মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :
# মামলা নিষ্পত্তি সর্বোচ্চ রেকর্ড
# এডিআর এর মাধ্যমে বছরে উপকারভোগী ১৭৪৮ জন
# লিগ্যাল এইড অফিস বিরোধ নিষ্পত্তির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত
কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিস ২০২৪ সালে অর্থাৎ গত এক বছরে এক কোটি এক লক্ষ ৮২ হাজার ২০০ টাকা বিভিন্নখাতে অর্থ আদায় করেছে। একই সময়ে আবেদন (মামলা) নিষ্পত্তি করা হয়েছে মোট ১ হাজার ১৮৫ টি। ২০২৪ সালে আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির হার শতকরা ১৩২’৮৫ ভাগ। যা কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের এ যাবৎ কালের সর্বোচ্চ সংখ্যক আবেদন নিষ্পত্তির রেকর্ড।
কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার ও সিনিয়র সহকারী জজ সাজ্জাতুন নেছা লিপি এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি আরো জানান, কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে মোট এডিআর (অলটারনেটিভ ডিসপুট রেজুলেশন) এর আবেদন করা হয়েছে ১ হাজার ৬০৯ টি। তারমধ্যে, ২০২৩ সালের এডিআর আবেদন ছিলো ৭১৭ টি এবং ২০২৪ সালের এডিআর আবেদন ৮৯২ টি। কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিস থেকে ২০২৪ সালে ২৭৭ টি মামলায় প্যানেল আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২০২৪ সালে এডিআর এর মাধ্যমে উপকারভোগী ছিলেন মোট এক হাজার ৭৪৮ জন। তারমধ্যে, নারী এক হাজার ১৮২ জন, পুরুষ ৫৩৯ জন এবং শিশু ২৭ জন।
একইসময়ে কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস থেকে মোট ৪ হাজার ২২০ জনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তারমধ্যে, ৩৭৭ জনকে সুনির্দিষ্ট মামলায় আইনগত সহয়তা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে, ২৯৩ জন নারী, ৮১ জন পুরুষ এবং ৩ জন শিশু। এছাড়া, ৩ হাজার ৮৪৩ জনকে বিনামূল্যে আইনী পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে, ২ হাজার ৬৫৭ জন নারী, এক হাজার ১৫৯ জন পুরুষ এবং ২৭ জন তৃতীয় লিঙ্গ।
কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার সাজ্জাতুন নেছা লিপি আরো জানান, বিগত বছরে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের উদ্যোগে ১৮টি আইনগত বিষয়ে সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠান করা হয়েছে। তারমধ্যে, মাসিক সভা ৫টি, প্যানেল আইনজীবীদের নিয়ে কর্মশালা ২টি, বিচারক ও আদালতের সহায়ক কর্মচারীদের অংশগ্রহণে সেমিনার ১টি, আইনগত সহয়তা দিবসে রেডিও প্রোগ্রাম ১টি, ক্লায়েন্ট ফলোআপ মিটিং ১টি, উখিয়ার রাজাপালং, পালংখালী ও হলদিয়া পালং ইউনিয়ন লিগ্যাল এইড কমিটির সাথে সেনিনার ৩টি। কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের নিয়ে সেমিনার ১টি, উখিয়া ও রামু উপজেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সাথে মতবিনিময় সভা ২টি এবং রামু’র রাজারকুল ইউনিয়ন কমিটির সাথে মতবিনিময় সভা ১টি। এসব সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানে ৩৪২ জন নারী এবং ৭১৫ পুরুষ অংশ নিয়েছেন। এছাড়া ব্যাপক পরিসরে জাতীয় আইনগত সহয়তা দিবস পালন করা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের প্রধান সহকারী খোকন মাহমুদ জানান, বিগত বছরে লিগ্যাল অফিসের উদ্যোগে আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে এক কোটি এক লক্ষ ৮২ হাজার ২০০ টাকা বিভিন্নখাতে অর্থ আদায়ের মধ্যে মোহরানার অর্থ, ক্ষতিপূরণের অর্থ, চিকিৎসা খরচ, জমি জমার অর্থ, বিদেশে নেওয়ার জন্য দেওয়া অর্থ ফেরত নেওয়া, সন্তান ও স্ত্রীর ভরনপোষণের অর্থ সহ আরো বিভিন্ন খাতের অর্থ রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার সাজ্জাতুন নেছা বলেন, লিগ্যাল এইড এর মূল উদ্দেশ্য হলো, বিরোধীয় বিষয় নিয়ে নিয়মিত আদালতে মামলা দায়ের না করে বিকল্প পন্থায় আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা করা। তাঁর মতে, সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগের ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে লিগ্যাল এইড এর মাধ্যমে বিরোধীপূর্ণ বিষয় আপোষ মিমাংসা করার আগ্রহ ও প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দিন দিন সেবা গ্রহীতার সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য ২০২১ সালে কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে বিরোধ নিয়ে আবেদন এসেছিল ৮৫৭ টি, ২০২২ সালে আবেদন এসেছিল ১ হাজার ৪৭ টি। ২০২৩ সালে আবেদন এসেছে ১ হাজার ৩৪৯ টি। আর ২০২৪ সালে আবেদন এসেছে ১ হাজার ৬০৯ টি।
তিনি আরো জানান, কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি ও কক্সবাজারের সিনিয়র জেলা ও দায়রা মুনসী আব্দুল মজিদের নির্দেশনায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের কার্যক্রমকে ক্রমাগত গতিশীল ও জনবান্ধব করা হচ্ছে। গত ১ জুলাই সরকার গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আইনগত সহয়তা প্রদান (সংশোধিত) অধ্যাদেশ-২০২৫ জারী করে দেশে প্রচলিত বিভিন্ন আইনের ৯টি ধারায় সংক্ষুব্ধ পক্ষকে নিয়মিত আদালতে মামলা দায়েরের পূর্বে প্রথমে লিগ্যাল এইড অফিসে মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আবেদন করাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে লিগ্যাল এইড অফিসের কার্যক্রমের পরিসর আরো অনেক ব্যাপৃত হয়েছে। নিয়মিত আদালতে মামলার জট ও চাপ কমাতে সরকার এ উদ্যোগ নিয়েছে বলে বিচারক সাজ্জাতুন নেছা লিপি জানান।
তিনি আরো বলেন, জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সভাপতি ও কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা মুনসী আব্দুল মজিদের নেতৃত্বে, বিচারক, আইনজীবী, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর ও সংস্থা, জনপ্রতিনিধি, সেবাপ্রার্থী সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে নিয়ে কক্সবাজারের লিগ্যাল এইড কার্যক্রমকে একটা মডেল লিগ্যাল এইড কার্যক্রম হিসাবে গড়ে তুলতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছি। যাতে সরকারের লিগ্যাল এইড কার্যক্রম এর সুফল অতি সহজে সকলের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়া যায়।
কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ছৈয়দ আলম বলেন, কক্সবাজারে লিগ্যাল এইড এর কার্যক্রম গতিশীল থাকায় নিয়মিত আদালতে মামলার জট কিছুটা হলেও কমছে। লিগ্যাল এইড অফিসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও কমছে। বিচারপ্রার্থীরা মামলা চালানোর অর্থ ও দীর্ঘসুত্রীতার বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে সেবাপ্রার্থী নাগরিকদের সুবিধার জন্য সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, মাতৃদুগ্ধ কর্ণার, ওয়েটিং চেয়ারের ব্যবস্থা, টিভি মনিটরে লিগ্যাল এইড বিষয়ক ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, পৃথক মিডিয়েশন রুম, নাগরিকদের ধারণা লিপিবদ্ধ করতে লিগ্যাল এইড রেজিস্ট্রার, পরামর্শ বক্স স্থাপন ইত্যাদি কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে এবং সেবার মান বাড়িয়েছে। সরকারের উদ্যোগে বিনামূল্যে আইনী সেবা পাওয়ার বিষয়টি অবস্থাপন্ন পরিবারের লোকজন অবহিত হতে পারছে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাওহীদুল আনোয়ার বলেন, কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসে ২০২৪ সালে এডিআর এর মাধ্যমে এক হাজার ১৮৫ টি বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। নিষ্পত্তির হার শতকরা ১৩২’৮৫% ভাগ। আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাওহীদুল আনোয়ারের মতে, যদি ২০২৪ সালে এক হাজার ১৮৫ টি আবেদন এডিআর পদ্ধতিতে নিষ্পত্তি না হতো, তাহলে সেখান থেকে যদি শতকরা ৫০% ভাগ আবেদন নিয়মিত মামলা হিসাবে আদালতে দায়ের হতো, তাহলে ৫৯২ টি মামলা নিয়মিত আদালতে দায়ের হতো। নিয়মিত আদালত গুলোতে ৫৯২টি মামলার অতিরিক্ত চাপ থাকতো এবং এগুলোর বিচারকার্য সম্পন্ন হতে বছরের পর বছর লেগে যেতো। কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস বর্তমানে এডিআর পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য একটি অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে। তাঁর মতে, লিগ্যাল এইড অফিসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপোষ মিমাংসার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগও কমছে। বিচারপ্রার্থীরা মামলা চালানোর অর্থ ও মামলার দীর্ঘসুত্রীতার বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাচ্ছে। যা সমাজে অস্থিরতা নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির কার্যক্রম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির বর্ষ সেরা প্যানেল আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ বলেন, কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিস এখন শুধুমাত্র অস্বচ্ছল নাগরিকদের বিনামূল্যে আইনীসেবা দেওয়ার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নয়, বিভিন্ন ধরনের বিরোধ নিষ্পত্তি, ন্যায্য অধিকার নিশ্চিতকরণ ও বিচারপ্রার্থীদের ন্যায্য অর্থ আদায়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি কার্যক্রম খুবই গণমূখী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝেও এর প্রভাব ফেলেছে। তবে কক্সবাজারের লিগ্যাল এইড কার্যক্রমকে আরো অধিকতর গতিশীল করতে হলে প্রয়োজনীয় জনবল সাপোর্ট দিতে হবে। বিশেষ করে লিগ্যাল এইড অফিসে বেঞ্চ সহকারী, হিসাব সহকারী, অফিস সহায়ক নিয়োগ দিতে হবে। রেকর্ড রুম, ওয়েটিং রুম সহ প্রয়োজনীয় রুমের ব্যবস্থা করা দরকার। অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদের মতে, ইউনিয়ন, উপজেলা পরিদর্শন, প্রান্তিক পর্যায়ে গণশুনানি, উঠান বৈঠক, সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাতায়াত, ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কক্সবাজার জেলা লিগ্যাল এইড অফিসে প্রয়োজনীয় ট্রান্সপোর্ট সুবিধা দেওয়া দরকার।
কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিসের উপকারভোগী কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের সমিতি পাড়ার আনোয়ারা বেগম ও হামিদ হোসেন দম্পতি বলেন, লিগ্যাল এইড অফিস সহায়তা না করলে তাদের সুখের সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যেতো। তাদের কলিজার টুকরো একমাত্র সন্তানটি পিতা পেলে, মাতা পেতো না, মাতা পেলে পিতা পেতোনা। কক্সবাজার লিগ্যাল এইড অফিস বিপর্যস্ত ও ভেঙে পড়া তাদের সেই সাংসারিক জীবনকে আবারো গুছিয়ে দিয়েছে। তাদের পরস্পর দুরত্ব কমিয়ে দিয়েছে। ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের সাংসারিক জীবনে সুখের ঝর্নাধারা।
