প্রশাসন দলীয়করণ সম্পন্ন করেছে। নির্বাচন কমিশন আস্থাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করছে।
সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, খুন, নির্যাতন, মামলা, হামলায় মানুষের জীবন দুঃসহ করে তুলেছে। সর্বশেষ আঘাত করেছে সংবিধানকে। সংশোধনী ও পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে গণতন্ত্রের মূল বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে একদলীয় শাসন পুনরায় প্রবর্তনের লক্ষ্যে পঞ্চদশ সংশোধনী বিরোধী দলের অনুপস্থিতির মধ্য দিয়ে পাস করিয়ে নিয়েছে। আর তার পরেই শুরু করেছে বিরোধী দলের ওপরে নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়ন। দমননীতির মধ্য দিয়ে একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করার লক্ষ্যে তারা এগোচ্ছে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া রুখে দাঁড়িয়েছেন এই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন সংবিধানের এই সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে চরমভাবে আঘাত হানা হয়েছে অন্যদিকে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে।
আওয়ামী লীগ তাদের শাসন পাকাপোক্ত করার জন্য দলীয় সরকারের মাধ্যমে নির্বাচনের বিধান রাখছে। বেগম জিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। ভবিষ্যতেও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য তিনি যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছেন। দেশের সকল দেশপ্রেমিক গণতন্ত্রকামী মানুষকে তিনি এই লড়াই-এ শরিক হওয়ায় আহ্বান জানিয়েছেন।
বেগম জিয়া স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক-গণতন্ত্রের অতন্দ্র প্রহরী। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার একজন কারিগর। সমস্ত জাতি আজ তাঁর নেতৃত্বের অপেক্ষায়। মুক্তি চায় এই দুঃশাসন হতে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। একটি গণতান্ত্রিক, আধুনিক, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র নির্মাণে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। বেগম জিয়া বেঁচে থাকুন দীর্ঘদিন, এই প্রার্থনা করি।
লেখক: মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি