# এনাম মেম্বারের নাম বলতে সাক্ষীদের চাপ দেয় মার্কিন হত্যা মামলার আসামি ছিদ্দিক
# নিহতের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সাথে এজাহারের মিল নেই
#এজাহারের মানিত সাক্ষীদের নাটকীয় জবানবন্দি রেকর্ডে নেওয়ার অভিযোগ তদন্ত অফিসার সোহেল আহম্মদের বিরুদ্ধে
টেকনাফ সংবাদদাতা:
সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের নাজির পাড়ার বাসিন্দা মো.জুবাইর হত্যাকান্ড ঘিরে রহস্যের দানা বাঁধছে। গ্রেপ্তার দুই আসামির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি ও নিহতের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যে হুবহু মিল থাকার পরও হত্যা মামলাটিতে একজন জনপ্রতিনিধিকে প্রধান আসামি করে মামলা রেকর্ড করে টেকনাফ মডেল থানা তৎকালীন ওসি উসমান গনি। যা নিয়ে এলাকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, ‘চলতি বছরের ২৯ শে মার্চ সন্ধ্যার দিকে পবিত্র রমজান মাসের ইফতারের পর পাওনা টাকার জের ধরে খুন হন মো. জুবাইয়ের।এই হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দেন তারই বন্ধু ‘নজুমদ্দিন’। তার সঙ্গে সহযোগী হিসেবে যোগদেন ফিরোজ, কায়েস, মাসুদ, মাছনসহ বেশ কয়েকজন। বন্ধু জুবাইরের প্রতি ক্ষুব্ধ ‘নজুমদ্দিন অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে এই হত্যার মিশন শেষ করেন। তাকে গুলি করার পর পালিয়ে যায় হত্যাকারীরা। পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান জুবাইয়ের। ঘটনার আদ্যোপান্ত নিয়ে নিহতের পরিবার গণমাধ্যম ও সামাজিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ ও জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন।
কিন্তু মামলার এজাহারে এসব ব্যক্তি প্রধান আসামি করা হয়নি। মূল হত্যাকারীদের কথা গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে বললেও অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে এসব আসামিকে এড়িয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বার এনামুল হককে প্রধান করে আরও কয়েকজন নিরপরাধ মানুষকে আসামি হিসেবে মামলা দায়ের করা হয়। যা দেখে রীতিমতো চমকে উঠেন টেকনাফের সচেতন মহল। অদৃশ্য শক্তির চাপেরমূখেই জুবাইরের মাকে দিয়ে স্থানীয় মেম্বারকে ফাঁসানোর কথা জানিয়েছে ‘অত্র এলাকার সাধারণ মানুষ।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, ‘ঘটনার পরপরই তৎকালীন টেকনাফ থানার ওসি ওসমান গণির নেতৃত্বে শুরু হয় পুলিশি অভিযান। জুবায়ের হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অপরাধে ঘাতক নজুমদ্দিনের আপন মামাতো ভাই মাসুদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।মাসুদকে আদালতে সোপর্দ করলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় গ্রেপ্তার মাসুদ।
১৬৪ ধারার মাসুদের জবানবন্দি নথি প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। বক্তব্যে স্পষ্ট উঠে আসে হত্যাকান্ডের নেতৃত্ব দাতা ও হত্যাকারীদের নাম। কিন্তু পুলিশ উদ্দেশ্যে প্রণোধিতভাবে এনামুল হক মেম্বারকে প্রধান আসামি রেখে প্রশ্নবিদ্ধ মামলা রেকর্ড করেন।
জবানবন্দিতে যা বলেছেন আসামি:
মাসুদ-চলতি বছরের ২৯ শে মার্চ ইফতারের পর নজুমদ্দিন ও ফিরোজ মাসুদের বাড়িতে এসে মাসুদের চাচা কায়েসের সাথে কথা বলে মাসুদের হাতে তুলে দেয় ধারালো অস্ত্র।
নজুমদ্দিন ও ফিরোজের কাছে ছিল দুইটি পিস্তল,
কায়েসের হাতে ছিল ধারালো অস্ত্র।মাঝপথে যুক্ত হয় হোসেনসহ আরও কয়েকজন।জবানবন্দিতে আরও বলেন, ‘নিহত জুবায়েরের সাথে কায়েসের পূর্ব শত্রুতা থাকায় প্রতিশোধ নিতে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।পরিকল্পনা মতে জুবায়েরের বাড়ির সামনে ফিরোজ ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে। নজুমদ্দিন,কায়েস, ফিরোজ, হোসেনসহ কয়েকজন জুবায়েরের বাড়িতে প্রবেশ করে।সেখান থেকে বেরিয়ে নজুমদ্দিন চিৎকার করে বলে জুবায়েরকে শেষ করে দিয়েছি। এছাড়া নজুমদ্দিনের গুলিতেই জুবাইয়েরের মৃত্যু হয়েছে বলে আদালতে স্পষ্ট জবানবন্দি দেন।
জুবায়ের হত্যা মামলার মূল রহস্য ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে অবৈধ টাকার বদৌলতে আরেকটি ছক শুরু করে মামলার তদন্তকারী অফিসার সোহেল আহমদ। জুবায়ের হত্যা মামলার মানিত ৪ জন স্বাক্ষীকে তদন্ত অফিসারের মধ্যস্থতায় হাজির করা হয় আদালতে।আদালতে বলতে শিখিয়ে দেওয়া হয় এনাম মেম্বারের গুলিতে জুবায়ের নিহত হয়েছে। ৪ জন সাক্ষীর নাটকীয় জবানবন্দি রেকর্ড করেন আদালত।পুলিশের সুষ্ঠ তদন্ত নিয়ে সমালোচনা হয় পুরো টেকনাফ জোরে।
এজাহারের ৪ জন মানিত সাক্ষীর নাটকীয় জবানবন্দি নেওয়ার পর আবারও রহস্য উদ্ঘাটন হতে যাচ্ছিল জুবায়ের হত্যার। কিছুদিন পর হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত আসামি মোঃ হোছন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে আদালতে ১৬৪ জবানবন্দি দেয়।দুইজনের জবানবন্দির কোথাও ‘এনাম মেম্বারসহ অন্যান্য আসামির নাম উঠে আসেনি। এছাড়া ঘটনার দিন নিহতের পরিবারের গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে দেয়া বক্তব্যের সাথে হুবহু মিল রয়েছে জবানবন্দির মোঃ হোসেনের জবানবন্দির নথিও প্রতিবেদকের হাতে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে ওসি নিজে পরিদর্শন করে জুবায়েরের পরিবারের স্পষ্ট বক্তব্য নোট করলেও এনাম মেম্বারকে প্রধান আসামি হিসেবে মামলা রেকর্ড করেন। যা নিয়ে পুলিশের সুষ্ঠু তদন্ত কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
“মাত্র ৮০০ টাকার জন্য বন্ধুর গুলিতে বন্ধু নিহত” এই শিরোনামে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনাটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসে কে বা কারা জুবায়েরকে গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু ঘটনার দুইদিন পরে নিহত জুবায়ের এর মা বাদী হয়ে ৮ জনের নাম উল্লেখসহ টেকনাফ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ০২.জি আর ১৮০/২৪। মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, স্থানীয় ইউপি সদস্য এনামুল হককে প্রদান আসামি করা হয়।
ঘটনার রহস্য উদঘাটনে এই প্রতিবেদক সরেজমিনে গিয়ে পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলেন। সেখানে উঠে আসে ঘটনার মূল রহস্য।
প্রতিবেদকের কাছে একাধিক ব্যক্তি দাবি করেন, ‘নিহত জুবাইরের মা মাবিয়া খাতুন ও ২০১৫ সালে আজিজুল হক মার্কিন হত্যা মামলার আসামি ছিদ্দিক মামাতো ফুপাতো ভাই-বোন। আর নিহত মার্কিন ছিলেন ‘এনাম মেম্বারের ভাই। সে সময় ভাই হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেন এনাম পরিবার। তাতেই ক্ষিপ্ত হয়ে মার্কিন হত্যা মামলার আসামি ছিদ্দিক পুলিশ ও তার বোন নিহত জুবাইরের মাকে ব্যবহার করে এনামকে এই মামলায় প্রধান আসামী করেন।
নাজির পাড়া বড় জামে মসজিদের সভাপতি মমতাজ মিয়া প্রতিবেদককে বলেন, ‘নিহত জুবাইরের মা মাবিয়া খাতুন ও ২০১৫ সালে আজিজুল হক মার্কিন হত্যা মামলার আসামি ছিদ্দিক মামাতো ফুপাতো ভাই-বোন। ছিদ্দিকের পরামর্শ ছাড়া মাবিয়া চলেন না।ছিদ্দিকের কথা ধরে স্থানীয় ইউপি মেম্বারকে আসামী করা হয়েছে।
মামলাটির বাদীপক্ষের ৩নং সাক্ষী মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘ঘটনার বর্ণনা দেয়ার পর ছিদ্দিকসহ কয়েকজন ‘এনাম গুলি করেছে বলতে চাপ সৃষ্টি করেন।তাদের চাপেরমূখে অন্য সাক্ষীদের মতো তিনিও এনামের নাম বলতে বাধ্য হন।যা প্রতিবেদকের কাছে ভিডিও আকারে সংরক্ষিত আছে।
২নং সাক্ষী শামসুল আলম বলেন, ‘জুবাইরকে ৮০০ টাকা পাবে এমন কথা বলে বাসার ভেতরে ঢুকে জুবাইরকে গুলি করে নজুমদ্দিন, ফিরোজ, মাছন।সেই ৮০০ টাকা নিয়ে তাদের সঙ্গে জুবাইয়েরের বেশ কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয় বলে জানান এই সাক্ষী। কিন্তু ঘটনার দুইদিন পরে চাচাতো ভাই জুবায়ের মা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলা হওয়ার একদিন পর জানতে পারি স্থানীয় মেম্বারকে আসামি করছে। পরবর্তী মামলার এজাহার অনুযায়ী আদালতে আমাকে সাক্ষী দিতে বললে সাক্ষী দিই। যা ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে।
ঘটনার সময় নিহত জুবাইরকে কে বা কারা গুলি করে হত্যা করেছে, নিহত জুবায়ের পরিবারের সকলের ভিডিও বক্তব্য সংরক্ষিত আছে প্রতিবেদকের কাছে।
অভিযোগ আছে, ‘টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি ওসমান গণি ছিলেন মার্কিন হত্যা মামলার আসামি ছিদ্দিকের আস্থাবাজন। তাকে অর্থের বিনিময়ে মেনেজ করে এনামকে ফাসানো হয়েছে। শুধু এনাম নয় আরও কয়েকজন নিরীহ লোককে আসামি করা হয়।
জুবায়ের হত্যা মামলার আরেক আসামি শামসুল হকের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের।
শামসুল হক বলেন, জুবায়ের হত্যাকান্ডে কতজন জড়িত ছিল আমিসহ এলাকার সবাই অবগত আছেন। কিন্তু নিহত জুবায়ের এর মা টাকার কাছে বিক্রি হয়ে আমাকে আসামী করছে। মূলত জুবায়ের হত্যার মিশনে অংশ নিছে,
মোঃ হোছন, নজুম উদ্দিন, কায়েস, ফেরুস ও মাসুদ। অথচ আমাকে আসামি করে আজ আমার পরিবার ধ্বংসের পথে।
জুবায়ের হত্যা মামলার আরেক আসামি শুক্কুরের সাথে সরাসরি দেখা হয় প্রতিবেদকের।
শুক্কুর দাবী করেন, ফুটবলার জুবায়েরকে কি কারণে হত্যা করা হয়েছে এলাকার সবাই অবগত আছেন। কিন্তু আমাকে অহেতুক আসামী করছে নিহত জুবায়ের এর মা টাকার বিনিময়ে। জুবায়ের হত্যাকান্ডে অংশ নেওয়া আসামীদের মধ্যে আমার আপন ছোট ভাই মোঃ হোছনসহ জড়িত ছিল। ঘাতক নজুম উদ্দিন, ফেরুস, কায়েস, মাসুদ কিন্তু অদৃশ্য কারণে ঘটনার দুইদিন পরে আমি জুবায়ের হত্যা মামলার আসামি পুলিশ চাইলে এমন কিছু ইতিহাস তৈরি করতে পারে আগে জানতাম না।
কক্সবাজার জেলার নব নিযুক্ত পুলিশ সুপারের কাছে অত্র এলাকার সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা,’নতুন পুলিশ সুপারের কাছে নিহত জুবায়ের সঠিক বিচার পাবে।হত্যার মূল রহস্য উদ্ঘাটন হবে,হত্যাকারীরা সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আসবে বলে মনে করেন অত্র এলাকার মান্যগণ্য ব্যক্তিরা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সরেজমিন তদন্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে যাদের সম্পৃক্ত নিশ্চিত হবে তাদের প্রত্যেককে আমরা বিচারের মুখোমুখি করবো। ”
এ বিষয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ বলেন, ‘দায়িত্ববার নেবার পর একজন পুলিশ কর্মকর্তা সরেজমিন, সাক্ষীদের জবানবন্দি, প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলাসহ বিভিন্ন বিষয় যাচাই-বাচাই করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।পর্যায়ক্রমে কর্মকর্তারা যাচাই-বাচাই করেই আদালতের কাছে হস্তান্তর করা হবে। স্বচ্ছ পুলিশিংয়ের বাইরে যাবে না এ হত্যা মামলার প্রতিবেদন। সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে মামলাটি।
ভুক্তভোগী এনাম মেম্বার উক্ত মামলার সুষ্ট তদন্তের আবেদন করেন পুলিশ মহাপরিদর্শক আইজিপি/চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি ও কক্সবাজার এসপি বরাবর।
আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামির ১৬৪ ধারা জবানবন্দি, পত্রপত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে। টেকনাফ থানা থেকে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা শাখায় হস্তান্তরের নির্দেশ দেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।