মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ, পাহাড়ী ঢল ও পাউবো নিয়ন্ত্রিত বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে মাতামুহুরী নদীর পানি ঢুকে বিভিন্ন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পেকুয়া উপজেলা সদরের সাথে বিভিন্ন ইউনিয়নের গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ গত তিন দিন ধরে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। একইভাবে গত তিন দিন ধরে পেকুয়ার বিভিন্ন এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের দেখা নেই। বন্যা কবলিত এলাকায় শত শত নলকুপ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এর ফলে বন্যা কবলিত এলাকা সমূহে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, পেকুয়া উপজেলার তিনটি পয়েন্টে পাউবো নিয়ন্ত্রনাধীন বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় কমপক্ষে ৫০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

এদিকে, গত কয়েক দিন ধরে পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোতাছেম বিল্লাহ সরকারী বরাদ্দ হতে পেকুয়া উপজেলার বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকায় শুকানো খাবারসহ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন। বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ইউএনও বানভাসী মানুষের খোঁজ খবর নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে পেকুয়া উপজেলা শিলখালী ও বরাবাকিয়া ইউনিয়নের পাহাড়ে বসবাসকারী বেশ কিছু পরিবারকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়েছে ইউএনও। এর ফলে প্রবল বর্ষণ হলেও পেকুয়ায় পাহাড় ধ্বসে জানমালের কোন ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, পেকুয়া সদর ইউনিয়নের পূর্ব মেহেরনামা এলাকায় বেড়িবাঁধের দু’পয়েন্টে ভেঙ্গে যাওয়ায় সদর ইউনিনের পূর্ব মেহেরেনামা মোরার পাড়া, বাজার পাড়া, সৈকত পাড়া, নন্দীর পাড়া, হরিণাফাঁড়ী, চৈরভাঙ্গা, চড়া পাড়া, তেলিয়াকাটা, সাবেক গুলদি, সরকারী ঘোনা, নতুন বাগুবাজার, সাকুতলাসহ আরো বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পেকুয়া সদর ইউনিয়নের পূর্ব মেহেরানা গ্রামের বাসিন্দা এবি পার্টির নেতা কাউসার বিন ইসলাম জানান, ভেঙ্গে যাওয়া পাউবোর বেড়িবাঁধ এখনো পুন:নির্মাণ না হওয়ায় জোয়ারের সময় লোকালয়ে পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। পূর্ব মেহেরনামা এলাকায় অনেক পরিবার পানিবন্ধী হয়ে পড়েছে। পাউবোর বেড়িবাঁধ মাতামুহুরী নদীর বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে।

পেকুয়া সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাহাদুর শাহ গত কয়েক দিন ধরে সদর ইউনিয়নের বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে নগদ অর্থ সহায়তা বিতরণ করেছেন বলে জানা গেছে।

শিলখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল হোসাইন জানান, টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলের শিলখালী ইউনিয়নের পেঠান মাতবরপাড়া, হাজিরঘোনা, দোকানপাড়াসহ প্রায়য় ৮/১০ টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে যায়। বন্যা কবলিত এসব গ্রামের লোকজনকে ত্রান দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান।

জানা যায়, বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে উজানটিয়া ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মাতামুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জোয়ারের পানির আঘাতে উজানটিয়া ইউনিয়নের পূর্ব উজানটিয়া গোদারপাড়া ষ্টেশনের অদূরবর্তী স্থানে একটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে করে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে এই ইউনিয়নের পূর্ব উজানটিয়ার সুতাচোরা, গোদারপাড়া, নুরীর পাড়া, রুপালীবাজার পাড়া, দক্ষিন সুতাচুরা, মালেকপাড়া, ঠান্ডার পাড়া, আতর আলী পাড়াসহ বিপুল এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।

উজানটিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম শহিদুল ইসলাম ইসলাম চৌধুরী জানান, তাঁর ইউনিয়নের গুদারপাড়া গ্রামে এলাকায় পাউবোর ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ তিনি গতকাল পাউবোর নির্দেশে গতকাল বৃহস্পতিবার বার মেরামত করেছেন। এতে করে সামান্যতম হলেও জোয়ারের পানি ঠেকানো যাবে। তিনি অতিদ্রুত উজানটিয়া ইউনিয়নের সংস্কারবিহীন পাউবোর বেড়িবাঁধ পুন:মেরামতের জন্য পাউবোর উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্থক্ষেপ কামনা করেছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড পাউবোর পেকুয়া উপজেলার দায়িত্বে থাকা সেকশন অফিসার (এসও) প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন জানান, গত কয়েক দিন ধরে তিনি পেকুয়ার বিভিন্ন বেড়িবাঁধ সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। মগনামায় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ হওয়ায় এবার সেখানে কোন ধরনের ক্ষতি হয়নি। উজানটিয়া ইউনিয়নে ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের জন্য জরুরী মেরামতের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। তবে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ভেঙ্গে যাওয়া বেড়িবাঁধের অংশ পুন:মেরামত করেছেন। তিনি আরো বলেন, পেকুয়া সদর ইউনিয়নের কোথাও বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়নি। বন্যার পানি লোকালয় থেকে দ্রুত বের হওয়ার জন্য স্থানীয়রা পেকুয়া সদরের পূর্ব মেহেরনামা এলাকার দুটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ কেটে দিয়েছেন।

সরেজমিনে বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শন করে দেখা গেছে, পেকুয়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে পেকুয়া সদর, বারবাকিয়া, শিলখালী, টইটং ও মগনামা ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের পানিতে উপজেলার পেকুয়া সদর, মগনামা, শিলখালী, বারবাকিয়া ও টইটং ইউনিয়নের বিপুল এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। মাতামুহুরী নদীসহ শাখা নদীগুলিতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব ইউনিয়নের ইউনিয়নের শত শত বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। গ্রামীণ অবকাঠামো পানিতে তলিয়ে গেছে। অসংখ্য পুকুর, চিংড়ি ঘের ও মৎস্যখামার পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে লক্ষ লক্ষ টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বীজতলাও পানিতে তলিয়ে গেছে। ফসল ও বীজতলার ক্ষতি হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা ও পড়েছেন চরম বিপাকে।

মগনামা ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ চৌধুরী জানান, মগনামা ইউনিয়নের কুমপাড়া, ধারিয়াখালী, বাইন্যা ঘোনা, দরদরি ঘোনা, মগঘোনা, শরৎঘোনা, পশ্চিম বাজার পাড়া, হারুন মাতবর পাড়া, কালার পাড়া, শুদ্ধাখালী পাড়া, কইডা বাজারপাড়াসহ আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম টানা বর্ষণে প্লাবিত হয়েছে। বেশ কিছু পরিবার পানিবন্ধী হয়ে পড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মগনামার ১৩০ পানিবন্ধী পরিবারকে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।

বারবাকিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাওলানা বদিউল আলম জানান, তাঁর ইউনিয়নের ভারুয়াখালী, বারাইয়াকাটা, নাজিরপাড়াসহ ৫/৬ টি গ্রামের মানুষ পানিবন্ধী হয়ে পড়েছে। ওই এলাকার গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পাহাড়ী ঢলের পানি ও টানা বৃষ্টির কারনে ওই এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে চেয়ারম্যান জানান।

পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোতাছেম বিল্লাহ জানান, গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলের কারণে পেকুয়ায় বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যা কবলিত বিভিন্ন গ্রামের লোকজনকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি শুকানো খাবারও বিতরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, টানা বর্ষণে বারবাকিয়া ও শিলখালীর পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী বেশ কিছু পরিবারকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।