কফিল উদ্দিন


সড়ক দুর্ঘটনায় একদিনে ৪২ জনের প্রাণহানি, ভাবা যায়! প্রতিদিন এরকম প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে শুনে আমাদের প্রাণ আঁতকে ওঠে। কোনোদিন ১০-১২ জন, কোনোদিন ১৫-২০ জনের মৃত্যু একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের চোখের সামনেই যেন ঘটছে ঘটনাগুলো। কিন্তু আমাদের ভূমিকা কী থাকছে তা ভেবে দেখছি না। কখনো চালককে দোষারোপ করছি, কখনো ভাঙা সড়ককে দোষারোপ করছি, কখনো পথচারীকে দোষারোপ করছি। হ্যাঁ, সকলেরই কিছু না কিছু দোষ থাকতে পারে, কিন্তু সেটা উদঘাটন করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি বলে মনে হয় না। বাস দুর্ঘটনার ব্যাপারটি এত অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, দূরপাল্লার বাসগুলোর চালকের বিশ্রামের প্রয়োজন রয়েছে এবং সেকারণে অতিরিক্ত একজন চালক থাকতে হবে। কিন্তু তাঁর এই মতামতকে প্রধান্য দিয়ে দ্রুত কার্যকরের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপের কথা শুনতে পাচ্ছি না কোনো মহল থেকেই। না বাস মালিকদের পক্ষ থেকে,না সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে।

প্রতিদিন বাস দুর্ঘটনায় যে সকল মানুষের প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে, তাদের পরিবার-পরিজনের খোঁজই বা কে নিচ্ছে? বাস চালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোই দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে জানা গেছে, তথাপি তাদের বিরুদ্ধে তেমন আইনানুগ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে না। যে বাসটি দ্রুত চালানোর কারণে বা ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, দেখা গেল সেই বাসটিতেই হয়তো কোথায়ও লেখা আছে, ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি’। চালক এসব ব্যাপারে জেনেও নিজের দাম্ভিকতার কারণে দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। আবার কখনো তাদের অজ্ঞতার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ওভারটেক করতে গিয়ে কখনো প্রাইভেট কার, অটো রিকশা, নসিমন ইত্যাদি ছোট গাড়িকে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের প্রাণ।

বাসচালক কর্তৃক শুধু মৃত্যুর ঘটনাই নয়, যানজটের ঘটনাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। রাজধানীতে যত্রতত্র বাস পার্কিং ও যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। যে কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় একটি বাস আরেকটি বাসকে আগে যেতে দিবে না বলে বাসটি বাঁকা করে আড়াআড়িভাবেও রাখা হয়। এরকম ঘটনা অনেক ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশের সামনেও ঘটে। বাসচালকদের প্রতিযোগিতামূলক এসব দৃশ্য দেখে অভ্যস্ত আমরা অনেকটা অনুমান করে নিতে পারি এসব চালকেরা খুবই শক্তিশালী এবং তাদের দাপটের কাছে নগরবাসী অসহায়। বাস স্টপেজ ছাড়া যত্রতত্র যাত্রী ওঠানো-নামানোর কারণেও পথচারী বা যাত্রী দুর্ঘটনার শিকার হয়। কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে নজর না দেওয়ায় এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দিন দিন এই অনিয়মের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

যা শুধুই বাড়ছে না বরং খুবই মারাত্মক ভাবে বাড়ছে। ২০২০ সালে গত ৬ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১৯৫৫ জন (সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো)। তাছাড়া গত কয়েকবছরে তা আরও বিপুল হারে বেড়েছে। ২০১৯-৭৮৫৫জন ২০১৮-৭২২১ জন ২০১৭-৭৩৯৯ জনের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছে (সূত্রঃজানু ১২,২০২০, দ্যা ডেইলি স্টার)

বাসচালকদের বা অন্য চালকদের শুধু গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা বা সার্টিফিকেট থাকাটাই একমাত্র সম্বল হতে পারে না। পাশাপাশি নিয়ম শৃঙ্খলার ব্যাপারেও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। মহাসড়কে বাঁক থাকে যেখানে পূর্বেই একটি সতর্কবাণী লেখা দেখা যায়, ‘সামনে বাঁক’, কিন্তু সে বাঁকেও দ্রুত গাড়ি চালানো হয়। কখনো লেখা থাকে, ‘দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা, সাবধানে চলুন’। কিন্তু চালক সেই দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় নতুন একটি দুর্ঘটনার জন্ম দেন। সুতরাং এসব বিষয়ে চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের মন-মানসিকতারও উন্নতি সাধন করা প্রয়োজন। বিআরটিএ কর্তৃক বা তদ্রূপ অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান অথবা বেসরকারি উদ্যোগে চালকদেরকে নিয়ে কর্মশালা করা বা নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, চালকদেরও একটি সম্মানের জায়গায় স্থান দেওয়া আবশ্যক। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কে গতিরোধকের আধিক্য না থেকে বরং গতি নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বসানো প্রয়োজন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সড়ক ব্যবস্থাপনায়ও আধুনিকায়নের কোনো বিকল্প নেই। হাইওয়ে পুলিশের তদারকি বৃদ্ধি করতে হবে যাতে নিয়ন্ত্রণহীন চলা গাড়িগুলো নির্ধারিত গতিতে চলতে পারে।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানোর লক্ষ্যে করণীয় :

এক. ড্রাইভারদের সঠিকভাবে গাড়ি চালানোর ট্রেনিং দিতে হবে। তাদের ট্রেনিংয়ে অবশ্যই অন্য গাড়ি ও পথচারীদের বিষয়ে সচেতন হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে। তাদের অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার শিক্ষা দিতে হবে। এজন্য ট্রেইনারদেরও ট্রেনিং দেয়ার প্রয়োজন আছে।

দুই. পথচারীদের পথচলার এবং রাস্তা ক্রস করার বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। সেক্ষেত্রে কেবল ট্রাফিককে সমুদয় দায়িত্ব দিলে চলবে না; বরং সব সচেতন নাগরিক ও ছাত্রছাত্রীদেরও দায়িত্ব নিতে হবে।

তিন. প্রয়োজনবোধে আইন কঠোর করে গাড়ির মালিকদের বাধ্য করতে হবে যাতে তারা কোনো অবস্থাতেই ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের গাড়ি রাস্তায় বের করতে না পারেন। মান্ধাতার আমলের রংচটা, টোস খাওয়া দানবসদৃশ গাড়ির পরিবর্তে সুদৃশ্য ও পরীক্ষিত গাড়ি রাস্তায় নামাতে হবে।

আরোহীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব গাড়ির মালিকদেরও। ড্রাইভাররাও যেন বিরামহীনভাবে দীর্ঘ সময় গাড়ি না চালান সেই ব্যবস্থাও মালিকদের করতে হবে। চার. পুরনো আইন পরিবর্তন করে নতুন আইনে শাস্তির পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে এবং সরকার ঘোষণা দিয়েছে তা অবিলম্বে কার্যকর হবে। এটা প্রশংসনীয় এবং সঠিকভাবে প্রয়োগ হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে আশা করা যায়।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের শিষ্টাচার আরো মার্জিত হওয়া, নৈতিক চিন্তাচেতনা নিজেদের মধ্যে জাগ্রত করা, একে অপরের প্রতি সহনশীল হওয়া— এসব ব্যাপারে যত সচেতন হওয়া যায় ততই মঙ্গল। তাতে দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে, অপমৃত্যু হ্রাস পাবে, মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য বাড়বে। আমরা আর এত দুর্ঘটনা দেখতে চাই না, এত অযাচিত প্রাণহানি দেখতে চাই না, এত মানুষের আহাজারি শুনতে চাই না। আমাদের এই উন্নত বাংলাদেশকে আমরা যেন আরো সমুন্নত রাখতে পারি, সেই চেষ্টা থাকুক সকলের অন্তরে।