প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু :
বছর ঘুরে আবারো ফিরে এল শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তথা বুদ্ধ পূর্ণিমা। ২৫৬১ বুদ্ধবর্ষকে বিদায় এবং ২৫৬২ নব বুদ্ধবর্ষকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বিশ্ববৌদ্ধরা। বাংলাদেশের বৌদ্ধরাও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন করছেন। মূলত, রাজকুমার সিদ্ধার্থের জন্ম, বুদ্ধত্ব লাভ এবং বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ প্রাপ্তি এই তিনটি অনন্য ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমা দিনে ঘটেছিল বলেই ত্রিস্মৃতি বিজড়িত বৈশাখী পূর্ণিমার অপর নাম হল বুদ্ধ পূর্ণিমা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বুদ্ধ পূর্ণিমা বৌদ্ধদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং পবিত্র দিন।

বুদ্ধ পূর্ণিমা কালে বৌদ্ধদের ধর্মীয় জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। তবে যাঁর জন্মের সাথে সমগ্র মানবজাতি এবং জগতের কল্যাণ জড়িত ছিল, যাঁর বুদ্ধত্বপ্রাপ্তির সাথে মানুষের দুঃখমুক্তির পথের সন্ধান নিহিত ছিল এবং যাঁর অন্তর্ধানে মানবজাতি এবং জগতের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে সেই মহামতি তথাগত গৌতম বুদ্ধের জীবন এবং বাণী থেকে আমরা কি শিক্ষা গ্রহণ করছি কিংবা আদৌ কোন শিক্ষা গ্রহণ করছি কিনা তার পর্যালোচনাও আমাদের করতে হবে। বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন বলতে দিনটি উপলক্ষে বুদ্ধপূজা দান, সংঘদান, মোমবাতি এবং আগর বাতি প্রজ্জলন, নতুন নতুন পোষাক পরিধান কিংবা কোথাও একটি শোভাযাত্রা বের করা এসবের মধ্যে বুদ্ধ পূর্ণিমা উদযাপন আটকে থাকে। এর বাইরে আরো কিছু কর্মসূচি রাখা যায়। যেমন- স্বেচ্ছায় রক্তদান, হাসপাতালে গরিব ও দুঃস্থ রোগীদের মাঝে খাবার বিতরণ, অসহায় ও দরিদ্রদের মাঝে বস্ত্র বিতরণসহ জনকল্যাণকর ইত্যাদি কর্মসূচি রাখা যায়। অবশ্য কোন কোন সস্থানে এসব কর্মসূচিও পালন করা হয়। তবে তা খুব সীমিত।

পূজা এবং দান-দক্ষিণা এসবেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর পাশাপাশি বুদ্ধের আবির্ভাব ও জগৎকল্যাণ, বুদ্ধের জীবপ্রেমের শিক্ষা, অহিংসা ও সাম্যবাদ এবং বুুদ্ধের ধর্মাভিযানে যে মানবতাবাদ এবং গণতন্ত্রের সার্বজনীন শিক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে এসব বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনার গুরুত্বও অনেক বেশি। আমরা বৌদ্ধরা বুদ্ধের পথে আছি কিনা, বুদ্ধ নির্দেশিত এবং মনুষ্য জীবনের অলংকার সেই পঞ্চনীতি পালন করছি কিনা,আমাদের প্রজন্ম বুদ্ধের অহিংস নীতি ও সাম্যবাদের শিক্ষায় বেড়ে ওঠছে কিনা এসব বিষয়ে আরো বেশি সচেতন হওয়া বৌদ্ধ মাত্রেই গুরুদায়িত্ব এবং কর্তব্য বলে মনে করি। আমাদের প্রজন্ম বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষা এবং বুদ্ধকে হ্নদয়ে ধারণ করতে পারছে কিনা এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার কোন বিকল্প নেই। একটি সুখী, যোগ্য, শান্তিপ্রিয়, মানবদরদী এবং নৈতিক ভিত সম্পন্ন বৌদ্ধ প্রজন্ম এবং সমাজ গঠনে নতুন প্রজন্মকে বুদ্ধের শিক্ষা এবং অহিংস নীতি মুখী করার বিকল্প নেই।

যিনি হ্নদয়ে বুদ্ধকে ধারণ করবেন তিনি কখনো জীব হত্যা, চুরি, মিথ্যা কামাচার (ব্যবিচার), মিথ্যাচার এবং মাদক সেবন করবেন না। আজকে বিশ্বময় যে অস্থিরতা এবং অশান্তির দাবানল জ্বলছে তা কেবল এই পঞ্চনীতির লঙ্ঘন জনিত কারণেই হচ্ছে। বুদ্ধের উদ্দেশে প্রতিদিন বিহারে বুদ্ধপূজা দান করতে হবে এমন কথা বুদ্ধ ত্রিপিটকের কোথাও বলেননি। কিন্তু একজন বৌদ্ধ হিসেবে পঞ্চনীতি অক্ষুন্নভাবে পালন করার প্রয়োজনীয়তা এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে বুদ্ধ বিস্তারিত বলেছেন। চতুরার্য সত্য এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা পথ অবলম্বনে জীবন ও জীবিকা নির্বাহের শিক্ষা বুদ্ধ দিয়েছেন।

বুদ্ধ বাহ্যিক আড়ম্বরতার চেয়ে মানসিক উৎকর্ষতা সাধনের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। বুদ্ধের শিক্ষা হল, মানুষ জন্মের সাথে কিছু বিকার বা রিপু নিয়ে জন্মায়। এগুলো হল, লোভ, দ্বেষ বা হিংসা, মোহ, কাম, ক্রোধ, এবং পরশ্রীকাতরতা স্বভাব ইত্যাদি রিপু। এসব রিপুর তাড়নায় মানুষ অন্যায় বা পাপকাজ করে। আবার এসব ইন্দ্রিীয়গ্রাহ্যহীন রিপুর উৎপত্তিস্থল হল মানুষের চিত্ত বা মন। রিপু দমন এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হলে চিত্ত বা মনকে সংযম এবং বুঝার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। কারণ মানুষের চালিকা শক্তি হল তার চিত্ত বা মন। চিত্তে যা উৎপন্ন হয় মানুষ কায়া বা দেহ দ্বারা তা সম্পাদন করে মাত্র। যার চিত্ত সংযত তার বাক্য ও কায় সংযত হয়। অস্থির, কলুষিত এবং বিপদগামী চিত্ত কেবল অকুশল তথা বিপদের কারণ হয়ে থাকে। বিষে ভরা মনে কখনো কুশল বা ভাল চিন্তাধারা প্রবাহিত হতে পারেনা। যিনি চিত্ত জয় করত পারেন, তিনিই আত্ম জয় করতে পারেন। বুদ্ধের মতে, ‘যুদ্ধে শত সহ¯্রজনকে জয় করার চেয়ে আত্ম জয়ই শ্রেষ্ঠ জয়’। স্বীয় চিত্তকে দমন করতে না পারলে আত্ম জয় সহজ কাজ নয়। এটাই বুদ্ধের শিক্ষা। মানুষ হতে হলে আত্মকেন্দ্রিকতার খোলস থেকে বেরিয়ে সবার মঙ্গল এবং হিতের কথা ভাবতে হবে। মানুষকে ভালবাসতে হবে হ্নদয় দিয়ে। মানুষকে বিচার করতে হবে কেবল মানুষ হিসেবে। সবার সুখে সুখী এবং সবার দুঃখে দুঃখী হতে হবে। কেবল ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক’ বলে মুখে আওড়ালে হবেনা। এটা কেবল কথার কথা নয়। এটা একজন সম্যক সম্বুদ্ধের অসীম ত্যাগ এবং সাধনালব্দ উপলব্দির অন্তরের ডাক। রোহিঙ্গা নিপীড়ন করে মিয়ানমারের নির্দয় শাসকগোষ্ঠী বুদ্ধের সেই অমৃত এবং অমিয় বাণীকে রক্তাক্ত করেছে। তাদের সহিংস ও জীবপ্রেমহীন এই নিষ্ঠুর পথ বুদ্ধের পথ নয়। তারা পথভ্রষ্ট, তারা হিংসায় ঊন্মুক্ত। তারা মূলত ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হউক’ এই বাণী উচ্চারণেরও যোগ্যতা হারিয়েছে। নোবেল বিজয়ী বৌদ্ধধর্মীয় গুরু দালাইলামার মতে, ‘মানবিক এই সংকটে বুদ্ধ বেঁচে থাকলে রোহিঙ্গাদের পক্ষই নিতেন’। আমরাও অত্যাচারীদের সাথে নেই। আমরা মানবতার পক্ষে। আসুন আমরা বুদ্ধের পথে চলি। তাহলে মানুষের ভেতরে থাকবেনা কোন অপরাধ প্রবণতা, পরিবার এবং সমাজে থাকবেনা কোন অন্যায়, অবিচার, হিংসা, হানাহানি এবং রক্তপাত। আমরা গর্ব করে বলতে পারবো আমরা অহিংসবাদী জীবপ্রেমী বুদ্ধের অনুসারী। এটাই হোক এবারের বুদ্ধ পূর্ণিমার দীপ্ত অঙ্গীকার।

জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে জানাই শুভ বুদ্ধ পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা।

লেখকঃ সভাপতি, কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদ।
সহকারী পরিচালক, রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার।