বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলসমূহ মূলত ক্ষমতার অভিমুখী। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পরও একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্যোগ না নিয়ে তারা কেবল ক্ষমতার মসনদ দখলের জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে জাতীয় ঐক্য ও অগ্রগতির প্রশ্ন নিয়ে সংলাপ হওয়া অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলসমূহ বরাবরের মতোই জবাবদিহিমূলক সেই সংলাপকে উপেক্ষা করে কথিত নির্বাচনকেন্দ্রিক আলোচনাকে জাতীয় সংলাপে রূপান্তর করেছে। অথচ গত ৫৪ বছরের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা সাম্য, স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে—এমন প্রেক্ষাপটে তা কীভাবে গণঅভ্যুত্থানের পর প্রাসঙ্গিক সংলাপ হতে পারে?

অন্যদিকে, বিগত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের মানুষ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে যেভাবে শোষণ ও অধিকারবঞ্চনার শিকার হয়েছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো অনুশোচনার ছাপ দেখা যায়নি। অপরাজনীতির মাধ্যমে তারা যে সংকট তৈরি করেছে, সে সম্পর্কেও তাদের অবস্থান অস্পষ্ট। দেশের জনগণকে নিগৃহীত করে কখনোই রাজনীতি টিকতে পারে না।

আমি রাজনীতির সহজ অর্থ বুঝি—সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তি এবং সুষম সম্পদ বণ্টনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে কেউ বিচ্যুত হবে না। রাজনৈতিকভাবে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে, জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়াদি জানবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরাসরি অংশগ্রহণ করবে। একইসঙ্গে, স্বদেশী সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী থেকে অন্যান্য সাংস্কৃতিক ভাবধারার প্রতিও সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

কিন্তু বাংলাদেশে এমন দৃশ্যপট কখনোই দেখা যায়নি। এই অঞ্চলের মানুষ ১৯৪৭ সালের পূর্বে ব্রিটিশ শাসনের, এরপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর, এবং ১৯৭২ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বদেশী শাসকগোষ্ঠীর হাতে শোষিত হয়েছে। ফলে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে বারবার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অংশ নিয়েও সংবিধান নামক অলৌকিক এক ‘দৈত্য’ জনগণের জন্য এক ধরনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপ্লব বা সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষাগুলো ক্ষমতালোভী মানসিকতার যাঁতাকলে বারবার পিষ্ট হয়েছে।

এই চরম বাস্তবতা থেকে উত্তরণের পথ হলো জনগণের জন্য রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটানো এবং রাজনৈতিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের ধারাবাহিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রূপান্তর করা।

অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পূর্বশর্ত হলো জনগণকে তাদের রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলা। এই দায়িত্ব নিতে হবে রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকেই। কারণ, নির্বাচনের সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার জনগণ। যদি জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনায় নির্বাচনের ভূমিকা ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন না হয়, তবে নির্বাচনী আয়োজন শুধু আনুষ্ঠানিকতা হয়ে থাকবে।

এখন সময় এসেছে জনগণকেই দাবি তুলতে হবে—বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে কেন তাদের মানবিক ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে জনগণের অগ্রগতি ও কল্যাণ কীভাবে নিশ্চিত করবে, তা তাদের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে হবে।


আব্দুল মান্নান রানা, উপ-প্রধান লিডার, সিইএইচআরডিএফ