বদরুল ইসলাম বাদল

“ঘর পোড়া গরু সিঁধুরে মেঘ দেখে ভয় পায়”। এমনই অবস্থায় দিনাতিপাত করছে বৃহত্তর চকরিয়া উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা।গতকাল (২৭ আগষ্ট ২৩) চকরিয়া উপজেলা সহ বিভিন্ন জায়গায় থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। এরিমধ্যেই আতঙ্কিত হয়ে উঠে এই জনপদের মানুষ। উপজেলার ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সাংবাদিক ও সমাজকর্মী কপিল উদ্দিন নিজের ফেইসবুক টাইমলাইনে বৃষ্টির কারণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লেখেন, “সারারাত বৃষ্টি হচ্ছে, আবারও বন্যার আশঙ্কা, আমাদের রক্ষা করুন মাবুদ”।ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ নেতা মুজিবুর রহমান লিখেছেন,” সকাল থেকে খুব বেশি বৃষ্টি হচ্ছে দায়িত্বশীলদের প্রতি অনুরোধ স্লুইচ গেইট খোলা রাখার জন্য”।বদরখালীর একজন বয়স্ক মুরুব্বির সাথে আলাপকালে তিনি বলেন,” আমাদের আতঙ্কের কারণ বৃষ্টির জন্য নয়। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বর্ষাকালে বৃষ্টি হবে, বৃষ্টি হচ্ছে।বৃষ্টি না হলে রোপা আমন বপন করা যাবে না,রোপিত হলেও বেড়ে উঠবে না”। বৃষ্টি সৃষ্টিকর্তার অপরিসীম রহমত।কিন্তু বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি স্বাভাবিক গতিতে সাগরে বের হতে পারছে না, প্রতিবন্ধকতায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির হচ্ছে,সে চিন্তাতেই নির্ঘুম রাত যাপন করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।বিগত কিছুদিন আগেও বন্যায় লন্ডভন্ড হয়ে যায় চকরিয়া পেকুয়ার বৃহত্তর অংশ। যার ক্ষত এখনো বয়ে চলছে মানুষ। তার মধ্যে আবার বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা কিংবা নতুন করে বন্যা হলে মানুষ অবর্ণনীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তাই বৃষ্টির পানি প্রতিবন্ধকতা বিহীন বের হয়ে যাওয়ার জন্য সমস্ত স্লুইস গেইট খোলা রাখার আকুতিতে বিলাপ করছে হতদরিদ্র মানুষগুলো।ভঙ্গুর বেড়িবাঁধ জরুরি ভিত্তিতে অগ্রাধিকারের সহিত নির্মাণের আবেদন করছে তাঁরা। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। ছোট বড় অসংখ্য নদী জালের মতো বিছিয়ে রয়েছে দেশজুড়ে । স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশের মানুষ নদীর দুই কিনারে বসতি স্থাপন করে আসছে। এদেশের মানুষের জীবনজীবিকার অন্যতম অবলম্বনও নদনদী। ১ লাখ ৪৮ হাজার ৪৬০ বর্গকিলোমিটারের এই দেশে যত নদনদী রয়েছে যা অন্য কোথাও নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, এই মূল্যবান সম্পদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে ততটা যত্নবান নয় দেশের অধিকাংশ মানুষ। প্রতিনিয়ত নির্বিচারে নদীতে বাঁধ, , নদী দখল , অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনসহ মানুষের সীমাহীন অত্যাচারে যখন দিশেহারা হয়ে উঠে তখনই হিংস্র হয়ে অদমনীয় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে যায় নদী।সাম্প্রতিক সময়ে মাতামুহুরি নদীতে স্মরণ কালের ভয়াবহ বন্যাই নিকটতম উদাহরণ। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহালো বানভাসি মানুষ।

বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির মহাসচিব কোণাখালী ইউনিয়নের সন্তান আকতার উদ্দীন রানা মতামত তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, “বর্তমান সরকারের উন্নয়ন মহাযজ্ঞের সময়েও চকরিয়া উপকূলীয় মানুষ মাতামুহুরি নদীর পাড়ে টেকসই নিরাপদ বেড়িবাঁধ থেকে বঞ্চিত। ফলে প্রতিবছর জলোচ্ছ্বাস সাইক্লোন এবং পাহাড়ি পানি নামলেই বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় ডুবে যায়। জনগোষ্ঠী হারিয়ে ফেলে সহায়সম্পদ। উপকূলীয় এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পরিকল্পিত টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার, এবং পর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রেখে বাঁধ তৈরির দাবি জানান তিনি। নব্বই দশকের সাবেক এ ছাত্রনেতা আকতার উদ্দীন রানা গত শনিবার কোণাখালী ইউনিয়নের উপদ্রুত এলাকায় সর্বসাধারণের জন্য বিপুল ত্রাণ বিতরণ করেন।তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সমন্বয়ে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও জলাবদ্ধতার কারণ সমূহ চিহ্নিত করে সমাধানের দাবি জানান বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে।বিগত বন্যার অনেক আগে বন্যা নিয়ে সতর্কতার কথা তুলে ধরে সমাজকর্মী ফরিদুল আলম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছিলেন যে,” জোয়ারভাটা খাল নদী দখল করে মাছের ঘের করায় বিশাল জনপদ বন্যায় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা অতএব অবিলম্বে বন্ধ খাল খুলে দাও”। কিন্তু সে আওয়াজ কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত পৌঁছেনি কিংবা গুরুত্ব দেওয়া হয় নাই।।অবাধ পানিপ্রবাহের সমস্যা রয়েই যায় ।ফলে কয়েক দিনের বৃদ্ধির পানি এবং মাতামুহুরি নদীর পানিতে ফুলেফেঁপে স্মরণকালের ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জলাবদ্ধতা তৈরী হয়। বিগত ভয়াবহ বন্যায় জলাবদ্ধতার জন্য উপকূলে বেড়িবাঁধের বন্ধ স্লুইস গেইটকে প্রধানত চিহ্নিত করছেন জনসাধারণ । মূলত সরকারি এসব জলমহাল ইজারার মাধ্যমে একটি মহল চিংড়ি ঘের তৈরী করে রাখে। জাল দিয়ে মাছ ধরার সুবিধার্থে স্লুইস গেইট তক্তাদিয়ে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। শুষ্ক মৌসুমেও খালে লবণাক্ত পানি ঢুকিয়ে রাখে।ফলে লবণাক্ত পানির কারণে বিস্তৃত আবাদি জমিতে চাষ করা সম্ভব হয় না।এলাকার জনগণ এসকল জলমহাল ইজারা প্রথা বাতিল চায়।এনিয়ে মাননীয় জেলা প্রশাসক মহোদয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তাঁরা।

নদী ভাঙ্গন বাংলাদেশের অতি পরিচিত বিষয়। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে এসব বাঁধ ভেঙ্গে যায়।তাই ভয়াবহ বন্যার কারণ নির্ণয়, জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে পানি বিশেষজ্ঞ দ্বারা জরিপ এবং সেমিনার আয়োজন করে সমস্যা গুলো চিহ্নিত করার আবেদন সচেতন মানুষের ।বেদখল হয়ে যাওয়া মাতামুহুরি নদীর শাখা প্রশাখা উদ্ধার করে নদী দখলকারীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দরকার।রেল লাইনকে বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণের বিষয়টি সামনে চলে আসলো এবারের বন্যায়।হাইকোর্ট নদীকে “জীবন্ত সত্তা” হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও প্রাণ পাচ্ছে না নদী।নদী দখল করা ফৌজদারী অপরাধ হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের অবহেলার কারণে প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দেশের সব নদনদী খালবিল ও জলাশয়কে রক্ষার জন্য “জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন”কে আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করে হাইকোর্ট।বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চের সেই রায়ে নদী দখলদারদের নির্বাচন করার ও ঋণ পাওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করে।বিশেষজ্ঞদের অভিমত,নদী দখলদূষণের দায়ে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার আইন থাকলেও এখন পর্যন্ত কারও দণ্ড হয়নি।পূর্ব বড় ভেওলাবাসী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন ” মাতামুহুরি নদীর শাখা শাহারবিল মাদ্রাসার উত্তর পাশের ভরাট মাতামুহুরি, বেথুয়া বাজারের দক্ষিণ পাশের ভরাট পোড়া মাতামুহুরি নদী সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট বাড়ি নির্মাণসহ চিংড়ি ঘেরের কথা তুলে ধরেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে দখলবাজদের সাথে প্রশাসনের আপোষকামীতার কথা উল্লেখ করেন তিনি”।মাতামুহুরি নদীবেষ্টিত উপকূলীয় জনপদের মানুষ বড় অসহায়ের মতো দিনাতিপাত করছে। চোখের পলকেই চারপাশে অথৈ পানি কল্পনাকেও হার মানায়।কীভাবে কেমন করে বিনা নোটিশে দুয়ারে পানির করাঘাত হয়।মানুষের করুন ক্রন্দনে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে । মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির আদর জড়ানো কোলে মানুষ বেড়ে উঠে। প্রকৃতি বিরূপ হলে মানুষের জীবনটাও তাই হুমকির মুখে পড়ে।এককালে লোকালয়ের খালের উপর দিয়ে নৌকা চালিয়ে যেতো। মাছ শিকার, সেচ, গোসল, রান্নাসহ নানা কাজেই ব্যবহার করা যেত।এখন দেখা যায় সমস্ত খাল কচুরিপানায় ভরে গেছে। বছরের পর বছর এসব খালের কচুরিপানা পরিষ্কার না করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় মরে পঁচে গিয়ে আবর্জনা স্তূপ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন খালগুলো কচুরিপানা ভরে থাকার কারণে এলাকায় মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যায়, জোয়ার ভাটা পানি চলাচল ব্যাহত হয়ে পড়ে। সে কারণে একটু বৃষ্টি হলে সৃষ্টি করে জলাবদ্ধতা। ২০০০সালে প্রণীত প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী নদী খাল বিল দিঘী ঝর্ণা বা জলাশয় এলাকা এবং বৃষ্টির পানি ধারণ করে এমন কোন ভূমির শ্রেণির পরিবর্তন করা যাবে না। এগুলো ভরাট করা যাবে না।কিন্তু দেখা যায় এসকল খালে এলোপাতাড়ি দখলের মহাউত্সব চালাচ্ছে প্রভাবশালী মহল।ফলে প্রকৃতির সাথে চলা মানুষের কান্না থামছে না।বিশ্লেষকদের ধারণা,”কোন প্রগতিশীল আইন পাশ করলেও সে আইন যদি আমলাতন্ত্রের হাতে কার্যকরী করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তা হলে কৃষক কিছুই পাবে না”। (চারু মজুমদার অষ্টম দলিল)।কোণাখালী ইউনিয়নের, বিশিষ্ট নারীনেত্রী ও সমাজকর্মী বদরুন নাহার কলি মনে করেন, এ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টির অন্যতম কারণের মধ্যে কচুরিপানা ও মাছ ধরার জন্য খালে এলোপাতাড়ি বাঁধ দিয়ে রাখাকে দায়ী করেন।যার ফলে খালবিল ছড়াখাল জলাশয় ভরাট হয়ে পড়ে। খালবিল নদী হারিয়ে ফেলছে স্বাভাবিক পানি ধারনের ক্ষমতা।নদী শাসন সহ কচুরিপানা অপসারণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানান তিনি। যাতে অতিবৃষ্টি কিংবা পাহাড়ি পানি নামলেই দ্রুত ভাবে বাধাবিঘ্ন ব্যতিরেখে নিম্নমুখী হয়ে পড়ে পানি”।উল্লেখ্য যে খালবিল জলাশয় ভরাট করার বিষয়ে আইনি বিধিনিষেধ আছে, কেননা এসব কর্মকাণ্ডের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের জন্য দেশের ইতিহাসের প্রথম শতবছরের মহাপরিকল্পনা ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০” গ্রহণ করছেন। এই কর্মসূচির আওতায় নদীর তীর সংরক্ষণ, নদীর নাব্যতা রক্ষায় ড্রেসিং, খাল পুনঃখনন,প্রাকৃতিক জলাধার রক্ষণাবেক্ষণ এবং জলাবদ্ধতা দূর করতে জনসচেতনতা সহ বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। যার বাস্তবায়নে “ডেল্টা তহবিল” সংগ্রহ নিয়ে কাজ করছে সরকার।।তাই এই পরিকল্পনার আওতায় উপকূলীয় জনপদকে ঢেলে সাজানো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কার্যকর ভূমিকা আশা করছে জনসাধারণ। জনগণের ভাষা-ত্রান নয়,টেকসই উন্নয়ন। জলমহাল ইজারা প্রথার বাতিল।জয় বাংলা।
————————

সদস্য, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি।