সায়েদুল ইসলাম
বিবিসি বাংলা, ঢাকা

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে বিপুল ব্যবধানে পিছনে ফেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয় হওয়া বাংলাদেশের জন্য কী অর্থ বহন করে?

এটা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিরও কারণ, আবার অস্বস্তিরও কারণ। বলছেন ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী।

অস্বস্তি:

গৌতম লাহিড়ী বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তির বিরোধিতা করেন। ফলে তার জয়ের ফলে বাংলাদেশে একটা আশঙ্কা হয়তো তৈরি পারে যে, তিনি কি সেই চুক্তির এখনো বিরোধিতা করে যাবেন?

”কিন্তু মমতা ব্যানার্জীর যেটা যুক্তি, তিস্তার যেখান উৎস, সিকিমে অনেকগুলো বাধ নির্মাণ হওয়ার ফলে তিস্তায় পানি প্রবাহ অনেক কমে গেছে। ফলে পানির সঞ্চার আরও বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া উচিৎ। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে নদী উপত্যকা পরিচালন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে একটি প্রাথমিক আলোচনা চলছে। পানির সঞ্চার বেশি হলে মমতা ব্যানার্জী হয়তো আর আপত্তি করবেন না।” বলছেন দিল্লির এই সিনিয়র সাংবাদিক।

তবে বাংলাদেশে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও তিস্তা ইস্যুতে রাতারাতি কোন পরিবর্তন হতো বলে তার মনে হয় না।

”অনেকে ভাবতে পারেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বাংলাদেশের এক ধরনের বোঝাপড়া হয়েছে। তাহলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তিস্তা চুক্তি হয়তো হয়ে যেতো বলে তাদের ধারণা”।

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতায় আছে মমতা ব্যানর্জিী তৃণমূল কংগ্রেস দল

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় এক দশক ধরে ক্ষমতায় আছে মমতা ব্যানর্জিী তৃণমূল কংগ্রেস দল

কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সমস্যা কিন্তু পানির সমস্যা নয়। সমস্যা হলো, তিস্তার পানি অভ্যন্তরীণ ভোটের রাজনীতির একটি বিষয়ে পরিণত করা, বলছেন মি. হোসেন।

”সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে মার্জিনাল ভোট নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলেও, তারা কি প্রথমেই একটি অস্ত্র তুলে দিতো মমতার হাতে যে, দেখো-আমি ছিলাম, আমি তোমাদের তিস্তার পানি রক্ষা করেছি, বিজেপি এসেই এটা দিয়ে দিয়েছে? কাজেই আমার মনে হয় না, ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেই যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হতো, আমি সেটা মনে করি না।”

তিনি মনে করছেন, কেন্দ্রের সরকার আর পশ্চিমবঙ্গে আগের মতোই একই শাসক থাকায় বর্তমান পরিস্থিতির খুব একটা অদল বদল ঘটবে না।

”আমি মনে করি না, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক, তাতে এই নির্বাচনের ফলাফল বড় কোন ভূমিকা রাখবে। পরিবর্তন তো কিছু হয়নি। মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় ছিলেন, তিনিই আসছেন, বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় ছিল, তারাই থাকছে”।

“সত্যিকার অর্থে স্ট্যাটাস তো একই থাকছে”, বলছেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন।

তৃণমূল কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় মমতা ব্যানার্জীকে বর্ণনা করছে 'বাংলার নিজের মেয়ে' বলে

তৃণমূল কংগ্রেস তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় মমতা ব্যানার্জীকে বর্ণনা করছে ‘বাংলার নিজের মেয়ে’ বলে

স্বস্তি:

দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বলছেন, মমতা ব্যানার্জীর বিজয় বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিরও কারণ।

”বিজেপি সরকার বলেছিল, তারা পশ্চিমবঙ্গে জয়ী হয়ে প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে তারা সিএএ বা সিটিজেনশীপ অ্যামেন্ডমেন্ড অ্যাক্ট পাস করবেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আইনের বিরোধিতা করে আসছেন। ফলে একটা বিষয়ে বাংলাদেশ নিশ্চিত থাকবে যে, সিএএ বা এনআরসি- আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেও অন্তত এই দুইটি বিষয় বাস্তবায়ন হচ্ছে না।” বলছেন মি. লাহিড়ী।

এছাড়া দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক বা অন্য সম্পর্কের ব্যাপারে মমতা ব্যানার্জী ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবেন বলেই তিনি মনে করছেন।

এই বিষয়ে দ্বিমত নেই তৌহিদ হোসেনেরও।

”বিজেপিতো আসাম, ত্রিপুরায় এর মধ্যেই ক্ষমতা তো পেয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গেও ক্ষমতায় এলে এখানে কম্যুনাল (সাম্প্রদায়িক) কিছু আশঙ্কা বাংলাদেশের তৈরি হতে পারতো, সেটা হয়নি, এটা বাংলাদেশের জন্য বেশ একটি স্বস্তির বিষয়।” বলছেন বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব।

শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা ব্যানার্জী

২০১৭ সালে দিল্লির এক অনুষ্ঠানে একই ফ্রেমে শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদী এবং মমতা ব্যানার্জী। গত মার্চ মাসে রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসে পশ্চিমবঙ্গের মতুয়াদের ভোট টানার জন্য গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দীতে নরেন্দ্র মোদী এক সভা করার পর ক্ষুব্ধ হয়ে মমতা ব্যানার্জী ঘোষণা করেছিলেন, তিনি আর কখনো প্রধানমন্ত্রী মোদীর সাথে ঢাকায় যাবেন না।

শঙ্কা:

ভারতের সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী একটি শঙ্কার কথাও বলছেন।

কিছুদিন আগে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের সময়কার কিছু বিষয় নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন মমতা ব্যানার্জী।

সেই সময় নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশে এসে গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দির মতুয়া সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন। তা নিয়ে নির্বাচনী জনসভায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জী।

সেই প্রসঙ্গ টেনে দিল্লির সিনিয়র সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বলছেন, ”তাকে যেভাবে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা করেছে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট আদায়ের জন্য, রাজনৈতিক কর্মসূচী করার জন্য, ফলে মমতা ব্যানার্জী ক্ষুব্ধ হয়ে একটা মন্তব্য করেছিলেন, যতদিন নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী থাকবে, আমি তার সঙ্গে ঢাকায় যাবো না।”

‘ঢাকা-কলকাতার মধ্যে যে যৌথ প্রকল্পগুলোর কথা চলছে, সেখানে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন। এখন সত্যিই যদি তিনি সেই ধরনের অসহযোগিতা করেন, তাহলে রাজনৈতিক কারণে একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে”, বিবিসিকে বলছিলেন গৌতম লাহিড়ী।

তবে মি. লাহিড়ী মনে করেন, ”এবারের যে বিপুল জয়, তাতে মমতা বন্দোপাধ্যায়ও মনে করেন, তার ওপর অনেক দায়িত্ব বেড়ে গিয়েছে। ফলে তাকে এমনকি জাতীয় স্তরের নেত্রী হতে গেলে সেই ধরনের একটা উদার মনোভাব দেখাতে হতে পারে।”