তাওহীদুল ইসলাম নূরী:
দেখতে দেখতে আবার আমাদের মাঝে চলে এলো ‘ঈদুল আযহা’ প্রচলিত অর্থে কোরবানীর ঈদ। রাসুল(স.) হাদিসের একটি বর্ণনায় বলেন “সামর্থ্য থাকা সত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে”। রাসুল (স.) এর উল্লেখিত হাদিসটি থেকে কোরবানী কতটা গুরুত্ববহন করে তা অনুমেয়।

কোরবানী নতুন কোন উৎসব কিংবা বস্তর নাম নয়। পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আ.) এর পরিবারের উপরও কোরবানীর বিধান ছিল। কিন্ত, তা এখনকার মত ছিল না। প্রতি বছর বর্তমানে আমরা জিলহজ মাসের ১০,১১,ও ১২ তারিখে যে কোরবানী করে থাকি সেখানে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর মর্মস্পর্শী স্মৃতি জড়িত। জিলহজ মাসের ৮ তারিখ রাতে তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁকে বলা হচ্ছে “হে ইব্রাহিম! তুমি কোরবানি কর”। অতঃপর তিনি উঠলেন এবং একশত উট কোরবানী দিলেন। পরবর্তী রাতে আবার একই স্বপ্ন দেখলেন এবং একইরুপ একশত উট কোরবানী দিলেন। সর্বশেষ ১০ তারিখের রাতে দেখলেন যে “হে ইব্রাহীম! তুমি তোমার সবচেয়ে প্রিয় বস্তুুটি কোরবানি কর”।

স্বপ্ন যখন দেখেন তখন হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর বয়স নব্বইয়ের উপরে। একটা মাত্র সন্তান। নব্বোয়র্ধ পিতার নিকট একমাত্র সন্তান ব্যথিত আর কি বা সবচেয়ে প্রিয় হতে পারে??? কিন্ত আল্লাহর হুকুম যে অলংঘনীয়! তাই, তিনি ঘুম থেকে উঠে তার সহধর্মিণী হাজেরাকে তাঁর স্বপ্নের কথা জানালেন এবং বললেন যে ‘আমাদের কলিজার টুকরাকে সাজিয়ে দাও’। হযরত হাজেরা তাই করলেন এবং ছেলেকে বললেন যে ‘যাও আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে উৎসর্গ কর’। হযরত ইব্রাহীম (আ.)ও প্রাণাধিক সন্তানকে কোরবানীর জন্য মিনা অভিমুখে রওনা হলেন। এদিকে পথে শয়তান তার স্বভাবসুলভ আচরণ শুরু করল। প্রথমে মেহমান সেজে বাড়িতে গিয়ে হাজেরাকে বধ করতে চাইলে তিনি (হাজেরা) বলেন যে আল্লাহর হুকুম পালন জরুরী। অন্যদিকে হযরত ইসমাঈলকে বধ করতে চাইলে তিনি বলেন যে “আহ,কত সৌভাগ্য আমার! আল্লাহ আমার জীবন তাঁর রাস্তায় কবুল করেছনে”। দুই দিক হতে নিরাশ হয়ে সর্বশেষ হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে ধোকা দিতে গেলে তিনি তাকবীর পড়ে শয়তানের দিকে কংকর ছুড়ে মারেন। আর সেটিই এখন হাজিদের জন্য পালনীয় হয়ে পড়েছে। এদিকে ইব্রাহীম (আ.) পুত্রকে তাঁর স্বপ্নের কথা জানালে পুত্র বলেন যে “আব্বা আপনার প্রতি যা আদিষ্ট হয়েছে আপনি তাই করুন।নিশ্চয় আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন”। কিন্ত,আব্বা আমাকে জবেহ করার আগে তিনটা কথা বলো রাখি
১.আমার হাত পা বেঁধে ফেলুন। কেননা জবেহ করার পর আমার হাত পা খোলা থাকলে আমি জবেহের যন্ত্রণার কারণে ছটফট করলে আপনার শরীরে আমার রক্ত লাগবে। আমি চাই না বেয়াদবের খাতায় আমার নাম উঠুক।
২.আমাকে উপুড় করে জবাই করবেন, যেন পরস্পরের মধ্যে ভালবাসার প্রকাশ না পায়।
৩.বাড়িতে গিয়ে আম্মাকে আমার সালাম দিবেন আর বলবেন আমার রক্তমাখা জামাটি যেন পুত্রের স্মৃতি হিসেবে রাখেন।

হযরত ইব্রাহীম (আ.) পুত্রের কথামত পুত্রের হাত-পা বেঁধে উপুড় করে তার উপর ধারালো ছুরি চালাতে আরম্ভ করলেন। কিন্ত, এত ধারাল হওয়া সত্বেও ছুরি একটা পশমও কাটতে পারল না। কেননা, ছুরির উপর হুকুম হল “খবরদার! ইসমাঈলের একটা পশমও কাটবে না”। তবে কে জানত সে হুকুমের কথা? আকাশ-বাতাস,বন-বনানী,অরণ্যে বসবাসরত ফেরেসতা,পাহাড়-পর্বত সবকিছুই সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিল। কে বলতে পারত আল্লাহ কেনই বা তাঁর বন্ধুর উপর এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটাচ্ছেন? আল্লাহ ইব্রাহীম (আ.) এর কোরবানী কবুল করলেন।ইসমাঈলব(আ.) জীবন্ত রয়ে গেল,তার পরিবর্তে একটা দুম্বা কোরবানী হল। কোরআনের ভাষায়
“যখন তাঁরা আত্নসমর্পন করলেন এবং পুত্রকে উপুড় করে শোয়ালেন, তখন আমি তাঁকে ডাকলাম আর বললাম হে ইব্রাহীম! আপনি স্বপ্নকে সত্যি পরিণত করে দেখিয়েছেন।আমি আমার বিশিষ্ট বান্দাদের এরুপ পরীক্ষার মাধ্যমে পুরস্কার প্রদান করে থাকি”।
প্রকৃতপক্ষে ইহা ছিল একটি অনেক বড় পরীক্ষা। এ ধারাতেই আজ আমাদের উপর কোরবানীর বিধান হয়েছে। ইসলাম এ জন্যই স্মৃতিসৌধ কিংবা প্রতিমূর্তি নির্মাণে নিষেধ করেছে, যাতে প্রকৃত স্মৃতি অনন্তকাল পর্যন্ত চিরায়ত থাকে। এই যে কোরবানী, এর উদ্দেশ্য হতে হবে একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা।

বাপ,দাদা,পূর্বসূরিরা কোরবানী করে এসেছে, এখন ব্যবসায় বাণিজ্য,প্রতিবেশীর বিদ্রুপ থেকে বাঁচার জন্য কোরবানী করলে কোরবানী কবুল হবে না।কারণ,আল্লাহতায়ালা বলেছেন
“আল্লাহর নিকট জন্তর গোশত,রক্ত কিছুই পৌঁছে না,পৌঁছে শুধু তাকওয়া”।
অন্যত্র গিয়ে বলেছেন
“বল…আমার নামাজ,আমার ইবাদত,আমার জীবন,আমার মরণ সবকিছুই জগতসমুহের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে”। তাই, বুঝতে হবে কোরবানীর শিক্ষা গোশত খাওয়া নয় বরং এর শিক্ষা হতে হবে আল্লাহভীরু,তাকওয়াপূর্ণ এবং দয়াদ্রপূর্ণ।সর্বোৎকৃষ্ট জন্ত জবাই করার মাধ্যমে যেভাবে আল্লাহর প্রতি অনুগত্য প্রকাশ করবে,তেমনি ইসলামের প্রয়োজনে নিজের জীবন উৎসর্গ করার মনোবৃত্তি জাগ্রত করতে হবে। অন্যথায়, কোরবানী শুধুমাত্র ধর্মীয় উৎসব এবং খাওয়া-দাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

তাই,আমাদের সবকিছুর উর্ধ্বে ইসলামের ঝান্ডাকে সমুন্নত রাখতে হবে। ঈদুল আযহা আমাদের জীবনে সৃষ্টি করুক তাকওয়াপূর্ণ,আল্লাহভীরু মানসিকতা এবং সবার জীবনে বয়ে আনুক পরস্পরের মাঝে অনাবিল শান্তি,সুখ,সমৃদ্ধি ও আনন্দের ফাল্গুধারা। আমাদের প্রত্যেকের কোরবানী করুল করে আল্লাহ আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উপযোগি মানুষ হিসেবে কবুল করুন………………’আমিন’।

মাআসসালাম
তাওহীদুল ইসলাম নূরী
প্রাবন্ধিক, সমাজ ও মানবাধিকার কর্মী।
ছাত্র, আইন বিভাগ
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
বাড়ি-শাহারবিল বাজার,চকরিয়া,কক্সবাজার