হাফেজ মুহাম্মদ কাশেম, টেকনাফ:
টেকনাফ থেকে ছেড়ে যাওয়া ৪ শতাধিক মালয়েশিয়াগামী যাত্রী গত দুইদিন ধরে সাগরে ভাসছে। ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় উক্ত ট্রলারে থাকা যাত্রীর বরাত দিয়ে স্থানীয় বিশ্বস্থ সুত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সুত্র মতে গত কয়েকদিন আগে টেকনাফের উপকুলীয় এলাকা থেকে সাগর দিয়ে চোরাইপথে ৪ শতাধিক যাত্রী নিয়ে একটি বিশাল ট্রলার মালয়েশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। যাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশই রোহিঙ্গা। ট্রলারটি গত দুইদিন আগে মহাসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছাকাছি গিয়ে বিকল হয়ে পড়ে। এদিকে সাথে নেয়া রসদপাতিও ফুরিয়ে গেছে। ট্রলারে থাকা মালয়েশিয়াগামী যাত্রীরা মোবাইল ফোনে পরিস্থিতির কথা স্ব-স্ব আতœীয়স্বজনদের অবহিত করলেও তারা বিষয়টি প্রকাশ করছেনা।

এদিকে টেকনাফের উপকুল দিয়ে নিরবেই চলছে সমুদ্র পথে মানব পাচার। চলতি শীত মৌসুমে সমুদ্র অনেকটা শান্ত থাকায় সাগর পথে চরম ঝুঁকি নিয়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বাংলাদেশী কিছু মানুষও পাচারের শিকার হচ্ছে। তবে সাগরপথে ঝুঁকি নিয়ে পাচারের শিকার ভিকটিমের মধ্যে ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা বলে জানা যায়। বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্পে নানা অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতায় অধিকাংশ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

অনুসন্ধানে ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা জানান, সমুদ্র পথের পাশাপাশি মিয়ানমার হয়ে সড়ক পথে রোহিঙ্গারা মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড পাচার হয়ে যাচ্ছে। আগে থেকে মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রোহিঙ্গাদের অবস্থান রয়েছে। তাদের মধ্যে মোটামুটি সচ্ছল রোহিঙ্গারা তাদের স্বজনদের দালালের মাধ্যমে বাংলাদেশের আশ্রয় ক্যাম্প ও রাখাইন থেকে প্রথমে সমুদ্র ও মিয়ানমারের স্থল পথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড নিয়ে যায়। সেখান থেকে কৌশলে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মাধ্যমে রিফুউজি কার্ড করে। অনেকে টাকার বিনিময়ে মালয়েশিয়ার পাসপোর্ট বানিয়ে নেয়। মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড হতে বাংলাদেশ ও রাখাইন থেকে পাচারের বছরের মধ্যে এসব রোহিঙ্গাদের উল্লেখিত দেশসহ ইউরোপের রাস্ট্রগুলোতে কৌশলে মাইগ্রেশন করিয়ে নিয়ে যায় বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। তবে পাচারকৃত অধিকাংশ রোহিঙ্গা মালয়েশিয়ায় থেকে যায়।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বৈধভাবে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ড যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে এসব রোহিঙ্গারা পুরনো ও নতুন সৃষ্ট দালালের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মালয়েশিয়ান মুদ্রা রিংগিতের মান বৃদ্ধি হওয়ায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে মালয়েশিয়া গামী রোহিঙ্গাদের মাথাপিছু বাংলাদেশী সাড়ে পাঁচ হতে ছয় লক্ষ টাকা খরচ পড়ছে বলে জানা গেছে। ২০২১ সালের ১ ফেব্রæয়ারী সামরিক জান্তা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা পুষ্ট দালালরা অধিকতর সক্রিয় হয়ে উঠছে। বিশেষ করে বর্তমান সামরিক জান্তা বিরোধী মিয়ানমার জুড়ে একটা অবস্থান তৈরী হয়েছে। সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ঘাটে ঘাটে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, বর্ডার গার্ড ও বিভিন্ন প্রদেশে অঞ্চল ভিত্তিক সক্রিয় বিদ্রোহীদের হাতে নিয়ে মিয়ানমারকেই মানব পাচারের অন্যতম রুট হিসেবে বেচে নিয়েছে দালাল চক্র। গত কয়েক মাসে এ ধরনের পাচার কালে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার
করার খবর পাওয়া গেছে। রাখাইন থেকে সিলকৃত লরি করে পাচারকালে দম বন্ধ হয়ে মারা যাওয়া ১৩ রোহিঙ্গা যুবকের মৃতদেহ মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন অঞ্চলের রাস্তার পাশে ফেলে দেয়া হয়। গত সপ্তাহে ইয়াঙ্গুন অঞ্চলে অন্তত দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নারী পুরুষকে আটকের খবর পাওয়া গেছে। মানব পাচারকে কেন্দ্র করে সীমান্ত উপজেলা উখিয়া-টেকনাফে চলছে অপহরণ বাণিজ্য। দালাল চক্রের অন্যতম টার্গেট উঠতি বেকার যুবক ও কিশোর। পাশাপাশি হঠাৎ নিখোঁজের ঘটনাও বাড়ছে।

ফুসলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র পথে মালয়েশিয়াগামী ইঞ্জিন বোটে তোলে দেয় মানব পাচারকারী চক্র। এধরনের নিখোঁজ এবং মানব পাচারকারী চক্র জিম্মি করে মুক্তিপণ দাবি করার অহরহ অভিযোগ রয়েছে। এভাবে এক প্রকার নিরবেই সমুদ্র পথে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছে মানব পাচার তৎপরতা। দালাল চক্র গ্রামের সহজ সরল বেকার কিশোর-যুবকদের টার্গেট করে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রলোভনে ফেলে ফতুর করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে দালাল আটক এবং ভিকটিম উদ্ধারের ঘটনাও ঘটছে।