– সিরাজুল কাদের

গতকাল গেল ইংরেজী নববর্ষ ২০২১ এর প্রথম দিন! সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল জগত যেন বৈচিত্রময় শুভ কামনার প্রচ্ছদে এবং হৃদয়গ্রাহী শব্দচয়নে ছেয়ে গেছে বিরামহীনভাবে; দেখতে দেখতে এবং পড়তে পড়তে চোখ যেন ভিতর থেকে অদৃশ্য ডাক দিচ্ছে “বাবা আমাকে একটু বিশ্রাম দেয়, আর পারছিনা…! “ তারপর ও চোখের উপর নিয়মিত অত্যাচারের মাত্রা কোন রকম কমছেনা; একদিকে তো ছুটির দিন আর অন্যদিকে নতুন আংগিকে নতুন এবং লোভাতুর ভাষাশৈলীতে শব্দের জীয়ন কাঠিতে মন্ত্রমুগ্ধ যাদুর পরশ সাব কনশাসলি দশ পনের মিনিট অন্তর অন্তর মোবাইল খুলে সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে বুঁদ হতে আবেগময় মন ক্রমাগত কুঠারাঘাত করেই যাচ্ছে…! এইভাবে চলতে থাকলে আগামী এক দশকের ভিতর চায়না, জাপান সহ বিভিন্ন উন্নত দেশের ন্যয় পাওয়ার সংযুক্ত চশমা এবং কন্টাক্টলেন্সের বাজার সবদেশকে ঠেক্কা দিয়ে আমাদের দেশের প্রতিশ্রুতিশীল ব্যবসার ক্ষেত্র হিসেবে পরিণত হবে। আর এই সুযোগে যারা দীর্ঘমেয়াদী নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র খুঁজছে তারা এই ট্রেডটা নির্দ্ধিধায় পছন্দের তালিকায় রাখতে পারেন! যাক শুরু করছিলাম একটি টপিক্স নিয়ে কিন্তু লেখার সাব প্লটের কারনে একটু অন্য জায়গায় ঢুঁ মেরে আসা। আসলে বর্ষ বরণের বিভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন রেওয়াজ থাকলেও ইংরেজী নববর্ষকে উদযাপন করার রীতিটা আগের তুলনায় অনেক বেশী বর্ণিল সাজ এবং ইভেন্টে উদযাপিত হচ্ছে ঢের বেশী..! প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্তমান সময়ে উদযাপিত নববর্ষের রীতিতে অনেক তর্ক- বিতর্ক রয়েছে যেটা শুধু আমাদের দেশে নয় বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবতাবাদি সংগঠনের বিরুদ্ধ মতামত রয়েছে; এই যেমন থার্টি পাস্ট নাইট উপলক্ষ্যে আতশবাজিতে যে পরিমাণ অর্থ অদৃশ্য উদ্দেশ্যে উড়িয়ে দেয়া হয় সে অর্থ দিয়ে পৃথিবীর হত দরিদ্রের বিশাল বনী আদমদেরকে অন্তত অর্ধাহার, অনাহারে এবং অপুষ্টিতে ভোগা থেকে রক্ষা করে সুন্দর পৃথিবী বিনির্মাণের মিছিলের সারথি হিসেবে তৈরী করা যেত! অন্যদিকে সিরিয়া, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, কাশ্মীরে খাদ্য, বাসস্থান এবং চিকিৎসা সংকটে থাকা নারী, পুরুষ এবং শিশুদের দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি ইউ টিউব সহ বিভিন্ন মিডিয়াতে দেখলে কান্না ধরে রাখা যায়না কি দুর্বিষহ জীবনের টর্ণেডোতে তাদের ভাগ্যাকাশে বিদঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন কাল ছায়ায় জীবন নামের ছাদ লন্ডভন্ড হচ্ছে প্রতিনিয়ত তারাওতো আমাদের ভাই বোন তাদের এই অবস্থায় রেখে অপচয়ী যে কোন উদযাপন এবং উপলক্ষের পরিণতি অদৃশ্যভাবে করোনার মত বড় মহামারী এবং দুর্যোগ মানবিক বিপর্যয় এবং সংকটের এলার্ম বাজিয়ে দেয় সারা বিশ্বে এক যোগে!
এখানে শুধু আতশবাজির কথা উল্লেখ করলাম এছাড়াও বর্ষবরণকে পুঁজি করে বিনোদনের নামে পুঁজিবাদিদের প্রসব থেকে জন্ম নেয়া অনৈতিক বণিক শ্রেণীর বিভিন্ন উচ্চ বিলাসী এবং উচ্চ বাজেটের অপ্রয়োজনীয় ইভেন্ট কত মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার গচ্ছা যায় তা অননুমেয়! অথচ চাইলেই এই অপচয়ের কিছু অর্থের মাধ্যমে বিভিন্ন মরণঘাতী রোগের স্থায়ী চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা যেত যার মাধ্যমে সৃষ্টির সেরা জীবেরা টেকসই বিশ্ব নির্মাণের গতিকে ত্বরাণ্বিত করতে পারত। এছাড়াও সামনে ধেয়ে আসা ক্লাইমেট চেইন্জ সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ চ্যালেন্জকে মোকাবিলা করার জন্য গবেষণামূলক টেকসই কর্মসূচী বা প্রজেক্ট চালু করা যেত। হায়রে! ইউনিট বেসিস অনৈতিক বণিক শ্রেণীর কাছে আজ এই সুন্দর বসুন্ধরা বড়ই ধরাশায়ী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভিন্ন নাম, রং এবং আকারে এদের বিস্তৃতি এদের চৌহদ্দির বাইরে পৃথিবীর তাবৎ শক্তি যেন বড় অসহায়..! এরাই বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতির ধারক বাহক! বছরের এই প্রথম দিবসে এটাও আমি আশারাখি বিশ্বব্যাপী এই অনৈতিক বণিক শ্রেণীর শুভ বুদ্ধির উদয় হউক মানবতার বাতাবরণে যার পরিক্রমায় কল্যাণকামী বিশ্বের পতাকা উড্ডীন হয়।
আমি আজ জাপানে প্রায় এক দশক ধরে আছি এখানেও বর্ষবরণ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন আয়োজন এবং উদযাপন পর্যবেক্ষণ করেছি! প্রায় এক দেড়মাস আগে থেকে শুরু হয়ে সবক্ষেত্রে হরেক রকম আঁতশবাজি, লাইটেনিং, ইলুমিনেশন এবং ইভেন্টে যে পরিমাণ অর্থ অপচয় প্রত্যক্ষ করেছি তা অকল্পনীয়! সে অনেক গল্প এবং ভরপুর অর্থ অপচয়ের ফিরিস্তি!

যাক, আজ নববর্ষ উপলক্ষ্যে একটি ব্যতিক্রম চিন্তা আমাতে ভর করেছে যা একটি বাস্তবধর্মী ছোট গল্পে ব্যক্ত করার চেষ্টা করছি- আমি এখানে যে কম্পানীতে চাকরী করি সেখানে আমার একজন কলীগ আছে নাম তার ছাই চাঁন চাইনীজ অরিজিন অসম্ভব ধরনের ভদ্র, আই কিউ শার্প ও মিষ্টভাষী এক কথায় ভদ্রতার মোড়কে আবৃত এক সজ্জন এবং পরিচ্ছন্ন মনের অধিকারী নিখাদ ব্যক্তিত্ব। এখানে আমি অনেক চাইনীজ দেখেছি কিন্তু তারমত বহুগুনে গুনান্বিত দ্বিতীয় জন আর দেখিনি। সে হাই স্কুল শেষ করে আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর আগে জাপানে এসে প্রায় দুই বছর জাপানী ভাষা এবং কালচার এর উপর পড়াশোনা করে। পরবর্তীতে সে বিভিন্ন কম্পানীতে সুনামের সাথে জব করে। বর্তমানে তার বয়স প্রায় বিয়াল্লিশ বছর। তার স্বভাব চরিত্র এভারেজ চাইনিজদের মত না হওয়ার কারনে সে চাইনিজ কমিউনিটির সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেনা এবং পারতপক্ষে একলা থাকার চেষ্টা করে। সে আবার জাপানিজ মাংগা বা এনিমেশন ও কমিক্সের পোকা সময় পেলেই এখানে বুঁদ হয়ে একাকীত্বকে উপভোগ করে। আজ প্রায় পাঁচ বছর ধরে তার সাথে আমার সখ্যতা জানিনা আমার কোন গুনে সে আকৃষ্ট একদম আমার অন্ধ ভক্ত অন্য কলীগরা যাই বলুকননা কেন তার কথা হচ্ছে যেখানে সিরাজ চাঁনের (উল্লেখ্য জাপানীরা সকলের নামের শেষে চাঁন যোগ করে ডাকে সে হিসেবে আমাকে সিরাজ চাঁন হিসেবে সম্বোদন করে) মতামত আসবেনা সেখানে সে তার মতামত ব্যক্ত করবেনা। আর আমার সাথে দেখা হতেই তার কাজের ভিতর এবং বাইরে কি হল সব কিছুর আপডেট মূহুর্তের মধ্যে দিয়ে দিবে আর কোন হাসির কথা থাকলে এমনভাবে বলে যেন দু’জনের চোখ ভিজে একাকার; সে একদিকে চাইনিজ হওয়ার কারনে তার সিক্স সেন্স কাজ করে অন্যদিকে কমিক্সের পোকা সব মিলিয়ে কোন জঠিল বিষয় রম্যরস মিশ্রিত সরল এবং সহজ বর্ণনাতে সিদ্ধহস্ত! তবে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরা এই যুবকের তিন বছর আগে পাকস্থলীর এক জঠিল অপারেশন হয় প্রায় দেড় দু’ মাস রেস্টে ছিল। পরে জবে জয়েন করে কিন্তু অপারেশনের কারনে তার সেই পূর্বের উদ্দাম এবং কর্মতৎপরতা আস্তে লোপ পেতে থাকে। এদিকে বিয়ে-শাদীও করেনাই যার কারনে এক ঘরেই অসুস্থতার মধ্যে সুস্থতার ভান করে জব কন্টিনিউ করছে! খাবার-দাবারের রুটিন ঠিক না থাকার কারনে ইদানীং হাই ব্লাড প্রেসারের রুগী হয়ে গেছে আবার হাল্কা ডায়বেটিকস সিম্পটম ও দেখা দিয়েছে ফলশ্রুতিতে তার শারিরীক অবস্থা দিনের পর দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে! এখানে যখন আমার মেয়ে শাইনা সিরাজ জন্ম গ্রহন করে হাসপাতাল থেকে রিলিজ হই সে দিন এ ছাই চাঁনের আনন্দের সীমা নেই আমাকে বিভিন্ন অভিনন্দনে অভিনন্দিত করছে এবং বলছে তুমি অনেক লাকি ইত্যকার স্তুতি বাক্য! পরিশেষে আমার হাতে একটি গিফটের এনভেলাপ আমি নিতে না চাইলেও জোর করে ধরিয়ে দেয়; খুলে দেখি মোটামুটি এক হ্যান্ডসাম ক্যাশ আমার মেয়ের জন্য উপহার হিসেবে প্রদান করেছে। কম্পানী ছাড়া ইন্ডিভিজিওয়াল গিফট হিসেবে ছাই চাঁনই একমাত্র ব্যক্তি যে তার মহাত্মার পরিচয় দিয়েছিলেন যার সূত্র ধরে আবার আমার ঘরের মিসেস নুসরাত নিগার ছাই চাঁন সম্বন্ধে জানে! বাসায় কোন ভাল খাবার রান্না হলেই আমার মিসেস ছাই চাঁনের জন্য খাবারের বক্সগুলো রেডি করে বলে যে এগুলো ছাই চাঁনের জন্য দিয়ে আসেন। তা হয়ত মাসে দু’মাসে দু’একবার হত। প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে মরার উপর খাড়ার ঘাঁ এক এক্সিডেন্টে ছাই চাঁনের এক কব্জির হাঁড়ে ফ্রাক্চার হয় যার কারনে এখন অনেক দু:সহ সময় কাটাচ্ছে ফ্রাক্চার হওয়া হাতটি ব্যান্ডেজ দিয়ে কাঁধে ঝুলানো আছে প্রপারলি মুভ করতে পারেনা তার উপর একটু এদিক-ওদিক হলেই প্রচন্ড ব্যথা; তার দু:সহ যন্ত্রনাতে আমি এবং আমার মিসেস রীতিমত ব্যথিত হয় এবং হচ্ছি! তাই এই ইংরেজী নববর্ষ ২০২১ শুরু হওয়ার প্রাক্কালে আমার মিসেস আমাকে বলে যে এই দেশতো এমনিতে সবদিক দিয়ে সমৃদ্ধ যা কারনে মানবিক দিয়ে সহযোগিতার তেমন ক্ষেত্র নাই তাই অন্তত আমরা নববর্ষের প্রথম দিনে ছাই চাঁনের প্রতি হলেও মানবিক সহযোগিতার হাত বাড়ায়! এমনিতে ছাই চাঁন আমাদের সেইম টেস্টের খাবার খুব বেশী পছন্দ করে, যে কথার সে কাজ; ভালভাবে বিভিন্ন মজাদার খাবার রান্না করে আমার মিসেস আমাকে বক্স ভরে দিল এবং সেগুলো নিয়ে যখন তার ঘরে পৌঁছলাম এবং বললাম আমাদের পক্ষ থেকে নববর্ষ উপলক্ষ্যে তোমার জন্য এই গিফট! তখন ছাই চাঁনের চেহারাটা মনে হচ্ছিল কৃতজ্ঞতার নীলাভরনে ছল ছল করা অশ্রু টলমলে সিক্ত হৃদয়ের প্রকাশ্য অনুভূতি যা বলে শেষ করা যাবেনা! সে বলল, “এখানে আমি একা থাকি কোন আত্মীয় স্বজন ও নাই আমার আগে থেকে বিভিন্ন অসুস্থতা আছে তার উপর আমার হাতের এই অবস্থার কারনে ঠিকভাবে ভাবে রান্না করতে পারিনা যার কারনে দুপুরের খাবার রাতে এবং রাতের খাবার দিনে মাঝেমধ্যে পুরো দিনই খাওয়া হয়না; এই পরিস্থিতি তোমাদের এই সৌজন্যতায় আমি যারপরনাই মুগ্ধ, অভিভূত এবং কৃতজ্ঞ! পরে অশ্রু সজল নয়নে বলে “ হনতুনি আরিগাতু গোজাইমাচ” অন্তরের অন্তস্থল থেকে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ!” উল্লেখ্য ছাই চাঁনকে আমি খাবার গিফট করেছি এটা আমার আত্ম প্রচারের জন্য উল্লেখ করছি সেট অন্য কোন নেতিবাচক দিক দিয়ে চিন্তা করবেন না বরং নিজ অবস্থান থেকে একজন কলীগ সর্বোপরি একজন অসুস্থ মানুষের প্রতি আমাদের মানবিক প্রচেষ্টা মাত্র! তাই সম্মানীত পাঠকদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরুধ জানাচ্ছি নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহটাকে একটু ভিন্ন আংগিকে উদযাপন করার নিমিত্তে আমরা যদি খুঁজ নেয় দেখব- ছাই চাঁন দের বাস্তবধর্মী গল্পের জীবন্ত চরিত্র আমাদের চারপাশে অনেক আছে এদের খুঁজ নিয়ে নিজেদের সাধ্যের মধ্যে তাদের প্রতি যদি আমাদের মানবিক সহযোগিতার হাত বাডিয়ে দিই আমার মতে নববর্ষের প্রারম্ভে এর চেয়ে বড় উদযাপন আর কিছুই হতে পারেনা! আর বছরের প্রথম সপ্তাহের এই মানবিক কর্মকান্ড আপনাকে আমাকে এক ঐশ্বরিক প্রশান্তিতো দিবেই অন্যদিকে ইহকালীন এবং পরকালীন নাজাতের জরিয়া হিসেবে কাজ করবে! সেই সাথে দেখা যাবে পুরো বছরই এক নতুন আবহ উদ্দীপনাতে যাচ্ছে!
এমনিতে তো বিশ্ব লয়ে কালের আবর্তনে ঘূর্ণিপাকে নতুন বছর উদযাপনের অনেক উচ্চ বিলাসী চোখ ধাঁধানো সংস্কৃতির সংযুক্তি প্রতি বছর আমরা দেখতে পাচ্ছি , এবার না হয় আমরা সবাই মিলে একটু ব্যতিক্রম হয়ে বর্ষ বরণ সংস্কৃতিতে নতুন এক মানবিক ধারা এবং সংস্কৃতি সৃষ্টি করি যার হাত ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজের সুবিধাবণ্চিত হত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রজন্মদের জীবনে আলোর শিখা প্রজ্জ্বলিত হয়ে সাম্যতা এবং ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে বৈষম্যহীন নতুন সমাজ নির্মিত হয় এই হোক নববর্ষের অংগীকার! সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা! শুভ ইংরেজী নববর্ষ ২০২১!