রাশেদ মোহাম্মদ আলী 

১৯৯১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকুলে একটি স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে, যার ফলে ১,৩৫,০০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়, বসতভিটা লন্ডভন্ড হয়ে যায় এবং ১.৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হয়। বিশেষ করে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকা গুলো ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছিল। উপকূলীয় এলাকায় মৃত মানুষের ছড়াছড়ি। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল। সারি সারি লাশ দাপন করতে দেখেছি। মানুষের সাথে অসংখ্য গবাদিপশু মারা যায়। বেড়ি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় যারা জানে বেঁচেছিলেন তাঁরাও অনেক দিন পানি বন্দী ছিলেন।

একই বছরের ২৭ এপ্রিল ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, কক্সবাজার জেলা শাখার সম্মেলন ও কাউন্সিল। প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক, বন-পরিবেশ, মৎস্য ও পশুসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান। প্রধান বক্তা ছিলেন তৎকালীন ডাকসু ভিপি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় আহবায়ক, এমপি আমান উল্লাহ আমান, তৎকালীন ডাকসুর জিএস খায়রুল কবির কোখন, ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি ছাত্রনেতা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের লড়াকু ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান রতন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের তৎকালীন ভিপি ও ছাত্রদল নেত্রী শিরিন সুলতানা, কক্সবাজার জেলার একমাত্র বিএনপির এমপি শাহাজাহান চৌধুরী, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও মন্ত্রী মহোদয়ের এপিএস সৈয়দ আলমগীর কবির, কক্সবাজার জেলা বিএনপির তৎকালীন সভাপতি একরামুল হুদা চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী, গোলাম কিবরিয়া, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদল নেতা তৈমুর আহমেদ( মৃত), আবু সুফিয়ান(চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক), নাজিমুর রহমান(চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব), মোহাম্মদ আলী(মৃত) সহ স্থানীয় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ পাবলিক লাইব্রেরি হলে কক্সবাজার জেলা ছাত্রদলের সম্মেলন ও কাউন্সিলে উপস্থিত ছিলেন। কক্সবাজার হিলটপ সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে এই সম্মেলনের কাউন্সিলে প্রত্যক্ষ ভোটে আকতার চৌধুরী সভাপতি(ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, কক্সবাজার সিটি কলেজ), রফিকুল ইসলাম(এডভোকেট) সাধারণ সম্পাদক এবং আক্কাস মিয়া সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিল। গভীর রাত পর্যন্ত এই কাউন্সিল অধিবেশন চলে। ফলাফল ঘোষণার পর রাত প্রায় তিন টায় নোমান ভাই সহ ঢাকা থেকে আগত ছাত্রনেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দরা আমার বাসায় রাতের খাবারের দাওয়াতে অংশ নিয়েছিলেন।

এই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারীর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে এককভাবে সরকার গঠন করে বিএনপি। সরকারে আসার ১মাস পর ২৯ এপ্রিল স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এই প্রলয়ঙ্কারী ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে। ঘুর্ণিঝড়ে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নুতন সরকারকে হিমসিম খেতে হয়েছিল কিছুদিন। ২৮ এপ্রিল হঠাৎ আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা দিল। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও গুমোট। প্রচন্ড গরম অনুভুত হচ্চিল। আবহাওয়া অফিস ঘুর্ণিঝড়ের আশঙ্কায় জনগণকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে ৭ কি ৮ নাম্বার বিপদ সংকেত ঘোষণা দিল। আবহাওয়া খারাপ হওয়ায় ঢাকা থেকে আগত নেতৃবৃন্দরা ব্রেকফাস্ট সেরে সড়ক পথে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ আল নোমান ভাই যেতে পারলেননা। উনার সাথে চট্টগ্রাম থেকে আসা ছাত্র নেতৃবৃন্দরাও থেকে গেলেন। বিকালের দিকে মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে ঢাকা থেকে খবর আসে কক্সবাজার ছেড়ে না যেতে। সম্ভাব্য ঘুর্ণিঝড় মোকাবেলায় নোমান ভাইকে কক্সবাজার জেলায় দায়িত্ব দেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে উনি কক্সবাজারের জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে কক্সবাজারের উন্নয়নে তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেন। ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় আবহাওয়া অফিস থেকে ১০ নাম্বার মহা বিপদ সংকেত এর ঘোষণা দেয়া হয়। এর আগে সারাদিন মন্ত্রী নোমান ভাই জেলা প্রশাসন, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে কর্মব্যস্ত সময় কাটান। সম্ভাব্য ঘুর্ণিঝড় মোকাবেলায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন। বিকালে আকাশ গুমোট থাকলেও বৃষ্টি ও বাতাসের কোন লক্ষন দেখিনি। ঘুর্ণিঝড়ের কোন সম্ভাবনা দেখছিনা। চট্টগ্রামের ছাত্রনেতৃবৃন্দ সহ আমি আর আকতার চৌধুরী সী-বীচে ঘুরতে যাই। বীচ থেকে আমরা রাডার স্টেশনে আসলাম ঘুর্ণিঝড়ের অবস্থা জানতে। রাডার স্টেশনের ভেতর ঢুকলাম। দায়িত্বরত কর্মকর্তা আমাদের ঘুর্ণিঝড়ের গতিপথ দেখাচ্ছিলেন এবং বললেন রাত সারে নয়টার পর ঘুর্ণিঝড়টি কক্সবাজার উপকুল অতিক্রম করবে। ঠিক সাড়ে নয়টায় আমরা যখন রাডার স্টেশনের ভেতরে তখন ঝড় ও বাতাসের গতিবেগ বাড়তে শুরু করে। দেখলাম ঘড়িতেও নয়টা ত্রিশ মিনিট। আমরা রাডার স্টেশন থেকে বের হয়ে বৃষ্টি ও বাতাসের গতিবেগ বেড়ে যাওয়ায় হিলটপ সার্কিট হাউসে যেতে আমাদের অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হলো। অথচ রাডার স্টেশন থেকে হিলটপ সার্কিট হাউস মাত্র কয়েক গজ। আমরা অনেক ঝুকি নিয়েই তবে সার্কিট হাউসে ফিরলাম। বৃষ্টিতে আমরা সবাই কাক ভেজা। নোমান ভাই তখন হিলটপ সার্কিট হাউসের ভিআইপি রুমে অবস্থান করছিলেন। আমরা হিলটপ সার্কিট হাউসে পৌঁছে সরাসরি ভিআইপি রুমে যায়। আমি আর আকতার বাসায় যেতে পারলামনা। ঘুর্ণিঝড় তখন ভয়াবহ রুপ নিচ্ছিল। বাইরে যাবার কোন সুযোগ ছিলনা। প্রচন্ড বাতাস আর বৃষ্টি। আমরা তখন প্রায় বিশ বাইশ জনের মত ছিলাম। নিচ তলার রুমে যারা ছিলেন তারও উপরে ভিআইপি রুমে চলে আসলেন। রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিলাম। নোমান ভাই সহ দশ জনের খাবার আমরা ২০ জনে ভাগাভাগি করে খেলাম। এরপর ঘুমানোর পালা। ভিআইপি রুমে আমরা সবাই গাদাগাদি করে শুয়ে পড়লাম। নোমান ভাই খাটের উপর আর আমরা সবাই নিচে কার্পেটের উপর কোনরকম ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। বাতাসের শব্দে আমরা ঘুমাতে পারছিলামনা। মনে হচ্ছিল বাতাসে দুইতলার এই রুমটা দুলছিল। এমনিতে হিলটপ। সমতল থেকে পাহাড়ের অনেক উপরে। দুই তলায় আমরা। প্রচন্ড বাতাস। প্রচুর বৃষ্টি। সাথে বিজলি চমকাচ্ছিল। বিজলি চকমকানোর জ্বলকানিতে পুরো এলাকা আলোকিত এবং আবারও অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছিল। বাতাস, বৃষ্টি ও আলো আঁধারির এই খেলায় আমরা এক ভৌতিকময় রাত পার করছিলাম। সত্যি রাতটি উপভোগ্য ছিল! তবে আমাদের জন্য এক ভয়ংকর আগামী সকাল অপেক্ষা করছিল। গভীর রাতে ঘুর্ণিঝড়টি প্রলয়ের রুপ ধারণ করে। ঘুর্ণিঝড়ের তীব্রতায় আমাদের সবার ঘুম ভেঙে যায়। আমাদের বিল্ডিং বাতাসে কাঁপছিল। নারিকেল গাছের পাতায় পাতায় ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি আমাদের চোখ এড়ায়নি। ঘুর্ণিঝড়েরও একটি শব্দ আছে। সেই ভয়াল রাতে জীবনে প্রথম ঘুর্ণিঝড়ের ভয়ঙ্কর গর্জন শুনেছিলাম। আমরা আর ঘুমুতে পারিনি। টানা অনেক্ক্ষণ চলে এই তান্ডবলীলা। ফজরের নামাজের আগে আগে ঘুর্ণিঝড়ের শক্তি কিছুটা কমে আসে। তারপর আমরা আবারও কিছুক্ষণ ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।

২৯ এপ্রিল সকাল। যখন আমার ঘুম ভাঙে, চোখ মেলে দেখলাম নোমান ভাই রেডি হচ্ছেন। আমাদের রেখেই উনি চলে গেলেন। কোথায় যাচ্ছেন এবং গেলেন জানিনা। আমি সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে আমি বাসায় আসলাম। বাসার গাছপালা ভেঙে লন্ডভন্ড। বিদ্যুৎ নেই। পানি নেই। বাতাস নেই। বৃষ্টিও নেই। রোদ উঠেছে। উনত্রিশে এপ্রিলের সকাল ছিল রৌদ্রজ্বল। আমি তাড়াতাড়ি বেশী করে ডিম সিদ্ধ আর পাউরুটি নিয়ে আবার হিলটপে ফিরে আসি। সবাইকে নাস্তা করালাম। নাস্তা শেষে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। পথে খবর নিয়ে জানতে পারলাম মন্ত্রী সাহেব মানে নোমান ভাই কক্সবাজার সদর থানায় আছেন। আমরাও থানায় পৌঁছলাম। পথে পথে গাছ পড়ে রাস্তা ব্লক। তখনতো মোবাইল ছিলনা। ল্যান্ড ফোনও অচল। তাই জেলার উপকূলীয় উপজেলা/থানার ঘুর্ণিঝড়ের অবস্থার খবর অয়ারলেসে নিতে উনি মুলত থানায় এসেছিলেন। মন্ত্রীর নির্দেশে তারপর শুরু হলো ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন। ঘুর্ণিঝড়ে মৃত মানুষের লাশগুলো খোঁজে বের করা এবং সেগুলো দাপন-কাপনের ব্যাবস্থা করা। এরপর উনার নেতৃত্বে শুরু হলো ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা। কোর্ডিনেশন মিটিং। নোমান ভাইয়ের মিটিং গুলোত তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতারাও উপস্থিত থাকতেন।

কয়েকদিন পর প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘুর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহানুভূতি জানাতে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টার যোগে কক্সবাজার আসলেন। নোমান ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা সবাই দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রিসিভ করতে কক্সবাজার এয়ারপোর্টে গেলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে গাড়ীতে করে কলাতলী সহ ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসাবে ঢাকা থেকে আসা স্বাস্থ্য মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবেনে ইউসুফ এমপি, ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী লুৎফুর রহমান খান আজাদ এমপি ও রেডক্রিসেন্ট চেয়ারম্যান শহিদুল হক জামাল এমপি, কক্সবাজার ৩ আসনের এমপি প্রার্থী এড. খালেকুজ্জামান সহ বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। মানণীয় প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আহবান জানালেন। ম্যাডাম জিয়া হিলটপ সার্কিট হাউসের সম্মেলন কক্ষে একটি কোর্ডিনেশন মিটিংএ উপস্থিত থেকে ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সর্বশেষ উদ্ধার তৎপরতা, চিকিৎসা ও ত্রাণ কার্যক্রম সম্পর্কে জানলেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলেন।
আমরা যে যেভাবে পেরেছি সবাই ঘুর্ণিঝড়ের প্রলয়ে বেঁচে থাকা মানুষ গুলোকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে নোমান ভাইয়ের নেতৃত্বে কাজ করেছি।

নোমান ভাই টানা প্রায় এক বছর ঘুর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত কক্সবাজারকে পুনগঠনে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। উনি আজকে আমাদের মাঝে নেই। প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। কক্সবাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে উনার যে অবদান কক্সবাজারবাসী চিরদিন মনে রাখবে। আল্লাহ আমাদের সকলের সহায় হোন। আমীন।