সিবিএন ডেস্ক:
এক নারীর পাল্লায় পড়ে কক্সবাজার থেকে নৌপথে জাপান যাওয়ার জন্য ঘর ছেড়েছিল রাজধানীর পল্লবীর তিন শিক্ষার্থী। এ জন্য তারা জাপানি সিনেমা দেখে ভাষাও কিছুটা আয়ত্ত করেছিল। এরপর ধরেছিল এক নারী দালালকে। তার কথায় ঘর থেকে বের হয়ে জাপানি স্টাইলে চুলও ছাঁটে তারা। তবে কক্সবাজার পৌঁছানোর পর দালাল তাদের কাছ থেকে স্বর্ণালংকার ও টাকা নেওয়ার পর সন্দেহ হয়। এরপর ভুল বুঝতে পেরে নিজেরাই ঢাকায় ফিরে আসে।

মূলত পরিবারের শাসন ও উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষা থেকেই তিন ছাত্রী এ কাজ করেছে বলে দাবি র‌্যাবের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও এ কাজে তাদের প্রভাবিত করেছে।

বুধবার (৬ অক্টোবর) বিকালে মিরপুরের টোলারবাগে র‌্যাব-৪ অধিনায়ক মোজাম্মেল হক তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে দিলখুশ জান্নাত নিশা, কানিজ ফাতেমা ও নেহা আক্তার বাসা থেকে বের হয়। কলেজ ড্রেস পরে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিল তারা। পরে নিখোঁজদের পরিবার জানায়, ছাত্রীরা বের হওয়ার সময় নগদ টাকা, স্বর্ণের গহনা ও নিজেদের সার্টিফিকেটও নিয়ে যায়। এই ঘটনায় প্রথমে পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। এরপর মামলা হয়। পরে তাদের বন্ধু মো. তরিকুল্লাহ (১৯), মো. রকিবুল্লাহ (২০), জিনিয়া ওরফে টিকটক জিনিয়া রোজ (১৮) ও শরফুদ্দিন আহম্মেদ অয়নকে (১৮) গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা এখন কারাগারে।

তিন ছাত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে মোজাম্মেল হক জানান, ওই কিশোরীদের পরিবারের নিয়ম-কানুন ভালো লাগতো না। সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনও তাদের কাছে ‘অত্যাচার’ মনে হতো। করোনায় দীর্ঘদিন বাসায় আবদ্ধ থাকার সময় তারা পশ্চিমা সংস্কৃতি, বিশেষ করে জাপানি সংস্কৃতির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। জাপানি সিনেমা-সিরিয়াল, সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম দেখে দেখে ওই দেশের ভাষাও কিছুটা শিখে ফেলে। পালিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে তারা জানায়, জাপানি সংস্কৃতিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকার, স্বাধীনতা, দত্তক হওয়ার সুযোগ এবং অন্যান্য ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিনিষেধ নেই।

দু’মাস আগে তিন বান্ধবী তাদের বন্ধু তরিকুলের সঙ্গে রাজধানীর দিয়াবাড়ী ঘুরতে গিয়ে হাফসা চৌধুরী নামের ২৪/২৫ বছরের এক নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়। আলোচনার একপর্যায়ে তারা জাপানে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে হাফসা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের জন্য ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়।

তিন বান্ধবী হাফসার সঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী কক্সবাজার রুট দিয়ে নৌপথে জাপান যাওয়ার উদ্দেশ্যে ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে রিকশায় প্রথমে গাবতলী যায়। হাফসার পরামর্শে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেন তাদের অবস্থান বুঝতে না পারে সে জন্য তারা নিজেদের ইমেইল, ফেসবুক আইডি ও ব্যবহৃত মোবাইল গাবতলীতে নষ্ট করে রেখে যায়।

পরে নৌকাযোগে নদী পার হয়ে আমিনবাজার এলাকায় পৌঁছলে হাফসার দুই জন লোক একটি কালো রঙের গাড়িতে তাদের অজ্ঞাত একটি জায়গায় নামিয়ে দেয়। সিএনজি অটোরিকশায় করে কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে রেলে চট্টগ্রামে যাওয়ার পরামর্শ দেয় ওরা।

তিন বান্ধবী তাদের কথামতো চট্টগ্রামগামী কোনও রেল না পেয়ে প্রথমে বাসে কুমিল্লার ময়নামতি যায়। নিজেদের পরিচয় গোপন করতে নিজেদের চুল কেটে পশ্চিমা বেশ ধারণ করে। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পৌঁছে তারা কেডস, পোশাক ও একটি মোবাইল কেনে। সেখান থেকে তারা আবার বাসে করে চট্টগ্রাম সিনেমা প্লেস বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে আরও দুটি মোবাইল ফোন কিনে বাসে কক্সবাজার যায়। কক্সবাজার পৌঁছে ১ অক্টোবর হতে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত কলাতলিতে একটি হোটেলে ছিল তারা। হোটেলের ওয়াইফাই ব্যবহার করে হাফসার সঙ্গে যোগাযোগ করতো তারা।

২ অক্টোবর সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেলে হাফসার লোক পরিচয়ে আসিফ এবং শফিক নামের ৩০-৩২ বছরের দুই লোক তাদের কাছে থাকা স্বর্ণালংকার ও কিছু নগদ টাকা নিয়ে নেয়। ওই ঘটনায় তারা আতঙ্কিত হয়ে হোটেলে অবস্থান নেয় এবং আশপাশে র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে ৫ অক্টোবর রাত আনুমানিক ৯টার দিকে বাসে করে ঢাকায় ফেরে।

ওই বাসে ছদ্মবেশে র‌্যাব-৪ সদস্যরাও ছিল। ৬ অক্টোবর ভোররাত আনুমানিক সাড়ে ৪টার দিকে র‌্যাবের একটি দল তাদের উদ্ধার করে র‌্যাব-৪ কার্যালয়ে নিয়ে আসে। তবে হাফসা নামের ওই নারীকে গ্রেফতার করতে পারেনি র‌্যাব। তরুণীদের কাছ থেকে যে দুই ব্যক্তি স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়েছিল তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা করছে র‌্যাব ৪।

র‌্যাব দাবি করেছে, তিন বান্ধবী মিরপুরের স্থানীয় একটি কলেজে লেখাপড়া করতো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিনদেশি সংস্কৃতিতে আসক্ত হয়ে পড়ে ওরা। লেখাপড়ার প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এতে পরিবার থেকে চাপ দেওয়া হতো। যার ফলে ঘর ছাড়ে তারা।

তাদের আপাতত পল্লবী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। থানা পুলিশ পরিবারের জিম্মায় দিলে বৃহস্পতিবার তাদের আদালতে নেওয়া হবে। -বাংলা ট্রিবিউন