মুহাম্মদ ওমর হামজা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য যিনি আন্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামকে দীন- দূনিয়ার নেতা মনোনীত করে স্বীয় উম্মাতকে নেতৃত্ব দানের নিমিত্ত প্রেরণ করেছেন। দরূদ ও সালাম সাইয়েদুল মুরসালীন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর যিনি ছিলেন জগৎদ্বয় জাতিদ্বয় (জিন ও মানুষ) এবং আরব অনারব শ্রেণিদ্বয়ের নেতা। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয়, মুহাম্মাদ (সা:) তাঁর বান্দা ও রাসূল। অতঃপর….
সম্মানিত ভাইগণ, আজকের জুমুআর আলোচনায় নেতৃত্ব সম্পর্কে কিছু বক্তব্য পেশ করার ইচ্ছা করছি।তবে আল্লাহর দেয়া জ্ঞান ছাড়া আমার এমন কোন জ্ঞান নেই যেই; বর্ণনা করার। সুতরাং তাঁর অশেষ রাহমতের উপর ভরসা করে আমি প্রথমত: নেতৃত্বের উন্মেষ সম্পর্কে চিন্তাশীল গবেষকদের একটি সাধারণ অভিমত তুলে ধরছি তা হলো : ‘সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ যখন সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের তাগিদ অনুভব করেছে নেতৃত্বের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তখন থেকেই’। যুগে যুগে সংঘবদ্ধ মানুষের শৃংখলাপূর্ণ জীবন পরিচালনার জন্য প্রয়োজন হয় একজন নেতার। ফলে সমাজ সংস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ সাব্যস্ত হয় নেতা ও নেতৃত্ব। বলা যায়- নেতৃত্ব হলো নেতার পদ বা পরিচালকের কাজ। ইংরেজি Lead হতে Leader এবং Leader হতে Leadership শব্দটি এসেছে ; যায় অর্থ হলো নেতৃত্ব। বিভিন্ন গবেষক নেতৃত্বের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। যেমন Newstorm ও Keith Devis এর মতে – নেতৃত্ব হলো উদ্দেশ্য অর্জনের নিমিত্ত অন্যান্য লোকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসাহিত এবং সাহায্য করার একটি প্রক্রিয়া। এভাবে বিভিন্ন সংজ্ঞা হতে নেতৃত্ব সম্পর্কে যে ধারনা পাওয়া যায় তাহতে বলা যায় যে, নেতৃত্ব বলতে এমন কিছু গুণ দক্ষতা বা কৌশলকে বুঝায় যার প্রভাবে দলীয় সদস্যরা তাদের সর্বাধিক সামর্থ্য অনুযায়ী উৎসাহ ও উদ্দীপনা সহকারে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে তৎপর হয়। রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানে নেতৃত্ব সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারনা পাওয়া যায়। যেমন : (১) সনাতন ধারণা – যা মূলতঃ একনায়কের ধারণা। এরিষ্টটলের মত আরও অনেকে মনে করেন যে, “কেহ কেহ শাসন করার জন্য এবং কেহ কেহ শাসিত হওয়ার জন্য জন্মগ্রহন করে।” (২) আধুনিক ধারণা : এ ধারণায় নেতা কোনক্রমেই একনায়কত্বের পরিচয় দিবেন না। বরং নেতা হবেন গণতান্ত্রিক। (৩) ইসলামিক ধারণা : ‘নেতৃত্ব ‘ অর্থজ্ঞাপক আরবি ও ইসলামি পরিভাষায় কিছু সমার্থক শব্দ রয়েছে। যেমন- ইমামত,ইমারত, সিয়াদত, কিয়াদত, রিয়াসত,যিআমত এবং খিলাফত প্রভৃতি। তবে খিলাফত একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও ব্যাখ্যা সাপেক্ষ শব্দ। কুরআন শরীফে একবচনে ‘ইমাম’ এবং বহুবচনে ‘আইম্মা’ শব্দটি একাধিক স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলামি বিশ্বকোষ এর ভাষ্য মতে কুরআন মাজীদে ইমাম শব্দটি একবচনে ছয়বার ও বহুবচনে পাঁচবার এসেছে। ইমাম শব্দের অর্থ চিহ্ন, নিদর্শন, কিতাব, পথ, নেতা ইত্যাদি। ইমাম অর্থ নেতা বা খলীফা এ অর্থে যে, যার নিকট থেকে হেদায়ত লাভ করা যায়, যাঁকে অনুসরণ ও অনুকরণ করা হয়। আর ইমামত হলো নেতৃত্ব দেওয়া, ইমামতি করা, রাজত্ব করা, শাসন কার্য পরিচালনা করা, রাজ্য পরিচালনা করা। নামাযে ইমামতি করাকে বলা হয় ইমামতে সুগরা বা ছোট ইমামত। আর জাতির নেতৃত্ব দেওয়া, রাজ্য পরিচালনা করা, রাজ্যের বা সমাজের আদেশ নিষেধের অধিকার দেওয়াকে বলা হয় ইমামতে কুবরা (বড় ইমামত)। সুতরাং ইমামের নেতৃত্ব দান করাকে ইমামত বলে । ইসলামে ইমামের গুরুত্ব অপরিসীম। আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় দিক থেকে যিনি সমাজে নেতৃত্ব দান করেন তাঁকেই ইমাম বলা হয়। এ অর্থেই আল্লাহ তা’আলা হযরত ইব্রাহীম (আ)- কে মানব জাতির ইমাম ঘোষণা করেছেন। তা’ ছাড়া আমাদের আলোচনায় উল্লেখিত ‘নেতৃত্ব’ অর্থজ্ঞাপক অপরাপর যে সব শব্দাবলী রয়েছে তা বিভিন্ন পদ পদবীর অধিকারী বা দায়িত্বশীল প্রশাসনিক মর্যাদাবান ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে পৃথক পৃথকভাবে ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ইসলামি আরবি পরিভাষায় ‘ ইমারত ‘ শব্দটি ও নেতৃত্ব অর্থে বহুল ব্যবহার হয়। আলোচনার স্পষ্টকরণার্থে ইমারত শব্দের মর্মার্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে সম্যক আলোচনা প্রয়াস পাব।
ইমারত অর্থ নেতৃত্ব। ইমারতের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বলা হয় আমীর। অর্থাৎ আমর বা নির্দেশ যার পক্ষ থেকে আসে সে ই আমীর বা উলিল আমর। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে আসল আদেশদাতা, হুকুমকর্তা একমাত্র আল্লাহ। সূরা ইউসুফের ৪০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন,” হুকুম দেওয়ার অধিকার তো একমাত্র আল্লাহর “। আর সূরা আল ইমরানের ১৫৪ নম্বর আয়াতে ও আল্লাহ বলেন : ” যাবতীয় সার্বভৌম ক্ষমতা ও ফরমান দেওয়ার নিরংকুশ কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহরই জন্যই নির্দিষ্ট ” এবং সূরা আরাফের ৫৪ নম্বর আয়াতে বলেন: ” তোমরা ভাল করে জেনে নাও, গোটা সৃষ্টি ও আল্লাহর এবং সৃষ্টির সর্বত্রে হুকুম ও চলবে একমাত্র তাঁরই “। তা হলে আমীরের কাজটা এখানে কি? আমীরের কাজ হবে আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন। আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ-নিষেধের ভিত্তিতে মুসলিম উম্মতকে পরিচালনা করা। বস্তুত: ইসলামি নেতৃত্ব তিনটি শব্দের মর্মার্থের ধারক- বাহক।(১) খলীফা (২) ইমাম (৩) আমীর। এ স্থলে খেলাফত শব্দের তাৎপর্য নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। খেলাফত একটি রাজনৈতিক পরিভাষা। মহান আল্লাহ মানব জাতিকে খেলাফত দান করে আল্লাহর রাজ্য তাঁরই বিধান মোতাবেক শাসন করার প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন । খেলাফত অর্থ প্রতিনিধিত্ব। আর খলীফা অর্থ প্রতিনিধি। মানুষ মাত্রই আল্লাহর প্রতিনিধি বা খলীফা। এরপরও নেতাকে খলীফা বলা হয় কেন? অন্য কথায় খোলাফায়ে রাশেদীন কোন অর্থে খলীফা ছিলেন।একটু চিন্তা করলে এবং তাদের বাস্তব কাজের সাথে মিলিয়ে একে বিচার করলে দেখা যায় তারা তিন অর্থে খলীফা ছিলেন। (১) খলীফাতুল্লাহ বা আল্লাহর খলীফা হিসেবেই আল্লাহর দীন জারি করা ও আল্লাহর হুকুম আহকাম জারি করার দায়িত্বপালন করেছেন। (২) খলীফাতুর রাসূল, রাসূল (সা.)-এর অবর্তমানে তাঁরই কাজ আন্ঞ্জাম দিয়েছেন। মুসলমানদের মূল নেতা রাসূল (সা.),তারা মুসলমানদের পরিচালনা করেছেন কেবলমাত্র তাঁরই প্রতিনিধি হিসেবে। (৩) খলীফাতুল মুসলেমীন বা মুসলমানদের প্রতিনিধি। স্মর্তব্য যে, মানুষ মাত্রই আল্লাহর খলীফা। কিন্তু মানুষের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনে, ইসলাম কবুল করে তারাই এই প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করে যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা,তদারক করা ও নিয়ন্ত্রণ করা। খোলাফায়ে রাশেদীন এই তিন অর্থেই খলীফা ছিলেন। আজকেও ইসলামী নেতৃত্বকে উল্লেখিত তিন অর্থেই খলীফার ভূমিকা পালন করতে হবে।
সম্মানিত পাঠক মণ্ডলী,
নেতৃত্বের রয়েছে প্রকার এবং নেতা রয়েছে অনেক রকমের। যেমন: বিশেষজ্ঞ নেতা, বুদ্বিবৃত্তীয় নেতা, প্রশাসনিক নেতা, সংস্কার সাধনকারী নেতা, গণতন্ত্রী নেতা ও স্বৈরাচারী নেতা। প্রত্যেক প্রকারের নেতার সংজ্ঞা কি? নেতৃত্বে কাকে বলে এবং নেতা হয়েই কেউ জন্মায় কি-না? এসব সম্পর্কে সমাজ মনোবিজ্ঞানীদের বহু রকম তত্ত্বকথা রয়েছে। ব্যবহারিক জীবনে সেগুলোর গুরুত্ব শূন্যের কোঠায় মনে করে তার উল্লেখ পরিত্যাগ করলাম। তবে সুষ্ঠু নেতৃত্ব নির্বাচন ক্ষেত্রে নেতৃত্বের মোহ না থাকা ও নেতার দায়িত্ব সম্পর্কে আয়াতে কুরআন ও হাদীসে রাসূল (সা.) এর আলোকে গুরুত্বপূর্ণ দুয়েকটা কথা বলা প্রয়োজন। যেমন : (১) ইসলাম নেতৃত্ব যাচ্ঞা বা প্রার্থনা করা নিষিদ্ধ করেছে। ইসলাম নেতৃত্ব বা পদের জন্য যারা উন্মুখ বা যারা নেতৃত্বের যাচ্ঞা করে তাদেরকে সেটা দিতে প্রস্তুত নয়। কেননা, নেতৃত্বের প্রতি মোহ বা নেতৃত্ব প্রার্থনা ব্যক্তি স্বার্থেরই ইঙ্গিত বহন করে। মুসলিম শরীফ ২য় খন্ডে উদ্বৃত একটি হাদীসে নবী (সাঃ) ইরশাদ করেছেন: ” যে নিজে পদ যাচ্ঞা করে আমরা তাকে পদ দেই না।” আল্লামা নববী এ হাদীস থেকে প্রমান করেছেন যে, নেতৃত্বের প্রতি মোহ ও নেতৃত্ব যাচ্ঞা করা নিষেধ। এ প্রসংগে বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত সাহাবী আবদুর রহমান ইবনে সামুরা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসটি স্ববিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেন, নবী (সাঃ) আমাকে বলেছেন ঃ ” হে আবদুর রহমান ইবনে সামুরা! নেতৃত্ব চেয়ে নিও না। কেননা, যদি চাওয়ার পর তুমি তা প্রদত্ত হও, তা হলে তার সকল দায় দায়িত্ব তোমার উপরই অর্পিত হবে। আর যদি না চাওয়া সত্ত্বেও তুমি তা প্রদত্ত হও, তাহলে এ ব্যাপারে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সহযোগিতা করা হবে ।” উলামায়ে কিরাম এ হাদীসের ব্যাখ্যায় নেতৃত্ব যাচ্ঞা করলে সহযোগিতা হারানোর একটা কারণ উল্লেখ করেছেন যে, এতে করে উক্ত নেতার প্রতি মানুষের মনে অভিযোগ থেকে যায়।(নব্বী) মানুষ তাকে নিঃস্বার্থ ভাবতে পারেনা, যার ফলে সাহায্য সহযোগিতা করতে উদ্বুদ্ধ হয় না। তবে কুরআনে বর্ণিত ইউসুফ (আঃ) দেশের ধন ভান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত করার জন্য মিসরের বাদশাহর নিকট এই বলে আবেদন করেন, ” আমাকে খাদ্য ভান্ডারের দায়িত্ব দাও। এই চাওয়ার ব্যাখ্যায় তাফসীরবিদগণ বলেছেন যে, বিশেষ সরকারী পদ নিজে উপযাচক হয়ে গ্রহন করা জায়েজ। তবে এক্ষেত্রে শর্ত এই যে,প্রভাব প্রতিপত্তি ও অর্থ কড়ির মোহে নয়, বরং অভিজ্ঞতা ও আমানতদারী এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্য থাকতে হবে।
সুপ্রিয় পাঠক মন্ডলী,
আমরা মনে করি যে, নেতৃত্ব একটি মহান দায়িত্বপূর্ণ বিষয় এবং নেতার কাঁধের উপর বিশাল দায়িত্ব ভার। সুতরাং স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতে হবে এ জগতে ও পর জগতে। এ জবাবদিহিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, জেনে রাখ! তোমরা প্রত্যেকই দায়িত্বশীল আর তোমরা প্রত্যেকই স্বীয় দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নেতা বা ইমাম/আমীর দায়িত্বশীল, সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। আল্লাহ তা’আলা সকল নবী -রাসূলকে মনোনীত করেছেন এই বলে :” এবং তাদেরকে করেছিলাম নেতা ; তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করতো ;তাদেরকে ওহী প্রেরণ করেছিলাম সৎকর্ম করতে, সালাত কায়েম করতে এবং যাকাত প্রদান করতে ;তারা আমারই ইবাদত করতো।”

মুহাম্মদ ওমর হামজা
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ
খুটাখালী তমিজিয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা।