২৯ এপ্রিল ১৯৯১ স্মরণে :

কাজী সাইফুল হক

২৯ এপ্রিল ১৯৯১। রাক্ষুসে একটি দিবস! একটি প্রভাবশালী ঘটনা-দুর্ঘটনা। ’৯১ এতই প্রভাবশালী যে, প্রকৃতির প্রত্যক্ষ ও প্রকৃত আচারে-আচরণে শত-হাজার মানুষের প্রাণের সাথে আরও অনেক জীবের প্রাণ সংহার হয়। এই দিনের কোনো ‘উপ’ নেই। উপসংহার নেই। সংহার হয়েই গেছে! সম্বল-অবলম্বন-বাহুবল সব গেছে জলের নালে জলাঞ্জলি! ঊনত্রিশী দাপটে প্রকৃতির সংস্কৃতিতে উপকূলের জন্মমাটি বিপন্ন-বিপদাপন্ন প্রায়! মানুষ ও পশু-পাখির যমজ আহাজারি নোনাজারিতে পৌঁছে। অন্তরের আঙটায় গেঁথে যাওয়া ঊনত্রিশ এপ্রিল এজন্যই আমাদের কাছে প্রভাববিস্তারী ঘটনা। রাক্ষুসে দৈত্যের আশকারায় অদ্ভুত এক দৈত্যাগার তৈরি হয় দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে! সে কী ঊনত্রিশী চেহারা! উদ্ভব-উদ্ভূত সেই অদ্ভুত দৃশ্যপট সম্বৎসরে উঁকি দিয়ে স্বজনহারার মনকে আঁৎকে দেয়, আটকে দেয়। বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষত চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার প্রান্তবর্তী-কেন্দ্রবর্তী এলাকা চকরিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, বাঁশখালী, আনোয়ারা, পতেঙ্গার অগণিত-অগণন মানুষ হারায় শ্বাস আর মূল। কিছু সময়ের ব্যাপ্তি ও ব্যবধানে উপকূলবাসী শোকে হয় মূক। সেই দাঁতাল দানবই প্রলংঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস।
২৯ এপ্রিল কেড়ে নেয় স্বজন-পরিজন, সহায়-সহায়তা, মমতা-মানবতা। মানুষের বসবাস ভূমি হয় বিরাণভূমি। চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চল নিজের রূপ-রঙ-জৌলুস হারিয়ে হয় বিবর্ণ, বিশুষ্ক, ফিকে, ন্যাড়া এবং নেংটা। এখানে ভোরে মানুষের ঘুম ভেঙে দেয় লাশের দুর্গন্ধ। বাতাসে বাতাসে লাশের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। সমুদ্রের জোয়ারে লাশের দুর্গন্ধ আরও কিম্ভুতে ও বিদঘুটে হয়ে ওঠে। পানি রঙচঙ ধারণ করে কালচে, গন্ধে ভারি ভরপুর। এখানে দিনেক আগেও যে মানুষের সুখকর-মনোহর বসতি ছিলো, হলাহল-কোলাহলমুখী পরিবেশ ছিল, পরদিন সেইসব অবিশ্বাস্য ঠেকেছে! কোথাও বাড়ি-ঘরের দাগ বা চিহ্ন নেই। জনমানবের দর্শন নেই, জনবসতির নিদর্শন নেই। এখানে-সেখানে-ওখানে শুধু লাশ, লাশ আরও লাশ। এমনও হয় নিয়তি, কোনো কোনো পরিবারের স্বপরিবারই ভেসে গেছে পাষাণ জলে-হাওয়াই কলে। ঘরের চালা, গাছ, মৃত গরু-ছাগল, পশু-পাখি আর মানুষ একাকার একত্রে ভেসে ওঠে। মোটের ওপর দূর থেকে মনে হয়, পানিতে কাগজের ছোট ছোট ডিঙি ভাসছে। বেঁচে যাওয়া ভাসমান মানুষ বিদ্যমান বর্তমানকে পেছনে রেখে শুধুই তালাশ করতে থাকেন প্রিয়জন ও দরদবন্দকে। বর্ণনাতীত, কল্পনাতীত সেই অতীত দিনের আজ ২৭ বছর।
সেই কালো জলোচ্ছ্বাসী রাতের ধ্বসে-ধ্বংসে সর্বাংশে বেঁচে যাওয়া মানুষের সাহায্যে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সামর্থে-সাহায্যে এগিয়ে আসেন। দুর্বল ও জলেভাসা মানুষের করুণ চিত্রে সকরুণে আঘাতবিদ্ধ হয়ে শিল্পী সিরাজুল ইসলাম আজাদ আসেন কণ্ঠ নিয়ে। ওইদিন সর্বহারা মানুষের বিলাপধ্বনি ধ্বনিত হয় তার কণ্ঠে, তারই গীতে। আজও ’৯১-এর স্মৃতি ও শ্রুতি আশ্রিত গীতিকথা বলতে ওই যে তার তুফান নামীয় গানই।
হেডমাস্টারখ্যাত সিরাজুল ইসলাম আজাদ ২৯ এপ্রিল ১৯৯১Ñএর এক সপ্তাহেই তুফানের গান নিয়ে ঝড়ের বেগে দেশবাসির সামনে হাজির হন। ‘পাষাণ দরিয়া’ নামে ৫৪৩ মডেলের টেপ রেকর্ডারে গানগুলো রেকর্ড করে (বিনা পারিশ্রমিকে) বাজারে ছাড়েন তিনি। বেদনার অঙ্গ হয়ে অংশ নেন মানবতা বোধে। এসব গান তুফানের সপ্তাহান্তে লিখে, সুর করে আবার সেই সাথে কণ্ঠ দিয়ে তিনি হয়েছেন ধন্যবাদভাজন। জীবন থেকে নেয়া এবং আস্তিনে লুকিয়ে রাখা অনুভব-অনুভূতি প্রকাশ্যে এনে গানের মালা গেঁথে দান করেন সর্বহারা-সর্বস্বহারা মানুষকে। তিনি চিরায়ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেনÑ
‘পাষাণঅ দরিয়ার পানি নিদয়া বাতাস
দেশ গেরাম ভাসাইয়ারে নিলো গইল্য সর্বনাশ।’
আজ হতে ২৭ বছর আগের এই সর্বনাশা-কীর্তিনাশা ছোবল কতটা ভয়াল ও ভয়াবহ ছিল সেই করুণ চিত্রও এঁকেছেন ক’ছত্রে। যারা এমন রাক্ষুসে দিনের কথা জানে না, সেই দিনের সাথে যাদের সাক্ষাৎ নসিব হয়নি; অমন নয়াপ্রজন্মের জন্যও এক অকৃত্রিম ইতিহাস! কি হয় সেদিন, কি হারায় মানুষ; পীড়নে-প্রেরণে-প্রেরণায় লিখে যান গীতিকবি এভাবেÑ
‘ভাসাই নিলো ঘর-বাড়ি যা আছে সম্বল
হাজার হাজার মানুষ নিলো গরু আর ছাগল
ছিন্নভিন্ন গরি দিলো মাইনষর সুখর বসবাস।’
নির্মম-নির্দয় বাতাস-জলোচ্ছ্বাস আর পাষাণ দরিয়ার বয়ান বর্ণন সুখকর ও শুভকর কোনোটাই ছিলো না ঊনত্রিশী দিনে। নিপুণ গীতিজীবীর এক্স-রে চোখে ধৃত হয় দৃশ্যপট। এই সহিংস-ধ্বংসে দাঁড়িয়ে বাইনোকুলার চোখ নিয়েও কিছুতেই তিনি সনাক্ত করতে পারছিলেন না বাপ-দাদার ভিটে-বাড়ি। হাজার-লক্ষ মানুষের হয়ে গান বেঁধেছেন চাল-চুলোহীন খোলা বিরান চেয়ে চেয়েÑ
‘সিরাজে কয় অরে ভাইয়ান চগই এ্যানা যাই
আঁই যিয়ান দেখি আইলাম কইবল্যাই ভাষা নাই
বাপর ভিড়া নত চিনলাম বউত গইল্যাম তালাশ।’
২৯ এপ্রিল কেন্দ্রিক সমস্ত ভয়াল ও ভয়াবহতার দায় ও দায়িত্ব যেন রাক্ষুসে দরিয়ার ওপর বর্তায়! সেই যুক্তি ও যৌক্তিকতায় তার রোষ-আফসোস ঘিরে আছে উত্তাল-টালমাটাল দরিয়াকে ঘিরে। সন্তান-সন্ততি, ভরভরন্ত ফল-ফসল, শষ্যক্ষেত আর গোয়ালভরা পশুর সুখের সংসারে লোভে পাপ এথিক্স ভুলে রাক্ষুসী দরিয়া ঢুকে পড়ে মানুষের সংসারে। কালগ্রাসে নিমেষেই হয়ে যায় নিঃশেষ মানুষ-পরিবেশ। শিল্পীর চিৎকার-রোদন সুর তোলেÑ
‘অরে রাক্ষুসীরে দরিয়া
সোনার সংসার গল্লিরে ছারখার নিলিরে ভাসাইয়া
সুখর স্বপ্ন ভাঙি দিলি আশার বুকত দিলি ছালি
এত ক্যানে অইত পাইল্যি তুই নিমাইয়া।’
৯১’র ২৯ এপ্রিলের উন্মত্ততায় মায়ে-ছায়ে হয়ে যায় জোদা-আলাদা! ‘আমায় বাঁচাও’Ñ এমন আর্তি জলের ছলে মিইয়ে যায়। ছোট ছোট ঝলমলে প্রাণ জলের রোষ-আক্রোশ থেকে বেঁচে ওঠতে পারেনি। বেঁচে থাকা শিশুও মা-বাবার তরফে পায়নি প্রত্যুত্তর। এমনিতরো বিভীষিকায় মাময়শিশুর দৃশ্যকল্প কল্পনা করা যায় কি? যেখানে কথা বোবাশ্রিত হয়, সুরের দাপট শুরু হয় সেখান থেকেইÑ
‘মারে, বেইলতো ভাতর অক্ত অইয়ে আঁরে দ’না ভাত
গুরা পোয়ায় কাঁদি কাঁদি কঅর ধরি মরা মায়ের হাত
মারে আঁরে দ’না ভাত।’
শিশু তখনও জানে না মা তার দুনিয়া ত্যাগী হয়েছে। কেন হয়েছে, কোন বিধানে হয়েছে; এসব তো শিশুর জানার বিষয় নয়! শিশুর অবুঝ মন নিত্য দিনের ন্যায় আদর-কদর, আহার-বাহার সবই পেতে চায়। কিন্তু নির্মমতা এতই নির্মম যে, তার ন্যায্যটুকু অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছে প্রকৃতি! সিরাজের এই গান এতবেশি হৃদয় ও মর্মস্পর্শী যে, যার আবেদন নিদেনপক্ষে শ’বছরেও হারাবার নয়। গানখানি আজও মানুষের চোখে বর্শায় আষাঢ়-শ্রাবণী বর্ষণ।
একানব্বইÑএ কারবালার কাদিসা রচিত হয়নি। এমন ভয়াবহতার মাঝে আর্ত ও আর্থের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। অন্য অনেকের মতোন তিনিও বুকে হিম্মত বাঁধার পয়গাম পেঁছান আক্রান্ত-ভারাক্রান্তদের। বিত্ত-বৈভব-ধণাঢ্যজনকে আহ্বান জানান ক্ষতিগ্রস্তের সাহায্যে-আহার্যে এগিয়ে আসতে। বিত্তশালীর পক্ষে সেদিনের আহ্বান এক অনতিক্রম্য উচ্চতায় গিয়ে দাঁড়ায়Ñ
‘তোঁয়ারা বই নঅ থাইক্য এন গরি
চলো আঁরা দুখি জনরে সাহায্য গরি
ঘূর্ণিঝড়ে জলোচ্ছ্বাসে যারার গেয়্যি ঘর-বাড়ি।’
অথবা ‘যারা আজ সর্বহারা বাড়ি ছারা আশ্রয় তো দেয়া পরিবো
যারা হরাইল ধন দৌলত কালতুয়ানত তারাত্তুন বাঁচা পরিবো।’
দানের প্রতিদানের বেনজির একটা আবহ আছে এই গানে। দাতার দান বিধাতা বৃথা যেতে দেন নাÑ
‘মানুষল্যাই মানুষ আইস্যে এই দুনিয়ায়
একজনে যেন আরেকজনরে অসময়ে পায়
দানির দান তো কেয়ামতে ছায়া অইব কইত পারি।’
উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলের ভাগ্যাহত মানুষ আসমানী রঙ কালো হতে দেখলে তাদের পরাণ গিয়ে থিতু হয় চুল-কেশাগ্রে। এই বুঝি আম-ছালা সব যায় যায়! তখন সমুদ্রের মহাবিপদ সংকেতে জনমানুষকে সচেতন করার নিমিত্তে নানা পদক্ষেপ নেয় সরকার। অবস্থার তিন অবস্থা হলে রেডিও, টেলিভিশনে ঘোষণা আসে ওই মুহূর্তের কর্ম-করণীয় নিয়ে। সেই জনস্বার্থের জনগুরুত্বপূর্ণ এমন বিষয়েরও গুরুত্ব-গুরুতরতা একান্ত ব্যক্তিক দায়ে সাফল্যে-সারল্যে তুলে ধরেছেন গুণী এই শিল্পী।
সচেতনতাই সাবধানতা। সাবধানতার মার নেই। মুসিবতের পর মুসিবতই আসে না। মুসকিল আসানের সুযোগও আসে। মুসিবত থেকে পরিত্রাণের জন্য নিজেদের প্রচেষ্টাই হতে পারে শান্তির সমাধান। তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত জাতির কপাল ফেরান না; যতক্ষণ না তারা নিজ কপালের ফের কাটাতে চেষ্টিত না হন। সিরাজ তাই গায়Ñ
‘চলো, ভুলি যায় তুয়ানর কথা স্বজনহারা মনর ব্যাথা
ঘর-বাড়ি গেল এইসব চিন্তা কিল্যাই গইত্যা অকারণ
আবার ঘর বানাই সংসার সাজাই সাজাইরে জীবন।’
প্রকৃতির পক্ষে মান-অভিমান, অনুরাগ-বিরাগ, চিন্তা-দুশ্চিতা, রাগ-ক্ষোভ-ব্যথা ভুলে সংসার জীবনে পদার্পণে গানের আহ্বান সত্যিই প্রশংসার্হ। সবহারাদের দলের প্রতি গীতিকথার যৌক্তিক সান্ত¦নাÑ
‘হাঁস মুরগি গরু ছাগল ক্ষেতে আর পুতে
বেয়াগ্যিন আবার ভরপুর অইব আঁরার সংসারেতে
মানিক আবার কোলত আইব ফুটফুটে চাঁদর মতন।’
’৯১ থেকে জীবনের সারাংশ ঋণে সিরাজ আজাদ মানুষের জীবন ও যাপনকে তুলে এনেছেন অংকের ভেতর থেকে। তিনি মানুষের জীবনকে গণিতের মৌলসূত্রে দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন। তার গাণিতিক সমাধান বিধৃত হয়েছে এভাবেÑ
‘ভাঙি গেলে বাধন পরে নঅ গইজ্য আফসোস
ত্যাগি যারা এই দুনিয়াইত তারাইতো মানুষ
জীবন অইয়ে অংকের মত যোগ-বিয়োগ-ভাগ-পুরণ।’
জীবনে শুধু যোগ থাকবে এমন তো নয়; কিছু বিয়োগ হবে, ভাগ হবে কিছু, সেইসব আবার পুরণও হবে। সংগ্রাম-সংহার-সমতা-নামতার নামই তো জীবন! বাংলাদেশের ভৌগোলিক আচরণ মেনেই সিকস্তী-পয়স্তিদের জীবনের গীত ও ভীত দুটোই রচে যেতে হবে! মানতে হবে ভাঙা-গড়ার নামই জীবন।
তবুও যত যাই বলি, রাক্ষুসী দরিয়ার কথা কভু ভুলবার নয়। ভোলার মতো নয় উনত্রিশের ভয়াবহতা, ভয়ালতা, দানবতা, উন্মত্ততা। কিছুতেই নয় ভুলে থাকা, রাক্ষুসে দিনের কথা! তাই দিন আসলেই হৃদয়ে টুং করে বেজে ওঠে সেই টোনÑ ‘রাক্ষুসী দরিয়ার কথা পরাই তো নঅ যার।’

কাজী সাইফুল হক
গলুই, আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম
০১৯৩২ ৫৪০৫৫২