মাইনউদ্দিন শাহেদ:
রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহর বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু আনোয়ারা খাতুন। বয়স সাত পেরিয়েছে। এখনও কথা বলতে পারে না। বাবার সঙ্গেই ছিল তার সারাদিনের ওঠাবসা। খেতে-পরতে সবখানেই সঙ্গী ছিল বাবা।
সেই বাবা যে আনোয়ারার জীবনে আর কোনো দিন ফিরবেনা-এ কঠিন বাস্তবতাটি তাকে কে বুঝাবে? সারাদিন তার প্রিয় প্রাঙ্গণ ঝুঁপড়ি বাড়ি ও বাবার সংগঠনের কার্যালয় আছে পুলিশ পাহারায়। এক সপ্তাহ ধরে কত অচেনা-অজানা মানুষের আনাগোনা দেখছে আনোয়ারা। সবখানেই যেন সে তার বাবাকেই খোঁজে বেড়ায়!
গত বুধবার বাড়ির দরজায় ছোট ভাই মাহবুব উল্লাহর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আনোয়ারা। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক ও হতাশা ভর করেছে। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে! এদিক-ওদিক তার চাহনি?যেন সব প্রশ্ন তার কাছেই জমা আছে?
মুহিবুল্লাহর চাচা ছৈয়দ আলম(৬২) জানান,‘ আট সন্তানের মধ্যে মুহিবুল্লাহর খুবই আদরের ছিল আনোয়ারা। প্রতিবন্ধী মেয়েটির পড়ালেখা ও তাকে মানুষ করা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তা ছিল তার। এখন বাবাকে হারিয়ে আনোয়ারার ভবিষ্যৎ কী হবে-আল্লাহই জানে!
মুহিবুল্লাহর ভাগিনা রশিদ উল্লাহ জানান,আনোয়ারা ক্ষনে ক্ষনে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকে,কান্নাকাটি করে। সবসময় বাবার খুঁজে বেরিয়ে পড়ে।
কক্সবাজার শহর থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ১ নং রোহিঙ্গা শিবিরের লম্বাশিয়া বাজার। এ বাজারে পাঁচ শতাধিক দোকানপাট। সবসময় কয়েক হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আড্ডায় সরব থাকে বাজারটি।
জনাকীর্ন বাজারের পাশেই পরিবার নিয়ে থাকতেন রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর চেয়ারম্যান মুহিব উল্লাহ। তাঁর ঝুপড়ি বাড়ির পাশেই সংগঠনের কার্যালয়।
সেখানেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে মেঝেতে বসে সংগঠনের সর্থকদের সঙ্গে শরাপরামর্শ করার সময় কয়েকজন আততায়ীর গুলিতে খুন হন রোহিঙ্গাদের এই শীর্ষ নেতা।
ঘটনার পর থেকে আর্মড় পুলিশ ব্যাটালিয়নের কয়েকজন সদস্য মুহিবুল্লাহর বাড়ি ও অফিস পাহারা দিচ্ছেন। সেখানে পরিচিত-অপরিচিত কেউ আসলেই নানা জিজ্ঞাসার মুখে পড়ছেন।
রোহিঙ্গাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন মুহিবুল্লাহ। তিনি মাস্টার মুহিবুল্লাহ হিসেবেই পরিচিত। তাঁর এ হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে পারছে না সাধারণ রোহিঙ্গারা। তারা এ ঘটনার পর থেকে ভয়-আতঙ্ক ও শোকে মূহ্যমান। এলাকায় কেউ আসলেই নানা বয়সী রোহিঙ্গারা উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছেন-কে এসেছেন,কেন এসেছেন-নানা জিজ্ঞাসা? হাতে ক্যামেরা দেখলেই সটকে পড়েন এবং ভিড়িও না করার অনুরোধ করেন। অনেকেই জানালেন,ভিড়িওতে উঠলেই তাদের জীবন শেষ হতে পারে!
হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মুহিবুল্লাহর স্ত্রী নাসিমা খাতুন ও ভাই হাবিবুল্লাহর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। তাঁরা ভয়ের মধ্যে রয়েছেন বলে জানান স্বজনেরা। কারণ এরমধ্যে খুনীরা নানা মাধ্যমে তাঁদেরকে মামলা প্রত্যাহার ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখ না খুলতে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
তবে কিছু বয়োবৃদ্ধ লোক প্রায় সময় ঘটনা সম্পকে খবর রাখছেন। এঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। কথা বলতেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠেন রাজা মিয়া (৭৪)। তিনি জানান,‘আমাদের এলমদার(শিক্ষিত) মানুষটি হারালাম। এখন কে আমাদের খাওয়া-দাওয়া,ভাল-মন্দের খোঁজ নেবেন। আমরা তাঁর হত্যার বিচার চাই।
তাঁর মতো আরেক রোহিঙ্গা আবদু সালাম(৬৫)জানালেন,‘দেশে(মিয়ানমার) থাকতেও মুহিবুল্লাহ মাস্টার তাঁদের সুখ-দু:খের সঙ্গী ছিলেন। হালচাষে সার-বীজ ও সেচে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা-সবর রাখতেন। এ মানুষটিই ছিল আমাদের মা-বাপ। তাঁর হাত ধরেই আমরা দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস এর সেক্রেটারী ডা. মোহাম্মদ জুবাইর বলেন,‘বাংলাদেশ সরকার এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত করছে। আমরা সরকারের তৎপরতায় সন্তুষ্ট।
এ দিকে এ ঘটনায় এ পর্যন্ত সন্দেহভাজন পাঁচজন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে রিমান্ডে নিয়েছে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. হাসানুজ্জামান এ মামলায় আশানুরূপ অগ্রগতি রয়েছে বলে জানান। তিনি জানান, শিগগিরই এ ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। এ হত্যাকাণ্ডের মোটিভ উদঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবধরণের ইউনিট কাজ করছে।
প্রসঙ্গত, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবিরে সাড়ে ১১ লাখ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা বসবাস করছে।