বাংলাট্রিবিউন: ষষ্ঠ দল হিসেবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়েছে খেলাফত মজলিস। শুক্রবার (১ অক্টোবর) বিকালে দলটির আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক জোট ত্যাগের ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালে প্রথমবার ভাঙনের মুখে পড়ে এই জোট। এরপর ১৬, ১৮, ১৯ ও ২০২১ সালে দুবার—সব মিলিয়ে ছয় দফা ভাঙন হয় বিএনপি জোটে। ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জোটে ভাঙন হলেও ছেড়ে যাওয়া দলগুলোর মূল অভিযোগ বিএনপির ওপর। দলগুলোর দাবি, ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করে রেখেছে বিএনপি। একইসঙ্গে ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর ২০ দলীয় জোটকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। এ ক্ষোভই শরিকদের জোট ত্যাগের বিষয়টি ত্বরান্বিত করেছে।

যদিও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত—চলমান ২০ দলীয় জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কোনও জোটকেই প্রাধান্য না দেওয়ার। বিশেষ করে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতকে একমঞ্চে রেখে যেকোনও কার্যক্রমেই অনীহা রয়েছে দলটির। একইসঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলমান ধারাবাহিক বৈঠকেও তৃণমূল নেতারা জামায়াত ছাড়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রের ভাষ্য, জোটগত রাজনীতির প্রয়োজন ফুরিয়ে না গেলেও এতে নতুনত্ব আনার পক্ষে বিএনপি। আর প্রাথমিক রেশ দেখা গেছে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সময়ও। ওই জোট গঠনের পর থেকে ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করে ফেলে বিএনপি। বর্তমানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকেও নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে তারা। আর এ কারণে জোট ত্যাগ করলেও বিএনপি নেতারা এ বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য থেকে বিরত রয়েছেন।

শুক্রবার বিকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যেকোনও রাজনৈতিক দলই তাদের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখে। এছাড়া, বিএনপির কোনও কোনও নেতা ‘সরাসরি সরকারের চাপ প্রয়োগের কারণেই জোট ত্যাগের ঘটনা ঘটছে’ বলে মনে করেন।

বিএনপি জোটজোটত্যাগি খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ন্যাপ ও জমিয়তের নেতারা

জোট ত্যাগ করেছে কারা, কেন?

১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তখনকার চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল কাকরাইলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন অডিটোরিয়ামে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দল যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়।

বিএনপি-জোটে প্রথম ভাঙন ঘটে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় জোট ত্যাগ করে শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি)। প্রয়াত নীলুর অভিযোগ ছিল—‘২০ দলের জোটে বিএনপি-জামায়াত সব সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতো।’ ওই সময় তার দলের একটি অংশ অবশ্য জোটে থেকে যায়।

২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারিতে বিএনপির সঙ্গে প্রায় দুই যুগের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ইসলামী ঐক্যজোট। তাদের অভিযোগ ছিল শরিকদের সঠিক মূল্যায়ন না করা।

২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর বিএনপি, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আত্মপ্রকাশের পর ১৬ অক্টোবর জেবেল রহমান গানির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও খন্দকার গোলাম মোর্তুজা নেতৃত্বাধীন এনডিপি বেরিয়ে যায়।

জানতে চাইলে শুক্রবার বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বেগম জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করা হয়েছে। এখন এই জোটের আবেদন চলে গেছে। তাই শরিকরা আর এই জোটে থাকতে চাইছেন না।’

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর জোট ত্যাগ করেন বিজেপি চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। কেন জোটের শরিকরা বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে শুক্রবার আন্দালিভ রহমান পার্থ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৮ সালে বেগম খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর থেকে ২০ দলীয় জোট স্থবির হয়ে পড়েছিল। এরপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার পর ২০ দলীয় জোটের শরিকদের মূল্যায়ন অনেকাংশে কমে গেছে। আমার মনে হয়, বিএনপি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের মধ্যে ব্যালেন্স করতে পারেনি।’

আন্দালিভ রহমান পার্থ আরও বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের সঙ্গে সংলাপে ঐক্যফ্রন্ট শরিকদের নিয়ে গেছে বিএনপি। সেই সংলাপেও ২০ দলীয় জোটের কোনও শরিককে নেয়নি। অথচ, ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল। তারা আন্দোলনেও শরিক ছিলেন।’

আন্দালিভ রহমান পার্থআন্দালিভ রহমান পার্থআন্দালিভ রহমান পার্থ

‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপি সংসদে গেছে—এই যাওয়া না যাওয়া নিয়েও শরিকদের সঙ্গে কোনও আলোচনা করেনি বিএনপি’, এমনটি উল্লেখ করে আন্দালিভ রহমান বলেন, ‘মোটকথা ২০ দলীয় জোটের কোনও কর্মকাণ্ড নেই। আমি তো ২ বছর আগে যেসব কারণ বলেছিলাম, এখন সেগুলোই সামনে আসছে। এতে প্রমাণিত হয়েছে, আগে যা বলেছি তা-ই হয়েছে। সব মিলিয়ে দুই জোটের মধ্যে বিএনপি সমন্বয় করতে পারেনি। যাতে আস্তে আস্তে আরও অনেকেই বেরুতে পারে।’

চলতি বছরের ১৪ জুলাই জোট ত্যাগ করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। তাদের অভিযোগ ছিল—জোটের শরিক দলের যথাযথ মূল্যায়ন না করা, শরিকদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই উপনির্বাচন এককভাবে বর্জন করা ইত্যাদি। অনেকটা সমধর্মী পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন জোটের শরিক কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। গত ১০ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বিএনপি জোটকে সক্রিয় করার আহ্বান জানান।

সর্বশেষ শুক্রবার (১ অক্টোবর) বিএনপি জোট ত্যাগ করে খেলাফত মজলিস। দলটির আমির মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাকের অভিযোগ, ২০১৯ সাল থেকে ২০ দলীয় জোটের দৃশ্যমান রাজনৈতিক তৎপরতা ও কর্মসূচি নেই। ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে কার্যত রাজনৈতিকভাবে অকার্যকরও করা হয়।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মনে করছেন, বিএনপি জামায়াত নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না বলেই জোট ভেঙে যাচ্ছে। যে কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে জোটরক্ষার জন্য কোনও তৎপরতা বা উদ্যোগ নেই।

২০ দলীয় জোটের শরিকরা কেন ছেড়ে যাচ্ছে—এ বিষয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ, জোটের কার্যক্রম নেই বলেই শরিকরা ছেড়ে যেতে উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ হলে এমন অবস্থা হতো  না। কর্মসূচি ডেকে দেখতে চাইতো শরিকদের কেমন অংশগ্রহণ থাকে। কিন্তু বিএনপি কোনও কার্যক্রম করেনি। তারা জামায়াতকে ডেকে বের করে দিতে পারছে না বলেই জোটকে এভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখছে।’