উখিয়ায় চাকরিচ্যুতদের আন্দোলনে দিনভর উত্তেজনা, পুলিশের লাঠিচার্জ

বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের জিম্মায় থানা থেকে ছাড়া পেলেন আন্দোলনকারীরা

প্রকাশ: ২০ আগস্ট, ২০২৫ ০৯:৫৭

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


ইমাম খাইর, সিবিএন:
কক্সবাজারের উখিয়ায় এনজিও চাকরিচ্যুত হোস্ট শিক্ষকদের পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন ঘিরে দিনভর উত্তেজনা, সংঘর্ষ ও নাটকীয়তার পর আটক শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক শেষে বুধবার (২০ আগস্ট) বিকেলে আটক শিক্ষক ও ছাত্র প্রতিনিধিরা বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের জিম্মায় মুক্তি পান।

তাদেরকে জিম্মায় নেন, উখিয়া উপজেলা বিএনপির আহবায়ক সরওয়ার জাহান চৌধুরী, উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা আবুল ফজল ও এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব এস এম সুজা উদ্দিন।

এর আগে বুধবার সকাল থেকে উখিয়া ডিগ্রি কলেজের ছাত্র, হোস্ট শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামেন। এক পর্যায়ে তারা উখিয়া থানার প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে উখিয়া থানার ওসি আরিফুল ইসলামের প্রত্যাহার ও আটককৃতদের মুক্তির দাবিতে ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন।

এতে কয়েক দফায় উত্তেজনা, পুলিশের লাঠিচার্জ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের লাঠিচার্জে অন্তত ১০ জন শিক্ষক আহত হয়েছেন। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কক্সবাজারের প্রতিনিধি জিনিয়া শারমিন, শিক্ষক নেতা সাইদুল ইসলাম, সুজন রানা, আবু ইমরান, তারেকুর রহমান, সাকিব হাসান, ঊর্মি আক্তারসহ কয়েকজনকে মারধর ও নাজেহাল করে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলনকারীদের আটকের খবরে ঘটনাস্থলে গেলে এনসিপির জেলা সংগঠক খালিদ বিন সাঈদসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধিকেও লাঠিচার্জ করে পুলিশ। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়া ডিগ্রি কলেজ এলাকার ফলিয়াপাড়ার ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে পুরো জেলায়। ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি চেয়ে কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছে জুলাইযোদ্ধারা। তারা পুলিশকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ট্রাফিক) জসিম উদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি টিম। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে পুলিশ প্রশাসনের দীর্ঘ বৈঠকের পর আটককৃতদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

জিম্মানামায় মুক্তিপ্রাপ্তরা হলেন: রাজা পালংয়ের মুজিবুল হকের ছেলে সাইফুল ইসলাম মারুফ (২০), মো. শহিদুল ইসলাম সাকিব (২২), আবদুল গফুরের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন (২৩), মৃত আবদুল মালেকের ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম (২৩), গফুর আহমদের মেয়ে রাশেদা সুলতানা (২০), ছেপটিখালী পাড়ার মোহাম্মদ হোসেনের হাফিজুর রহমান সৈকত (২২), বড়বিলের শফিউল করিমের ছেলে নজরুল ইসলাম নোমান (২২), নুরুল ইসলামের ছেলে মো. মিজানুর রহমান (২৪), হলদিয়াপালংয়ের জসিম উদ্দিনের ছেলে মো. দেলোয়ার হোসেন রফিক (২৪), সোলেমান কবিরের ছেলে হুমায়ুন কবির (২৫), কুতুপালংয়ের সৈয়দ নুরুল হকের ছেলে মো. শহিদুল ইসলাম মিজান (২৫), জাফর আলমের ছেলে আজমাইন হোসেন (২০), মৃত সোলেমানের ছেলে শফিকুল ইসলাম সোহেল (২৪), মৃত মুজিবুল হকের ছেলে মোরশেদুল আলম (২৩), মৃত আমান উল্লাহর ছেলে মাহফুজুল হক (২১), মৃত আবদুল মজিদের ছেলে মো. কামাল হোসেন (২৫), আবদুল গফুরের ছেলে হেলাল উদ্দিন (২২), আবদুল হকের ছেলে মো. রাশেদুল ইসলাম (২৪) এবং মৃত জসিম আহমদের মেয়ে রাশেদা সুলতানা (২৬)।

কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণকারী শিক্ষকরা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তহবিল-সংকটের অজুহাতে এক হাজারের বেশি শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাতে রোহিঙ্গা শিশুদের লেখাপড়া যেমন বন্ধ হয়ে গেছে, তেমনি শিক্ষকরাও আর্থিকভাবে দুর্দশায় পড়েছেন। চাকরিতে পুনর্বহালের আশ্বাস দিয়ে বন্ধ থাকা শিক্ষাকেন্দ্রগুলো আবার চালু করা হয়েছিল। এখন আমাদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।

এ বিষয়ে জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দীন চৌধুরী জানান, ‘সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ কমাতে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে নেওয়া হয়।। আটককৃতদের জিম্মানামায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক রয়েছে।

প্রসঙ্গত, গত তিন মাস ধরে চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা তাদের পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করছেন। গত সোমবার কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের উখিয়ার কোটবাজার এলাকায় টানা সাড়ে নয় ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করেন। সে সময় কয়েক হাজার যানবাহন আটকা পড়েছিল।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। আশ্রয়শিবিরে থাকা প্রায় চার হাজার শিক্ষাকেন্দ্রে আড়াই লাখের বেশি রোহিঙ্গা শিশু-কিশোরকে পাঠদান করা হয়।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, ‘তহবিল-সংকটের কারণে আশ্রয়শিবিরের এক হাজার ১৭৯ জন স্থানীয় (বাংলাদেশি) শিক্ষকের চাকরির চুক্তি শেষ হয়। কিন্তু শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে আশ্রয়শিবিরের সব শিক্ষাকেন্দ্র অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর ৩ জুলাই শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করে বন্ধ থাকা শিক্ষাকেন্দ্রগুলো চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এক মাসের মধ্যে ইউনিসেফ তহবিল সংগ্রহ করতে পারলে শিক্ষকদের চাকরিতে পুনর্বহালের চেষ্টা চালানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এখনও তহবিল সংগৃহীত হয়নি। চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়া শিক্ষকদের বিষয়টি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাধ্যমে আশ্রয়শিবিরে ১৫০টি শিক্ষাকেন্দ্র চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানে চাকরি হারানো শিক্ষকদের মধ্য থেকে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়া হবে। এসব নিয়ে গত ৭ আগস্ট শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক করেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারপরও রাস্তা বন্ধ করে জনদুর্ভোগ বাড়ানোর কোনও কারণ দেখি না।’