নিজস্ব প্রতিনিধি:
বহিরাগত ও সাবেক শিক্ষার্থীদের দখলে চলে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় এবং সায়েন্স লাইব্রেরী। তাদের দাপটে কোণঠাসা নিয়মিত শিক্ষার্থীরা।বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

চাকরিপ্রার্থীদের দখলে ঢাবির দুই লাইব্রেরী:
নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী এবং সাইন্স লাইব্রেরী চালু করা হলেও তা এখন চলে গেছে চাকুরি প্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের দখলে। তাদের অধিকাংশই সাবেক শিক্ষার্থী।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত শিক্ষার্থীরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী সাবেক শিক্ষার্থীরা চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা পর্যন্ত নিজ নিজ হলের প্রভোস্ট থেকে প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে লাইব্রেরী কার্ড করে পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও এই নিয়মের তোয়াক্কা করছে না সাবেক শিক্ষার্থীরা।
লাইব্রেরী প্রশাসন সূত্রে জানা যায়,এ পর্যন্ত সাবেক শিক্ষার্থীদের কেউই হল প্রভোস্টের প্রত্যয়ন পত্র জমা দিয়ে লাইব্রেরী কার্ড ইস্যু করে নি।

লাইব্রেরীতে বসার জায়গা পেতে ভোর থেকে দীর্ঘ লাইন:
সকাল নয়টা থেকে লাইব্রেরী খোলা হলেও কয়েক দিন ধরে দেখা গেছে ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের সামনে ঢোকার লাইনে ব্যাগ রেখে পাশে বই নিয়ে পড়ছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামনে ৪৫তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। এ জন্য লাইব্রেরিতে চাকরিপ্রার্থীদের ভিড় আগের চেয়ে বেশি। তবে সারা বছরই এখানে চাকরিপ্রার্থীরা বিসিএসসহ বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতি নিতে পড়তে আসেন ।

ডাইনিং টেবিলে পরিণত হয়েছে লাইব্রেরীর পড়ার টেবিল: পড়াশোনার মাঝখানে ক্লান্তি দূর করতে এবং পেটের ক্ষুধা মেটাতে নানা ধরনের শুকনো খাবার পড়ার টেবিলে নিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা।কেউ কেউ মৌসুমী ফল নিয়ে আসে খেতে।
গতকাল ১৭ মে এবং আজ ১৮ মে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী এবং সায়েন্স লাইব্রেরী পরিদর্শন করে দেখা গেছে কাচা আম, পেয়ারা, লিচু, পাকা কলা , শুকনো বাদাম,শুকনো চানাবুট, চানাচুর ইত্যাদি পড়ার টেবিলে পড়ে আছে।

ঢাবির বিজ্ঞান লাইব্রেরীতে সাবেক শিক্ষার্থীদের হাতে বর্তমান শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান লাইব্রেরীতে সিটে “পড়তে বসা” কে কেন্দ্র করে গত ৩০ এপ্রিল সাবেক শিক্ষার্থীদের হাতে বর্তমান এক শিক্ষার্থী লাঞ্ছিত হয়েছেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম জালাল আহমদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম এন্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র।
এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে প্রধান লাইব্রেরীয়ান এবং উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান
বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ওই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জালাল আহমদ জানান, “ওইদিন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আমি বিজ্ঞান লাইব্রেরীর ২ নাম্বার রুমে পড়তে বসি। দুপুর বারোটায় খাবার ও একটায় জোহরের নামাজ শেষে আমি আবার আমার টেবিলে পড়তে চাইলে এস এম হলে সংযুক্ত সংস্কৃত বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের সাবেক এক ছাত্র আমাকে টেবিলে পড়তে বাধা দেয়। আমি তখন বলি আমি এখনো রানিং ছাত্র এবং আমার লাইব্রেরী কার্ড আছে। আপনি আমাকে লাইব্রেরী থেকে বের করে দিতে পারেন না। আমি তাকে লাইব্রেরী কার্ড দেখাতে বললে সে বলে আপনি আমার লাইব্রেরী কার্ড দেখার কে? আমি তখন প্রধান লাইব্রেরীয়ান প্রফেসর নাসির উদ্দিন মুন্সী কে বিষয়টি জানালে তিনি উপ- গ্রন্থাগারিক দিলীপ চন্দ্র বিশ্বাসের সাথে কথা বলতে বলেন।
প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ” আমি দিলীপ চন্দ্র বিশ্বাসের সাথে কথা বললে তিনি জানান, “আমি এখন একটু লাইব্রেরীর বাইরে আছি। ১৫-২০ মিনিট পর লাইব্রেরীতে আসতেছি।
১৫ মিনিট পর আসতে বলে তিনি আসেন এক ঘণ্টা পর। দুপুর দুইটা ৫০ মিনিটে দিলীপ চন্দ্র বিশ্বাস আরও একজন লাইব্রেরীর কর্মকর্তা কে নিয়ে ২ নাম্বার রুমে ঘটনা সমাধান করে দিতে আসেন।
লাইব্রেরী কার্ড দেখতে চাইলেও এস এম হলের ঐ ছাত্র লাইব্রেরী কার্ড দেখাতে পারে নি। তিনি অবৈধভাবে লাইব্রেরীতে বসে পড়াশোনা করছেন।
এ সময় বেশ কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থী আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন।পরে আমি বই খাতা নিয়ে চলে আসি। এখানে প্রশাসন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি।

ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রধান লাইব্রেরীয়ান অধ্যাপক ডক্টর মোঃ নাসির উদ্দিন মুন্সী বরাবর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার পরও তিনি কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বরাবর গত ১৪ মে একটি লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক সউদ আহমেদ কে বিষয়টি প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।

হাতেনাতে ধরা পড়লো বহিরাগত ৭ জন শিক্ষার্থী:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে সবসময় ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে দেখা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমান জানান
” গত ১১মে ক্লাস শেষে আমরা ৬ বন্ধু মিলে সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে গিয়ে কার্ড চেক করে ৭ জন বহিরাগতকে ধরেছি।তাদেরকে প্রশাসনের হাতে তুলে দিয়েছি।প্রশাসন তাদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে ছেড়ে দিয়েছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৪৫ তম বিসিএসের প্রিলি অতি সন্নিকটে।তাই লাইব্রেরিতে ভীড় তুলনামূলক বেশি।সিরিয়াল ধরেও আমরা সীট পাইনা।অথচ বহিরাগতরা দেদারসে সীট দখল করে বসে আছে। যেসব বহিরাগত শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসে, তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন না কোন ভাইয়ের প্রটোকলে এখানে আসে। কার্ড চেক করা লাইব্রেরী প্রশাসনের দায়িত্ব হলেও তারা এ দায়িত্ব পালন করেন না।লাইব্রেরীতে দায়িত্বরত অফিসারদেরকে বলতে গেলে তারা একজন আরেকজনের কাছে পাঠায়।এ যেন লাল ফিতার দৌরাত্ম!!

হলের রিডিং রুমেও বহিরাগত শিক্ষার্থী:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি আবাসিক হলের রিডিং রুমেও সাবেক ও বহিরাগত শিক্ষার্থীদের দাপট ।তার সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ইচ্ছুক পরীক্ষার্থীরা। এ নিয়ে
হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের ছাত্র
রায়হান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন , “রিডিং রুমে বর্তমানে ইউনিভার্সিটি এডমিশন ক্যান্ডিডেট এর জন্য হলের অধিকাংশ ছাত্র রিডিং রুমে সিট পাচ্ছে না।
আসন্ন ১৯ তারিখ বিসিএস পরীক্ষার্থী ভাইরা পর্যন্ত পর্যাপ্ত সিট না পেয়ে রুমে ফিরে যাচ্ছে এছাড়াও বেশিরভাগ ডিপার্টমেন্ট এর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে।
এমতাবস্থায় রানিং স্টুডেন্টদের জন্য রিডিং রুমে সিট প্রয়োজন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লাইব্রেরীয়ান অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন মুন্সীর সাথে দফা দফায় যোগাযোগ করলেও তিনি ব্যস্তার অজুহাত দেখিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ডক্টর এম. মাকসুদুর রহমান জানান, আমার সুস্পষ্ট
বক্তব্য হচ্ছে নিয়মিত শিক্ষার্থীরাই লাইব্রেরী ব্যবহার করতে পারবে। তবু প্রভোস্ট কমিটির বক্তব্য অনুযায়ী সদ্য সাবেক শিক্ষার্থীদের চাকরির বয়সসীমা পর্যন্ত লাইব্রেরীতে পড়ার সুযোগ আছে। কিন্তু লাইব্রেরী প্রশাসন যেন প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে একটা কার্ড করে দেয়। তাহলে কার্ড দেখে বহিরাগত শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করতে সুবিধা হবে।