পেকুয়া প্রতিনিধি:
কক্সবাজারের পেকুয়ায় সংরক্ষিত বনভূমিতে গড়ে ওঠা একটি অবৈধ পাকাবাড়ি উচ্ছেদ করেছে বন বিভাগ। রোববার (১৩ জুলাই) সকাল ১০টায় উপজেলার টইটং ইউনিয়নের ঢলারমুখ এলাকায় এই অভিযান পরিচালিত হয়। বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে অভিযানে সহায়তা করে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটি দল।
উচ্ছেদ হওয়া ভবনটির মালিক সৌদি প্রবাসী হেলাল উদ্দিন, যিনি স্থানীয় বদিউল আলমের ছেলে। অভিযোগ রয়েছে, তিনি দেশে ফিরে সংরক্ষিত বনভূমির প্রায় এক একর জমি জবরদখল করে আধাপাকা স্থাপনা নির্মাণ করেন। বিষয়টি বন বিভাগের তদন্তে ধরা পড়লে গত ২ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে ফরেস্ট আইনে মামলা হয় (মামলা নম্বর: P.O.R ১৯)। পরে চকরিয়ার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে স্থাপনাটি উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে অবৈধ ভবনটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
রেঞ্জ কর্মকর্তা খালেকুজ্জামান বলেন, “সংরক্ষিত বনভূমিতে অনুমতি ছাড়া কোনো স্থাপনা নির্মাণ সম্পূর্ণ অবৈধ। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও এমন অভিযান চলবে।”
তবে এ হঠাৎ অভিযানে এলাকাজুড়ে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। স্থানীয়রা বলছেন, এই পাকাবাড়ি একদিনে গড়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন ধরে নির্মাণ চললেও বন বিভাগ কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। এখন হঠাৎ উচ্ছেদ নিয়ে সন্দেহের জায়গা থেকেই যায়।
এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এখানে টাকা দিলে সব হয়। আজ হয়তো বন বিভাগের সঙ্গে টাকা লেনদেন হয়নি, তাই উচ্ছেদ। না হলে এতোদিন চুপ ছিল কেন?”
আরেকজনের মতে, “এমন অসংখ্য স্থাপনা আছে, যারা বছরের পর বছর ধরে দখল করে আছে। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা হয় না। এই একটিকে ‘দেখানো অভিযান’ বললেও ভুল হবে না।”
পাহাড়ি এলাকায় সংরক্ষিত বন দখলের অভিযোগ নতুন নয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানের অনেক জায়গায় দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে রিসোর্ট, চাষাবাদ ও বসতঘর। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এসব অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ না থাকায় প্রশাসনের নিরবতা ও দুর্নীতির অভিযোগও বেড়েছে।
পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, “বন দখল শুধু পরিবেশ নয়, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের অপরাধ। এতে জলবায়ু সহনশীলতা ও পাহাড়ি বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হয়।”
স্থানীয়দের মতে, এসব অবৈধ স্থাপনা প্রশাসনের “নজরদারির বাইরে” নয় বরং “নজরদারির মধ্যেই” গড়ে উঠছে। নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে বনভূমি দখল এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে প্রশাসনের একাংশও জড়িত বলে অভিযোগ।
পেকুয়ায় এক ভবন উচ্ছেদের ঘটনাটি কেবল একটি দখলের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং পাহাড়ি বনাঞ্চলের বাস্তবতা। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বারবার প্রভাবশালীদের কবলে চলে যাচ্ছে—কখনো দাপ্তরিক নীরবতায়, কখনো প্রশাসনিক সহানুভূতিতে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রয়োজন নিয়মিত ও পক্ষপাতহীন অভিযান, স্বচ্ছতা এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করে জবাবদিহিমূলক বন ব্যবস্থাপনা। একদিনের অভিযান নয়, চাই নিয়মিত মনিটরিং ও কঠোর আইন প্রয়োগ। নয়তো ‘বন রক্ষা’র নামে উচ্ছেদ অভিযান আরেক নাটকের নাম হয়ে থাকবে।
