ডেস্ক নিউজ:
চব্বিশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো ও রাজনৈতিক চর্চায় বড় ধরনের রদবদল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর সবচেয়ে জোরালো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি)। পোষ্য কোটা ইস্যু থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ, আওয়ামীপন্থি শিক্ষক ও ডিনদের পদত্যাগের আন্দোলন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানি ও হুমকির ঘটনায় কয়েক মাস ধরেই অস্থিরতার কেন্দ্রে রয়েছে দেশের অন্যতম এই বিদ্যাপীঠ।

এই ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহের প্রায় প্রতিটি পর্বেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উঠে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সালাহউদ্দিন আম্মারের নাম।

পোষ্য কোটা নিয়ে সংঘর্ষ

চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ১০ শর্তে পোষ্য কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাঈন উদ্দীনের গাড়ি আটকে দেন শিক্ষার্থীরা। প্রায় ২০ মিনিট তাকে গাড়িতে অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং পরে তার বাসভবনের ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হলে উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জুবেরী ভবনের সামনে গেলে সেখানে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার অভিযোগ ওঠে। ভিডিও ফুটেজে উপ-উপাচার্যের গলা চেপে ধরা এবং উপ-রেজিস্ট্রারের দাড়ি ধরে টান দেওয়ার দৃশ্যও দেখা যায়। এসব ঘটনায় সাবেক সমন্বয়ক ও বর্তমান রাকসু জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে।

ঘটনার প্রতিবাদে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম কর্মবিরতির ডাক দেয়। অফিসার্স সমিতির শাটডাউনের কারণে কয়েক দিন কার্যত অচল হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তিন মাসেও প্রতিবেদন প্রকাশ না হওয়ায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে।

ডিনদের পদত্যাগ ও প্রশাসনে তালা

আওয়ামীপন্থি ডিনদের পদত্যাগ এবং ‘ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট’ শিক্ষকদের অপসারণের দাবিতে ‘অপারেশন জিরো টলারেন্স ফর ফ্যাসিজম’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন আম্মার। ১৮ ডিসেম্বর ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে তিনি ডিনদের পদত্যাগের আলটিমেটাম দেন।

২১ ডিসেম্বর ছয় ডিন ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত থাকায় গণমাধ্যমের সামনে তাদের ফোন করেন তিনি এবং পদত্যাগপত্র প্রকাশ করেন। এরপর ডিনস কমপ্লেক্স ও প্রশাসন ভবনসহ উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, প্রক্টর ও রেজিস্ট্রারের বিভিন্ন দপ্তরে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। দিনভর উত্তেজনার পর সন্ধ্যায় ডিনদের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় প্রশাসন।

এর আগে এক সমাবেশে আম্মারের দেওয়া বক্তব্য—‘ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পক্ষে যারা কাজ করবে, তাদের জুতা খুলে মুখে মারব’—নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা তৈরি হয়।

শিক্ষকদের নিরাপত্তা শঙ্কা

ক্যাম্পাসে শিক্ষক হেনস্তা ও মব সৃষ্টির অভিযোগ তুলে শিক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছে বিএনপিপন্থি তিনটি শিক্ষক সংগঠন—জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম, ইউট্যাব ও জিয়া পরিষদ। তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলাকারী শিক্ষকদের বিচার এবং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর শিক্ষক নিয়োগ বন্ধের দাবিও জানিয়েছেন।

একই সময়ে নিরাপত্তা শঙ্কায় ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী জাহিদ।

ছাত্রদলের অভিযোগ

শাখা ছাত্রদল আম্মারের কর্মকাণ্ডকে শিক্ষক লাঞ্ছনার অপচেষ্টা ও ক্যাম্পাসে অরাজকতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, রাকসু জিএসের হুমকিমূলক বক্তব্য ও আচরণ শিক্ষাঙ্গনের জন্য মারাত্মক হুমকি।

উদ্বেগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী নোমান ইমতিয়াজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনার জায়গা হলেও বর্তমানে একাডেমিক পরিবেশ হারিয়ে যাচ্ছে। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকলেও দায়িত্বশীল অবস্থান থেকে এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হওয়া উদ্বেগজনক।

যা বললেন আম্মার

সব অভিযোগের জবাবে রাকসু জিএস সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, তিনি সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থেই কাজ করছেন। ‘আমি জানি, হয়তো শেষ পর্যন্ত সার্টিফিকেটও নিতে পারব না, কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য যা করব, সেটাই থেকে যাবে।’
তিনি দাবি করেন, তিনি কোনো দলের প্রতিনিধি নন এবং যতদিন ক্যাম্পাসে থাকবেন, শিক্ষার্থীদের পক্ষেই অবস্থান করবেন।

এদিকে রাবির প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান স্বীকার করেছেন, বর্তমানে ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি ভালো নয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান এই অস্থিরতা এখন কেবল ক্যাম্পাসেই নয়, জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবেও দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে।

-কালবেলা