অধ্যাপক রায়হান উদ্দিন


সঙ্গীতে সুরের ভাষা সার্বজনীন। বর্তমানে আমাদের জাতীয় সংহতি বিপন্ন প্রায়। এই আশংকায় আমারা যখন চিন্তিত তখন আমাদের খুঁজতে হবে সেই সুর যার মাধ্যমে আমারা পরস্পরের কাছে যেতে পারি।বর্তমানে রেডিও টেলিভিশনে জাতীয় সংহতি বৃদ্ধিকল্পে যে এ্ডোসহকারে যে কয়েকটি গান ভিজ্যুয়ালাইজ করে দেখানো হয় তাতে জাতীয় সংহতি কতটুকু বাড়ছে বলা মুশকিল বরং জাতীয় সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র চিন্তার দৈন্য যথেষ্ট প্রকট হয়ে উঠছে। আমার দেখা এযাবৎ কয়েকটির মধ্যে সব গুলিই বিব্রতকর। কিছু লোক এভাবে পয়সা কামাচ্ছে ভেবে যতটা খারাপ লাগে তার চেয়ে খারাপ লাগে দেশের কিছু প্রতিভাধর শিল্পীর অপব্যবহার দেখে। বর্তমানে দেশের সিনেমা হলগুলিতে বম্বেমার্কা ছবি দেখার পরে কিংবা আগে গুরুগম্ভির মুখে অশ্রু উদ্রেককারী  “ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” শোনা বা দেখা বেশ বিব্রতকর ব্যাপার। জাতীয় সঙ্গীত একটি অন্তর্মুখীন ব্যাপার। তাকে একটা ফ্লাগের ছবি বানিয়ে বার বার ভিস্যুয়ালাইজ করার দরকার আছে কি? দুঃখ হয় আমাদের শ্রদ্ধার গানটি এভাবে যখন তখন দেখানোর ফলে। জাতীয় সঙ্গীত একটি অন্তর্দশন, নিছক দেখা নয়। জাতীয় সংহতি প্রসারের জন্য এই সব বিজ্ঞাপন কতটুকু অর্থবহ ভেবে দেখার বিষয়। আমাদেরর জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বর্তমানে অনেক বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায়।আমাদের জাতীয় সঙ্গীত একসময় বাইরের যন্ত্রীদের দিয়েও রেকর্ড করা হয়েছে। সম্ভবত লন্ডন পিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রা দিয়ে রেকর্ড করানো হয়। খুব সুন্দর হয়েছে। আগে সিনেমা হলে দেখেছি জাতীয়সঙ্গীতকে অল্প দেখানোর পর ছবি শুরু করতে।

অনেকে রাস্ট্রিয়ভাবে অনুমোদন করা স্বরলিপি ও সুর অনুসরণ করছে না, যার ফলে জাতীয় সঙ্গীত বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বেশীর ভাগ লোকই জাতীয় সঙ্গীত সম্পুর্ন গাইতে পারেন না। এর ফলে বিশ্ব দরবারে লজ্জিত হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ। আমরা জানি জাতীয় সঙ্গীত একটি জাতির পরিচয় এবং গৌরবের প্রতিক। তাই জাতিয় সঙ্গীতকে জানা এবং যথাযথ সম্মান করা প্রত্যেকটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। “আমার সোনার বাংলা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরবিতান ৪৬ এর গীতবিতানের “স্বদেশ” শীর্ষক প্রথম গান। গানটির বিষয়বস্তুুতে বিশেষভাবে স্থান পায় বাংলার প্রকৃতি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আদর্শগত চেতনা হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ খ্রি: বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গান হিসেবে, “আমার সোনার বাংলা ” কবিতাটি ব্যবহার করেন। এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পুর্ব ও পশ্চিমবঙ্গকে একত্রিভুত করা । গানটি রচিত হয়েছিল শিলাইদহের বাউল গগন হরকরার কবিতা থেকে । অনেকের মতে তিনি একজন ডাক পিওন ছিলেন। তাঁর রচিত“আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে” গানটির সুরের অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই গানটি সুর করেন। এটির মুল সুর গগন হরকরার দেওয়া। কবিগুরু সুরান্তর করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ নিজেই লিখেছেন,“ আমার লেখা যারা পড়েছেন, তাঁরা জানেন, বাউল পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম,বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহন করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগ রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে।” কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছায়াসঙ্গী শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন“ আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গানটি তিনি রচনা করেছেন গগন হরকরার রচনা, “আমি কোথায় পাব তারে , আমার মনের মানুষ যে রে – এই গানটির সঙ্গে সুর মিলিয়ে।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই আসি। ভারতবর্ষে একটি জাতীয় সঙ্গীতে পাশাপাশি আরও দুটি প্রায় সমপর্যায়ের গান জনগণের স্মৃতি ও কন্ঠে তৈরী থাকে। “জনগণ অধিনায়ক” “বন্দে মাতরম”- এর চেয়ে “ কবি ইকবালের রচনা এবং রবি শংকরের সুরে “সারে জাঁহাছে আচ্ছা হিন্দুস্থা হামারা” কোন অংশে কম জনপ্রিয় বা গণ উদ্দীপনা সৃস্টিতে কম দক্ষ নয়। বরং, বলতে দ্বিধা নেই, যে “সারে জাঁহাছে আচ্ছা হিন্দুস্থা হামারা” অনুভুতি অনেক গভীর এবং রবীন্দ্র সৃষ্টি “আমার সোনার বাংলার মতো অশ্রুউদ্রেককারী। ইকবালের বাণীতে ,রবীশংকরকৃত সুরে ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’ – তেও অসম্ভব সুর,ছন্দ ও বাণী প্রক্ষেপণের বৈচিত্র আছে। এই তিন তিনটি সমপর্যায়ের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে চমৎকার সহাবস্থান বহাল থেকেছে এবং ভারতবাসীর জাতীয়তাবোধ ও সংহতি রক্ষায় বাস্তবিকই অপরিহার্য ভুমিকা পালন করে চলেছে। টিভিতেও এমন এমন কিছু দেশাত্ববোধক গানের ভিজ্যুয়ালাইজেশন যেখানে বেশ কিছু বরেণ্য ফিল্মি তারকা ও সঙ্গীত শিল্পীদের নিয়ে গান গাইতে দেখা যায়। উগ্র সাজে গানে লিপ্সিং করা ও হাটা চলা ,এখানে সংহতি কোথায়? কার সংহতি? বাংলা চিত্র দর্শক সমাজের ? সে সংহতি তো রোজ রোজ দেখা যায় সিনেমা হলের কাউন্টারের সামনে লাইনে লাইনে।আবার বাংলাদেশের এমন কিছু চলচিত্রে সঙ্গীত সংযুক্ত করা হয়েছে যার ভিজ্যুয়ালাইজেশন সত্যি মনে রাখার মতো। যেমন জহির রায়হানের “জীবন থেকে নেয়া” ছবির “দাও দাও দাও দুনিয়ার যত গরিবকে আজ জাগিয়ে দাও” আলতাফ হোসেনের “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি”, খান আতা ছবিতে “এক নদী রক্ত পেরিয়ে” মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি” ,“ একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গায়” কিংবা “আমি বাংলায় গান গাই”ইত্যাদি গান ও তার সঠিক চলচিত্রায়ন প্রত্যেকের মনকে নাড়া দেয়,দেশাত্ববোধে উজ্জিবিত করে তোলে।বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতীয় দিবসে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে করুণ স্বরে যখন বাজানো হয় “ধনধান্য পুস্প ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা ” বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের “চল চল উর্ধ্বে গগন বাজে মাদল নিম্নে উতলা ধরণী তল” কিংবা যখন একেবারে এযুগের “প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ”“এই পদ্মা এই মেঘনা”“একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গায়” তখন এ শ্রবণ মুহুর্তগুলো এদেশবাসীকে ভিতরে ভিতরে এক করে তোলে। আমরা জাতির সংগে আরো বেশী সংহত বোধ করি ।

অতি সম্প্রতি উপমহাদেশের সংগীত জগতের কিংবদন্তী লতা মঙ্গেশকরের একটি অনুষ্টান থেকে জানতে পারলাম, তাঁর একটি গান “এ্যায় মেরে ওয়াতন কো লোগো জেরা আখছে ভরলো পানি” এই গানটি শুনে তামাম ভারতবাসী বেদনায় কেঁদেছিলো। কেঁদেছিলেন পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরুও। জাতীয় সংহতি রক্ষায় এ গান আজও গাওয়া হয়।যখন দেখা যায় বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে জাতীয় সংগীতের সুরে সারি সারি দিয়ে দাড় করিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র গঠন করা হয়। ছেলে মেয়েরা মাথা দুলিয়ে হাত নেড়ে স্বাধীনতার স্মৃতি উদ্রেককারী সংহতির গান গায় তখন আমাদের সংহতিবোধ সত্যি প্রবল হয়ে উঠে।স্বাধীনতা সংগ্রামের পর বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংগীত রবীঠাকুরের “আমার সোনার বাংলা” গানটি শুনলেই আমার চোখে জল আসে। চোখে জল আসার মতই গান এটা। এই চোখের অশ্রুই সমস্থ বাঙ্গালীকে ভেতরে ভেতরে এক করে তোলে। ঐ কান্নার মুহুর্তে আমরা কেউ হিন্দু,কেউ মুসলিম,কেউ খৃস্টান,কেউ বৌদ্ধ নই, কেবলই বাঙালী, বাংলাদেশী। যে একাত্মবোধে আমরা দেশের যেকোনও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। ওই কান্না ,ওই একতা, ওই বাঙ্গালী একতা, আমাদের রেডিও টিভির সংহতি সংগীতগুলি দেয়না।। এটাই নির্মম সত্য।