জে.জাহেদ, চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:

চট্টগ্রাম পূবালী ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত দুজনকে গ্রেফতার করেছে ডবলমুরিং থানা পুলিশ।

নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (পশ্চিম) ফারুকুল ইসলাম জানিয়েছেন, গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রামে পূবালী ব্যাংকের দুটি শাখা থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর গত ২২ জুন আবারও একই প্রক্রিয়ায় বন্দরনগরীতে আরও দুটি বেসরকারি ব্যাংকের বুথ থেকে তারা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। নভেম্বরের ঘটনার পর থেকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ হিসেবে থানায় তালিকাভুক্ত জালিয়াত চক্রের হোতা ও তার সহযোগীকে আগ্রাবাদ থেকে ২৩ জুন গ্রেফতার করে পুলিশ।

গ্রেফতার হওয়া জালিয়াত চক্রের হোতা মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম (৩৪) মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার হেমায়েতপুর গ্রামের ইয়াজ উদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে। থাকেন ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানার নসরুদ্দিন রোডে।

গ্রেফতার অপরজন হলেন– শরীফুলের সহযোগী মো. মহিউদ্দিন মনির (৩০)। তিনি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া গ্রামের মৃত হাজী আহম্মদ হোসেনের ছেলে।

এরা রাশিয়ার মস্কো ও ইংল্যান্ডের লন্ডন থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে বিদেশি এক নাগরিককে নিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে এ পেশায় নামেন।

ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সদীপ কুমার দাশ জানান, গত বছরের (২০১৯) ১৭ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিটে নগরীর চকবাজার থানার কলেজ রোডে পূবালী ব্যাংকের বুথ থেকে এটিএম মেশিনে জালিয়াতির মাধ্যমে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। সেদিন একই প্রক্রিয়া রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে ডবলমুরিং থানার চৌমুহনী ফারুক চেম্বারের নিচে পূবালী ব্যাংকের আরেকটি বুথ থেকে তুলে নেওয়া হয় ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। দুটি ব্যাংকের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজে শরীফুলকে দেখা যায়।

এই ঘটনার পর তারা জানতে পারেন, একই ব্যক্তি ১৬ নভেম্বর কুমিল্লা জেলার কোতোয়ালী থানার কান্দিরপাড় এলাকায় পূবালী ব্যাংকের প্রধান শাখার এটিএম বুথ থেকে ১৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে। ১৫ নভেম্বর সেই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাড়া এলাকায় পূবালী ব্যাংকের আরেকটি বুথ থেকে পরীক্ষামূলক ১০ হাজার টাকা উত্তোলন করে।

এরপর গত ২২ জুন নগরীর কোতোয়ালী থানার জিপিও এলাকায় বিকেল পৌনে ৪টায় সাউথইস্ট ব্যাংকের বুথ এবং ৫টায় আগ্রাবাদে মিডল্যান্ড ব্যাংকের বুথে ঢুকে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় শরীফুল ও তার সহযোগী মনির। এর আগে ২০১৯ সালে শরীফুল ইসলামী ব্যাংক এবং আরব-বাংলাদেশ ব্যাংকের বুথে ঢুকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

ওসি সদীপ বলেন, ‘পূবালী ব্যাংকের চারটি বুথ থেকে টাকা উত্তোলনের ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে আমরা শরীফুলের বিষয়ে নিশ্চিত হই এবং যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে শরীফুল সম্ভবত ভেবেছিল, বিষয়গুলোর দিকে আমরা যথেষ্ট নজর দিচ্ছি না। সেজন্য সে তার সহযোগীকে নিয়ে আবারও চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে বুথে ঢুকে এটিএম মেশিন জালিয়াতির মধ্য দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তার চট্টগ্রামে প্রবেশের বিষয়ে নিশ্চিত হই এবং একপর্যায়ে গোয়েন্দা জালে ফেলে এই উচ্চশিক্ষিত জালিয়াতকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হই।’

যেভাবে জালিয়াতিতে জড়ায় শরীফুল

প্রাথমিক জিজ্ঞাসবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডবলমুরিং থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. জহির হোসেন জানিয়েছেন, ২০০৩ সালে ঢাকার একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে শরীফুল রাশিয়ার মস্কোতে চলে যায়। সেখানে একটি কলেজ থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর ডিপ্লোমা কোর্স করে। তিনবছর পর লন্ডনে গিয়ে সিটি কলেজে মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে তিন বছরের ডিগ্রি নেয়। ২০১০ সালে দেশে ফিরে চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহরের এ-ব্লকে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি নেয়।

রাশিয়াতে পড়াশোনার সময় ইভানোভিচ নামে তার এক রুমমেট ছিল। দুজনে মিলে তখন এটিএম কার্ড ক্লোনিংয়ের ওপর গবেষণা করেন। লন্ডনে গিয়ে বন্ধুত্ব হয় মহোনতাজ পনথোরাই নামে সেদেশের এক নাগরিকের সঙ্গে। মূলত এটিএম কার্ড ক্লোনিংয়ের বিষয়ে পনথোরাইয়ের কাছ থেকেই শরীফুল মূল শিক্ষাটা পান।

পুলিশ পরিদর্শক জহির বলেন, ‘ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করার সময় শরীফুল এটিএম কার্ড ক্লোনিংয়ের চেষ্টা করেন। পনথোরাইও লন্ডন থেকে বাংলাদেশে এসে তার সঙ্গে যোগ দেন। পনথোরাই কানাডা থেকে কিছু এটিএম কার্ড নিয়ে আসেন। সেগুলো দিয়ে একদিনে তারা ২২টি ক্রেডিট কার্ড ক্লোন করেন। সেই থেকে শুরু।’

তিনি বলেন, ‘দুই মডেলের এটিএম মেশিন শরীফুলের টার্গেট, যেগুলো থেকে সহজে টাকা উত্তোলন করা যায়। এসব মেশিনের স্পেয়ার চাবি তারা বিভিন্ন অনলাইন শপ থেকে খুঁজে সংগ্রহ করে। টার্গেট করা বুথে ঢুকে নির্দিষ্ট মেশিনে ম্যালাওয়ার সফটওয়্যার ব্যবহার করে পেনড্রাইভসহ একটি ইউএসবি হাবপোর্টের প্রবেশ করায়। সফটওয়্যারটি উইন্ডোজ প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে এই তারবিহীন মিনি কী-বোর্ডের মাধ্যমে মেশিনের প্যানেলের অপারেশনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন এটিএম মেশিনের সঙ্গে সেন্ট্রাল সার্ভারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর প্রয়োজনীয় কমান্ড দিয়ে টাকা উত্তোলন করে নেয়।’

এস আই অর্ণব বড়ুয়া আরও জানিয়েছেন, শরীফুলের কাছ থেকে অনলাইনে সংগ্রহ করা চাবি, ক্লোন করা ক্রেডিট কার্ড, তারবিহীন কী-বোর্ডসহ আনুষঙ্গিক অন্তত ২০ ধরনের সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। এছাড়া তাদের কাছে একটি এলজি এবং একটি কার্তুজ ও একটি ছোরা পাওয়া গেছে। শরীফুলের বিরুদ্ধে ঢাকা-চট্টগ্রামে সাতটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।