॥ মো.আবুল বাশার নয়ন ॥

১) চারিদিকে যখন অপরাধ দিনদিন বাড়তেই থাকে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হয়। কোন মতেই প্রশাসন যখন তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না ঠিক তখনই দুর্দান্ত সাহসী ও সৎ পুলিশ অফিসার পাঠানো হয়। আর ওই পুলিশ অফিসার তার সৎ সাহসকে পুঁজি করে জনগণের শান্তির জন্য দিনরাত এক করে সকল অন্যায়কে বিতাড়িত করে সন্ত্রাস দমনে সফল হয়। বলছিলাম চলচ্চিত্রের কাহিনীর কথা যেমনটা আমরা প্রায়ই সিনেমায় দেখে থাকি পুলিশের ভূমিকায় নায়কের অভিনয়। একজন সৎ ও সাহসী পুলিশ হিসেবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শত বাধা অতিক্রম করে সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। এমনটা শুধুমাত্র সিনেমাতেই দেখে থাকি।

২) আপনি ন্যায়, অন্যায় যাই- করুন না কেন আপনার শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ক্লায়েন্ট সবসময় আপনার উপর অসন্তুষ্ট থাকবে। আপনার কাজ যদি আপনি ঠিক ভাবে করেন তাহলে অন্যায়কারী পক্ষের লোকেরা আপনার কুৎসা গাইবে। প-িত জহুরলাল নেহেরু তাঁর একটি পার্লামেন্টারী ভাষনে বলেছিলেন- ‘একটি জঙ্গি মিছিলে যে লোকটি ইঁট দিয়ে পুলিশের মাথা ফাটালো সে হয়ে যায় নায়ক। মিডিয়াতে তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু যে গরিব কনস্টেবলটি তাঁর কর্তব্য করতে আহত হল- তাঁর খোঁজ কাকপক্ষীও নেয়না। (সহকারী পুলিশ কমিশনার মাশরুফ হোসেনের লেখার অংশ বিশেষ)।

৩) প-িত নেহেরু কি জানতেন একবিংশ শতাব্দিতে এসে বান্দরবানের দূর্গম বাইশারীতে তাঁর লেখা বাস্তবতার সাথে মিলে যাবে! তাই আমি পুলিশ কর্মকর্তার হেরে যাওয়ার আক্ষেপ মানতে নারাজ। গত ৭ সেপ্টেম্বর বাইশারী পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র থেকে বিদায় নিয়েছেন সাবেক ইনচার্জ এসআই আবু মূসা। যতদূর জানি, তিনি ছিলেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রেগুলোর মধ্যে কনিষ্ঠ সদস্য ও সাহসী অফিসার। বাইশারী যেমন বাণিজ্যিক সম্ভাবনাময়ী এলাকা তেমনি ভৌগলিকগত কারণে সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তাই এই পুলিশ কর্মকর্তাকে ২২ মাসের কর্মকালীন সময়ে অনেক ঝড় ঝাপটা মোকাবেলা করতে হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এ জন্য তাঁকে বিভিন্ন সময় হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তারপরও তিনি পিছুপা হননি। নাছোঁড় বান্দা পুলিশ অফিসার আবু মূসা একে একে সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্য আবদুস সালাম ডাকাত, গিয়াস উদ্দিন ডাকাত, তারেক ডাকাত, মতলব ডাকাত, নুরুল হাকিম ডাকাত, শফিউল আলম ডাকাত, জসিম উদ্দিন প্রকাশ পেটি জসিম, সেলিম ডাকাত ও জাহাঙ্গীর ডাকাতসহ ৯জনকে গ্রেফতার করে ছত্রভঙ্গ করে দেন বাহিনী। কর্মকালীন সময়ে আইন শৃংখলা রক্ষায় পাহাড়ী-বাঙ্গালীদের সাথে সার্বক্ষনিক মতবিনিময়, উঠান বৈঠক, সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানের কারণে একসময় সন্ত্রাসীদের কাছে আতংকিত হয়ে পড়েন আবু মূসা। অপরদিকে সামাজিক উন্নয়ন ও দেশাত্ববোধ কাজের জন্য প্রশংসিত হন এলাকায়। তাঁর লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসী বাহিনী প্রধান (আনাইয়্যা)কে আইনের আওতায় এনে পুরো বাহিনী গুড়িয়ে দেয়া। এতে করে একটি সন্ত্রাসী বাহিনীর পতন ঘটবে আবার তাঁর জীবনের একটি বড় প্রাপ্তি পিপিএম পুরষ্কারও অর্জন হবে! এজন্য তিনি মেধা, শ্রম, অর্থ ব্যয় করে জয়ের সন্নিকটেই পৌছেছিলেন।

৪) ১১ সেপ্টেম্বর সাহসী এই পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর নিজের ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন ‘জিততে জিততে, হেরে গেলাম!’। তিনি আরো লিখেছেন- ‘চলে এসেছি পূর্বকর্মস্থল বাইশারী থেকে। কিন্তু অসংখ্য মানুষ যখন ফোন করে আমাকে মিস করার কথা বলে, সম্মৃতির কথা বলে, শুভ কামনার কথা বলে ভালই লাগে। দোয়া চাই যেন মানুষের উপকার করে বাকি পথ চলতে পারি!!!

জিততে জিততে হেরে গেলাম, আর আনোয়ার ডাকাত মরতে মরতে বেঁচে গেল। দুর্ভাগ্য আমার পিপিএম পুরষ্কার হাতছানি দিয়ে ডাকলেও পাওয়া হল না আমার। ষড়যন্ত্রের কমতিও ছিলনা। কিছু নেতা নামধারী বদমাশ বা লফিনি কে পাত্তা দিইনি, তাদের ইচ্ছে মতো চলিনি। সাদা পোষাক পরে তারা ভাব নেয় ভাল মানুষের, অথচ খারাপ জগতের সর্দার হয়ে কলকাঠি নাড়ে রাত গভীর হলে। নর্দমার কীটের মত এরকম মানসিকতার কিছু মানুষ বারে বারে ঘায়েল করে যাচ্ছিল আমাকে। অপরদিকে যাদের বুঝা উচিত ছিল তাদের মন নোংরা হলে ভাল টা বুঝার সাধ্য কী আর তাদের থাকে? নোংরা মনের লোকেরা সর্বদা নোংরাটাই বুঝে নেয়। নয় জন ডাকাত ধরে কোর্টে পাঠিয়েছি। যারা এরপরও আমাকে ভাল বুঝেনি তাদের বোধয় বুঝার ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ’।

দীর্ঘ ২২ মাস একটি ক্রাইমজোনের এলাকায় তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বে থেকে অনেক কষ্ট করেছি, ঘাম ঝরিয়েছি আর নিজের শরীর, পরিবার সব ভুলে মানুষের নিরাপত্তা ও কল্যানে কাজ করেছি। আমি বাইশারীর শান্তির জন্য জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ করেছি। টাকার পিছু ছুটিনি, স্বার্থের কাছে নত হইনি। শুধু শান্তির জন্য ছুটে চলেছিলাম। মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য আমার এ ছুটে চলা যেন অভিরাম থাকে সে জন্য সবার দোয়া চাই’।

৫) ষ্পষ্টভাষী এই পুলিশ কর্মকর্তা তাঁর লেখায় যেভাবে স্বপ্ন ভঙ্গের কথা বলেছেন তেমনি ক্ষোভ আর ষড়যন্ত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি কেনই বা লিখবেন না, সন্ত্রাসী আটক আর অভিযানের আগাম তথ্য ফাঁস হয়েছে স্থানীয় মানুষের মাধ্যমেই। পুলিশ যত কৌশল নিয়েছেন সন্ত্রাসীরা পুলিশ বাহিনীর উর্দ্ধতন মহলে ততই রিউমার ছেড়েছেন। সুকৌশলী সন্ত্রাসীরা এসআই আবু মূসাকে কর্মস্থল থেকে সরিয়ে নিতে রাবার শ্রমিকদের মাধ্যমে প্রশাসনকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এই আল্টিমেটামের সপ্তাহের মধ্যেই বদলি হয়েছেন তিনি।

গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে মাঠে থাকার কারণে কাছ থেকে তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করা দেখেছি। দায়িত্ব পালনের সময় যত সমস্যাই আসুক না কেন তিনি পিছুপা হননি। দায়িত্ব পালনে সদা তৎপর ছিলেন। আমরা গণমাধ্যমের কর্মীরাও ভাবতাম তাঁর সাহস নিয়ে। তিনি দেশের জানমাল রক্ষার্থে যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তা দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়েই করেছেন। বাইশারীর আইন শৃংখলা পরিস্থিতির কথা কারো অজানা নয়। বাইশারীবাসির কাছে তিনি স্মরনীয় হয়ে আছেন, থাকবেন আজীবন।

উপসংহার: দীর্ঘ ২২ মাসের কর্মকালীন সময়ে এসআই আবু মূসা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য ৭বার পুরষ্কৃত হয়েছেন। ছত্রভঙ্গ করেছেন সন্ত্রাসী বাহিনী। আটক করেছেন ৯ দুর্ধষ ডাকাত। সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জাতীয় দিবসগুলোর মাধ্যমে দুর্গম এলাকার মানুষের মাঝে দেশাত্ববোধ জাগ্রত করেছেন। এই যদি হয় দেশপ্রেমিক আবু মূসার অপরাধ! তাহলে এমন অপরাধি পুলিশ অফিসার রাষ্ট্রের প্রতিটি থানায় সৃষ্টি হউক……।

লেখক: মো.আবুল বাশার নয়ন গণমাধ্যমকর্মী।