– সিরাজুল কাদের
আজ এক বিংশ শতাব্দীর এই ক্ষণে প্রবাস সমরে অবস্থান করে ঘড়ির কাঁটার ন্যায় টিক টিক আওয়াজে মাতৃসম জন্মভূমির অন্তহীন ভাবনার কপাট খুলতে না খুলতে সম্মূখদ্বারে শুধু শুনতে পাচ্ছি যেন অদ্ভুত কিম্ভূতকিমাকার দানবীয় প্রেতাত্মার অশনি সংকেতমূলক অদৃশ্য গর্জন, এই বুঝি জাতির ললাটে শনি তার পূর্ব লক্ষন,উপসর্গ সমেত ক্রমাগত পাঁয়চারীর জানান দিয়ে অশুভ শক্তির আগমনকে বেগবান করতে তৎপর। চৌদিকে কেমন জানি অব্যবস্থাপনার মিছিলগুলো উচ্চকন্ঠে ধ্বনি -প্রতিধ্বনিতে একাকার হয়ে অদৃশ্য চৌমূহনীতে ধেয়ে আসছে সংগোপনে মিলিত হওয়ার নিমিত্তে! ভীতসন্ত্রস্ত হচ্ছি রীতিমত কখন যেন মিছিলগুলোর চৌমূহনীতে মিলিত স্রোতের বিধ্বংসী রূপ পুরু দেশ এবং জাতিকে অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে।

হ্যাঁ! বলছিলাম মাতৃজঠরের হাল হকিকতের কথা, দুর্নীতি নামক এক বিশাল দৈত্যের পিঠে সওয়ার হয়ে আজ দেশীয় প্রায়ই সব সেক্টর যেন দুর্নীতি বান্ধব প্রতিষ্টানে রুপ নিয়েছে, দুর্নীতির রাহুঘ্রাস আজ সমাজে স্বল্পতে ধনী হওয়ার অসম প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে দিয়েছে, এ যেন বড় মেজবানের ন্যায় যে যেভাবে পার, উদরপূর্তি না হওয়া পর্যন্ত লূটেপুটে খা বাচা ধনেরা! সমাজের সৎ লোকগুলো আজ বড়ই অসহায়; না পারে সইতে না পারে কইতে,কাল যে লোকের নুন আনতে পান্তা ফুরাত সে যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের আলোতে সর্বক্ষেত্রে সম্মোহনী শক্তির অধিকারী হয়ে সবকিছু জয় করে নিয়েছে। গাড়ী, বাড়ি, নারী আরো কত কি! মাদক থেকে শুরু করে ব্যাংক তছরুপ সহ অনেক অগনিত ঘটনার ফিরিস্তি যা লিখে সম্মানিত পাঠকদের ধৈর্যের স্খলন ঘটাতে চাইনা, ফলস্বরুপ সমাজে সামাজিক এবং আর্থিক শ্রেণী বৈষম্য স্থান করে নিয়েছে পরিণামে সামাজিক শৃংখলার নৈতিক অধ:পতনের নিদের্শকসমেত ডেমোগ্রাফিক ফিগার দ্রুতগতিতে ক্রমান্বয়ে উর্ধ্বগামী হচ্ছে যা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ্যালার্মিং!! সময়োপযোগী পদক্ষেপ না নিলে জাতি হিসাবে রসাতলে যেতে বেশী সময়ের আদৌ প্রয়োজন হবে বলে মনে করিনা। সুতরাং যতই দ্রুত শুভ বুদ্ধির উদয় হবে ততই বেশী মংগল।
আজ রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার রোগে আক্রান্ত আরো একটি প্রতিশ্রুতিশীল এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীল খাত:রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের রেমিট্যান্স। কেমন জানি দেখার কেউ নেয়, অথচ এই রেমিট্যান্স প্রবাস থেকে বাংলাদেশে আসা সময় পর্যন্ত যে তীব্র কষ্টদায়ক প্রসব বেদনা ও তডফডানি যারা প্রবাসে তারা ভালই বুঝেন । একেকটি মুদ্রার পিট যেন একেকটি হৃদয় বিদারক উপাখ্যান। এই মুদ্রা অর্জন: ভাগ্যহত তরতাজা যুবকের স্বজন থেকে দুরে থাকার রাতব্যাপী বালিশ ভেজা ক্রন্দন রোল, এই বিদেশী মুদ্রা একে একে দু:খিনী মা ও জনম দুখী পিতার মৃত্যুর কাতর যণ্ত্রনায় পাশে থাকতে না পারার আজীবন বয়ে বেড়া দু:খের সাত কাহন, এই মুদ্রা প্রিয়তম স্ত্রীর স্বামীবিহীন সংসার জীবনের এক কঠিন ও দু:সহ আর্তনাদ, এই মুদ্রা স্বীয় পরিচয় ও স্বকীয়তা হারানো সামাজিক মূল স্রোতধারায় অস্তিত্বসংকটে ভোগা এক জনগোষ্ঠীর আজীবন হতাশার চোরাবালিতে হাবুডুবু খাওয়ার নিষ্ঠুর নিয়তি আরো কত কি! লিখে শেষ করা যাবেনা। সম্প্রতি খবরের কাগজে একটি নিউজ দেখলাম, যেখানে উদ্ধৃত আছে যে বাংলাদেশী প্রবাসীদের রক্ত, চোখের জল এবং ঘাম ঝরানো রেমিটেন্সের অর্ধেকের বেশী অর্থ বাংলাদেশে নিয়োজিত বৈধভাবে দু’লাখ এবং অবৈধভাবে এর চেয়ে তিনগুন বিদেশী শ্রমিক এবং কর্মচারীদের বেতন বাবদ পাচার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেন? আজ তথ্য প্রযুক্তি এবং উন্নত শিক্ষার চরম উৎকর্ষতার দিনে বিদেশী জনশক্তি দিয়ে কেন আমাদের বিভিন্ন শিল্প ব্যবস্থা পরিচালনা করতে হবে? কেন ব্যবস্থাপক, বিশেষজ্ঞ, কোয়ালিটি কন্ট্রোলার সহ অন্যান্য পদে বিদেশীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে? সবচেয়ে বেশী পীড়াদায়ক বিষয় হচ্ছে, বৈশ্বিক দৃষ্টিকোন থেকে পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে বর্তমানে তিনটি দেশ একটি অপরটির সাথে তুমূল প্রতিদন্ধিতায় অবতীর্ণ তৎমধ্যে চীন, বাংলাদেশ এবং ভারত। ভারত তো পারেনা যে ছলে -বলে কলে -কৌশলে বাংলাদেশকে ঘাড় ধরে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামিয়ে দেয়! হ্যাঁ, আমরা স্বীকার করি প্রতিবেশী দেশ হিসাবে আমাদের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক থাকা সমীচিন।কিন্তু বিজিনেস ম্যানেজমেন্ট এর আদলে নিজস্ব স্বকীয়তা, ফ্যাক্ক্টস-ফিগার ও কনফিডেনশিয়ালিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, সে দিকটি যখন আপনার প্রতিদন্ধীর কাছে উন্মোচিত হয়ে যায় সেটা চীন হউক বা ভারত হউক তখন সার্বিক দিক দিয়ে তা গুরুত্ব হারিয়ে ক্রমান্বয়ে লোকসানের গ্যাঁড়াকলে নিপতিত হয়, ফলশ্রুতিতে ক্রমবর্ধমান প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পগুলো অকালে তার সন্জিবনী শক্তি হারাতে বসে; যার বিরুপ প্রভাব পুরো জাতিতে ভর করে দরিদ্র ক্লিষ্টতায় ধাবিত করে।

আজ জাতি হিসেবে আমাদের নিয়তির বড়ই পরিহাস, যারা আমাদের প্রধান প্রতিদন্ধী তাদেরকে দিয়ে আমাদের শিল্পের বড় বড় পদগুলোর পসরা সাজিয়ে রেখেছি, আফসোস! এই সিম্পল নীতিনির্ধারনী বিষয়ে আমাদের সরকার বলি, ব্যবসায়ী বলি কেন পর্যাপ্ত মনিটরিং সম্বলিত সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে পারছিনা? কেন আমরা নির্লিপ্ত?কেন আমাদের এত বেশী দৈন্যতা? আমরা কি পাশের দেশ মালয়েশিয়ার উন্নতির খবর পড়িনি বা চোখে দেখিনি?
একজন ডক্টর মাহাথির মোহাম্মদ কিভাবে মালয়েশিয়াকে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছেন। তিনি জাপানে পড়াশুনা করেছেন। ক্যাপাসিটি বিল্ড করার জাপানিদের এই কৌশলটি শিখে গেলেন। আশির দশকে নব্বই দশকে স্ট্রাটিজিক্যালি দলে দলে মালয় গোস্টি কে বিদেশে পাঠালেন। পড়াশুনার জন্য। স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর জন্য। আমেরিকা, ইউরোপ আর জাপান। বিদেশ থেকে ফেরার সাথে সাথেই সেই বিদ্যা কাজে লাগানোর মত জায়গায় সেট করে দিলেন। প্রোডাক্টিভিটি বাড়ল, আয় বাড়ল। ম্যানেজার শ্রেণীর লোক তৈরি হল। বিদেশ থেকে যা আমদানি করলো তা হল শ্রমিক শ্রেণীর লোক। যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসার অবকাঠামো তৈরি হল। নিজের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ালেন।
এখন আর মালয় ছাত্রদের তেমন বিদেশে যেতে হচ্ছে না। বরং বাইরে থেকে মালয়েশিয়াতে বিদেশি ছাত্র আসা শুরু করেছে।
চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে না। মাহাতির মুহম্মদ নিজের চিকিৎসার জন্য বাইরে না গিয়ে নিজ দেশে হাসপাতাল বানানোর কিচ্ছা সবার জানা।
জাপানি কোম্পানি গুলোকে ইনভেস্ট করার উইন উইন সিচুয়েশন তৈরি করে দিলেন। জাপানিরা ইনভেস্ট করলেন। গাড়ি কোম্পানি, হোম ইলেক্ট্রনিক্স কোম্পানি। মাহাতির এর দল স্ট্রাটিজিটা এমনভাবে করলেন যাতে টেকনোলজিটা ট্রান্সফার হয়। স্কিল ডেভেলপমেন্ট হয়। ৫০ বছরে জাপান যা টেকনোলজি ডেভেলপ করেছে তা যেন ৫ বছরে ট্রান্সফার হয়।
তার ফলাফল দেখেন। ৮৫ এর দিকে মালয়েশিয়ান ব্র্যান্ড এর প্রোটন সাগা (মিতসুবিশি জয়েন্ট ভেঞ্চার) গাড়ি বাজারে এলো।
আর আমরা আমাদের মন্ত্রী, এমপি দের জন্য বিনা ট্যাক্সে কিভাবে গাড়ি আমদানি করতে পারি সেই পলিসি বানিয়ে দিলাম। অথচ আমাদের প্রগতি, র‌্যাংগস বা সদ্য ওঠা ওয়াল্টন দিয়ে গাড়ির ১০% জিনিস ও তৈরি করে শুরুটা করলে কেমন হতো? ইতিমধ্যে মেইড ইন বাংলাদেশ একটা ব্র্যান্ড বেরিয়ে আসতো। হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান হতো। টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট, স্কিল ডেভেলপমেন্ট হতো। সেই শুরুটা আজো সম্ভব।

ক্যামেরা থেকে শুরু করে হোম-ইলেক্ট্রনিক্স এর এমন কোন জাপানি প্রোডাক্ট নেই যাতে মেইড ইন মালয়েশিয়া লেখা নেই।
সুতরাং এখনি সময়, যথাযথ এবং সুনিপুণ এ্যাসেসম্যান্টের মাধ্যমে “ইন্টার সেক্টরাল হিউম্যান রিসোর্চ ডেভেলপম্ন্ট” প্রজেক্ট এর আওতায় যে যে পদগুলোতে বর্তমানে বিদেশী জনশক্তি রয়েছে সে পদগুলো ক্রমান্বয়ে দেশীয় মেধাবী জনশক্তি দিয়ে পরিচালনার নিমিত্তে দেশের বিভিন্ন পাবলিক ওপ্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকষ ও মেধাবী ছাত্র -ছাত্রীদেরকে বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে বাচাই করে সংশ্লিষ্ট সেক্টরের বিশ্বের উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা, জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বিভিন্ন সেক্টরে তাদের নিয়োগ প্রদান করলে ক্রমান্বয়ে দেশীয় মেধার ভিত্তিতে বিকশিত শিল্প সুদৃঢ় ও মজবুত বুনিয়াদে গঠিত হবে। যার সিঁড়ি বেয়ে একদিকে অর্ধেকের বেশী রেমিটেন্সের পাচার হওয়া অর্থ সেভ করা যাবে (উল্লেখ্য প্রতি বছর রেমিটেন্স থেকে প্রাপ্ত অর্থের পরিমান ১৫ বিলিয়ন ডলার) অন্যদিকে সে অর্থ দিয়ে নতুন নতুন শিল্প এবং কর্ম সংস্থানের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়ে জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পেয়ে আমার সোনার বাংলা আন্তর্জাতিক উন্নয়নের মহাসড়কে নিজেকে আরো সুদৃঢ় মজবুত রাখতে সক্ষম হবে।
পরিশেষে, জাপানের একটি বাস্তব এবং ছোট ঐতিহাসিক ঘটনার উল্লেখ করে সখার ইতি টানব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকার লক্ষ লক্ষ বোমার আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় জাপানের ৪৭ টি বিভাগীয় শহর, এবং জাপান হেরে যায় যা আমরা প্রায় সবাই অবগত । যুদ্ধ হেরে গিয়ে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো আমেরিকার প্রতিনিধি ম্যাক আর্থারের কাছে গেলেন। প্রতীকি আইটেম হিসেবে নিয়ে গেলেন এক বস্তা চাল। শ্রদ্ধাবনত মস্তকে হাঁটু গেড়ে মাথা পেতে দিয়ে বললেন- আমার মাথাটুকু কেটে নিন আর এই চাল টুকু গ্রহণ করুন। আমার প্রজাদের রক্ষা করুন। ওরা ভাত পছন্দ করে। ওদের যেন ভাতের অভাব না হয়।
হায়রে, আমার দেশের নীতি নির্ধারকেরা! আর বললামনা। দেখুন, কি পরিমান দেশ প্রেম থাকলে মানুষ নিজ মস্তকের বিনিময়ে প্রজাদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। আজ আমরাও শপথ নিই সম্রাট হিরোহিতোর ন্যায় দেশকে ভালবেসে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি ও কল্যাণে জোরালো ভূমিকা রাখার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।