আব্দুল আলীম নোবেল 

লেখাটি পড়তেই অনেকের আঁতে ঘাঁ লাগবে। কারণ এখন রোহিঙ্গা কারো কাছে আর্শিবাদ আবার কারো কাছে অভিশাপ। এইজনপদের মানুষের রোহিঙ্গাদের আচার আচরণ সর্ম্পকে ভাল ধারণা আছে। কোথায় তারা নিরাপদ হবে, কোথায় তারা অনিরাপদ হবে। স্থানীয়দের সাথে মতামত না নিয়ে ভাসান চরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়টি বরাবরেই ভুল সিন্ধান্ত। সম্প্রতি সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে শিঘ্রই এক লাখ রোহিঙ্গা ভাসান চরে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা আমাদের মতে ভুল সিন্ধান্ত। তারা বর্তমানে যেখানে আছে, সেখানে ভাল আছে। তাদেরকে বেশি নড়াচাড়া করলে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যে কোন মুহূর্তে কর্তৃপক্ষের এমন সিন্ধান্ত ‘রোহিঙ্গা ক্যান্সার’এ আক্রান্ত হতে পারে বাংলাদেশ। তারা জাতি হিসাবে চরম অভাগা। তাদের নিয়ে কারা কোন খেলায় নেমেছে খোদাই ভাল জানে। তারা এমনিতে বিশ্বায়নের কিছু জ্ঞান পাপিদের কূটনৈতিক কূটচালে পড়ে আজ ঘরহারা, বিশ্বের সর্ববৃহৎ নির্যাতিত একদল মানুষ রোহিঙ্গা। সবকিছু বুঝেও মানবতার হাতবাড়িয়ে দিয়েছেন এই মানুষ গুলোর জন্য এই দেশের মহান প্রধানমন্ত্রী। এতে যার মুকুটে ওঠেছে বিশ্ব মানবতার মহা সম্মান। আনুমানিক ১৫ লক্ষাধিক মানুষের অতিরিক্ত চাপ সইতে যাকে প্রতিনিয়ত হিমসিম খেতে হচ্ছে। আশাকরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন সিন্ধান্তে আরো অনেক বেশি সজাগ হবে।

কোন জিও এনজিও’র পরামর্শে যদি ভাসান চরে রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়া হয়, এটি হবে আরেক বড় ভুল। এদেরকে ভাসান চরে নিলে কিছু দিনের মধ্যে পুরো দেশে ছড়ি পড়বে। তারা যে নিয়ন্ত্রনের বাইরে যাবে না, এমন নিশ্চয়তা কে দেবে বলেন তো? আমরা দেখতে পাচ্ছি কূটনৈতিক প্রচেষ্ঠায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মোটেও সুখের নয়। এটি বিশাল জটিলতায় দিকে মোড় নিচ্ছে। স্বল্প সময়ে এই মানুষ গুলো তাদের ঘরে ফেরা হবে না। অনেক দিন থেকে যাবে এমনটি মনে হচ্ছে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতার বিবেচনায় এই ধারনাটি মোটেও অমূলক নয়।

জাতি হিসাবে তারা কিছুটা উগ্র। এই অভাগা জাতিকে এমন একটি কড়া বাক্য বলতে আমারও কষ্ট হচ্ছে,এটা তাদের বাস্তবতার নির্মম পরিহাস। গেল কিছু দিনের মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। এই অপ্রীতিকর ঘটনায় আমাদেরকে রীতিমত চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের আরো অনেক বেশি ভাববার সময় এসেছে। এই দুর্ভাগা মানুষ গুলোকে নিয়ে জানিনা কে কোন খেলায় দাবার চাল চালছে। মনে রাখবেন বল কিন্তু এখনও আমাদের কোর্টে আছে।

অপর দিকে রোহিঙ্গাদের অতীতের দিকে থাকালে দেখাযায় তাদের আরেক ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা। রোহিঙ্গারা আজ পৃথিবীর সবচাইতে দুর্ভাগা জাতি। যারা বার বার নির্যাতিত হচ্ছে এক সমরে আরকার রাজ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী অঞ্চল ছিল। আমরা অনেকেই আরকান রাজসভার সাথে পরিচিত। আকিয়াব বন্দর অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বন্দর। এটাকে উদ্দেশ্য করে চলছে রাজনৈতিক খেলা। ইতিমধ্যে ভারতের ‘অ্যাক্ট ইষ্ট’ নীতি এবং চীনের ‘বেল্ট এন্ড রোড’ প্রকল্পের জন্য মিয়ানমারের আরাকান যা নাকি রাখাইন হিসাবে পরিচিত এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই হয়েছে সব সমস্যা আর তাই চীন বা ভারত রোহিঙ্গা সমস্যাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না যাদের বেশী গুরুত্ব দেয়ার কথা ছিল তারাই নির্বিতার আর এজন্য বিশাল চ্যালেঞ্জে পড়েছে বাংলাদেশ। না পারছে ফেলতে না পারছে গিলতে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য এগিয়ে এসেছে তুরস্ক, মালয়েশিয়া, বৃটেন ও যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ। এগুলো শুধুই মানবিক, স্থায়ী সমাধানের রাস্তা কেউ দেখাচ্ছে না। রাখাইনে বেশ বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প রয়েছে ভারত ও চীনের। ভারতের অর্থায়নে মালিট মডেল প্রকল্পের আওতায় নদী ও সমুদ্রের মাঝে সংযোগ তৈরী হচ্ছে এতে করে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হবে সাত বন্দর। আর চীনের অর্থায়নে শুরু হয়েছে কিয়াক ফু বন্দর। এর মাধ্যমে তৈল গ্যাস পাইপলাইন ও রেলপথ যুক্ত হবে চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে যদিও বা এ সকল প্রকল্প এলাকার উপর সংহিংসতার আশঙ্কা করছে দিল্লী ও বেইজিং। কিয়াক ফু বন্দরের ৮৫ শতাংশ মালিকানা থাকছে চীনের এবং এই বন্দর তৈল ও গ্যাস সরবরাহের প্রধান প্রবেশ পথ। আবার অন্যদিকে জাপানের অর্থায়নে থিলাওয়া ও দায়েইত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরীর কাজ চলছে। চীন, ভারত, জাপান এরা কেউই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে না আর এর দায়ভার পড়ছে বাংলাদেশের উপর। চীনকে প্রাধান্য দেয়াতে মিয়ানমার উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারে আর সেক্ষেত্রে দূর্বল রোহিঙ্গা জাতীকে ব্যবহার করছে হাতিয়ার হিসাবে। ব্যাপারটা একটু সুক্ষ্ম ভাবে চিন্তা করলেই সহজে বুঝা যায় কেন এই জাতীর উপর খড়গ নেমে এসেছে তারই ফলে বাস্তু হারা হয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা, মূলত মিয়ানমারের সামরিক সমর্থিত সরকার রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে তার অভ্যন্তরীণ উগ্র জাতীয়তাবাদকে নিস্তেজ করছে। চীন সব সময় তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের প্রয়োজনে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারকে প্রাধান্য দিচ্ছে আর এতে করে চাপ সইতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। হিমসিম খাচ্ছে এ সকল রোহিঙ্গাদের সামাল দিতে।

মূল বিষয়ে আসা যাক, অভিশাপ কথাটা খুব নিষ্ঠুরভাবে কানে লাগে। আর এই অভিশপ্তর করাতে আজ রোহিঙ্গা সমস্ত দায় নিমজ্জিত। যারা নিজেরা নিজেদের সম্পদে বলিয়ান ছিল তারা আজ রাজনৈতিক কারণে অভিশপ্ত জাতিতে পরিণত হয়েছে। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ এর জায়গায় মানবতার জীবন আজ তাদের পাথেয়, কখন আসবে গাড়ী, কখন দিবে দুমুঠো খাদ্য, কিভাবে শিশু বাচ্চার মুখে দুধ দিবে, কিভাবে বাঁচায়ে রাখবে তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে, আজ অভাগা, অভিশপ্ত জাতির খাতায় তাদের নাম সামনে রেখে রাজনৈতিক হলি খেলায় মত্ত। হায়রে রাজনীতি! কিভাবে এ সকল দুর্ভাগা জাতিকে সাহায্য করা যায়, স্থায়ী সমাধানের রাস্তা কি এ সকল বিষয়ে চিন্তা না করেই আগে ভাগে কিভাবে জিও এনজিও রা তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে পারে তারা সেটিকে প্রধান্য দিচ্ছে। তার উপর আরও বিষয় রয়েছে বিশ্ব রাজনীতিতে শক্ত কুটনৈতিক ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে নিজের অবস্থানকে শক্ত করতে হয়। নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কাউকেও এত উদার ভাবাটা কেন জানি প্রশ্ন থেকে যায়। সেক্ষেত্রে চীন, ভারত তাদের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে স্থায়ী সমাধানের রাস্তা বের করবে এটা মনে হয় সুদুর পরাহত। এটা নিদ্বির্ধায় বলা যায় চীন-ভারত যদি চায়, আমার মনে হয় স্থায়ী সমাধান হবে।