দেশে আইনআদালতে অস্তিরতা এবং কানাডায় ঘৃণামূলক বক্তব্যের শিক্ষা

  • দে লো য়া র  জা হি দ

সবাই মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আগুন থামান : হাইকোর্ট এ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে উদ্বেগজনক একটি সংবাদ,-” ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারকের সঙ্গে কিছু আইনজীবীর অশালীন আচরণকে পৃথিবীর ইতিহাসের বিরল বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ। আদালত এ ঘটনাকে ‘আগুন’ অভিহিত করে বলেন, এ আগুন থামান, নতুবা সবাইকে জ্বলতে হবে। বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ গতকাল মঙ্গলবার এসব কথা বলেন। আদালত আরো বলেন, এমন ঘটনা চলতে থাকলে আইন-আদালত বলে কিছু থাকবে না। আইনজীবী নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট আরো বলেন, কেউ কোনো কোর্ট বর্জন করবেন না। সবাই মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আগুন থামান।…ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) মোহাম্মদ ফারুককে গত ২ জানুয়ারি গালিগালাজ ও অশালীন আচরণ করেন কিছু আইনজীবী। ওই ঘটনার দৃশ্য ভিডিও করে ইন্টারনেটেও ছড়িয়ে দেয়া হয়। আদালত বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আমরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখবো। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। আমরা জুডিশিয়ারিকে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। (দৈনিকশিক্ষা ১৭ জানুয়ারী, ২০২৩)

বলতে দ্বিধা নেই পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তথা হাইকোর্টের এ পর্যবেক্ষণই যথেষ্ট। কথায় কথায় আমরা এখন উন্নত বিশ্বের দেশের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করি, এর ভাল মন্দ দুটি দিকই আছে। ভাল দিক হলো, যে এ ধরণের বিচার বিশ্লেষণের জন্য আমাদের অভিন্ন স্কেল ও বৈশিষ্ট্যসূচক বিষয়গুলোকে তুলনামূলক আলোচনার করতে পারি এবং আমরা আমাদের করণীয় স্থির করতে অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে ও তা গ্রহণ করতে পারি।

কানাডার বিল সি -৪১-এর মতে, ঘৃণামূলক অপরাধ হল এমন একটি যা, “জাতি, জাতীয়তা, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, বয়স, মানসিক বা শারীরিক অক্ষমতা বা শিকারের যৌন অভিমুখিতা ভিত্তিতে পক্ষপাত, কুসংস্কার বা ঘৃণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল”। এ বিলটি অন্যান্য বিচার ব্যবস্থা প্রবর্তিত আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। গোষ্ঠীর সদস্যদের মিথ্যাবাদী, প্রতারক, অপরাধী বা অন্য কোন শব্দ বলার অর্থ একটি তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা ঘৃণামূলক বক্তব্য এ উদাহরণ গুলিতে নেতিবাচক শব্দের প্রকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কিন্তু এ উদাহরণগুলি দেখায় যে আইনের অধীনে ঘৃণাত্মক বক্তৃতা হিসাবে বিবেচিত হতে হবে কতটা জঘন্য এবং চরম বক্তব্য। ঘৃণামূলক বক্তব্যের প্রভাব পর্যালোচনায় দেখা যায় ঘৃণাত্মক বক্তৃতা আক্রমণাত্মক বা আঘাতের চেয়ে বেশি; এটা যারা টার্গেট করা হয় তাদের জন্য এবং বৃহত্তরভাবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর। ঘৃণাত্মক বক্তৃতা সমাজের দৃষ্টিতে লক্ষ্যবস্তু করা ব্যক্তিদের বৈধতা এবং অমানবিক চিহ্নিত করার চেষ্টা করে। যারা ঘৃণাত্মক বক্তব্যের শিকার তারা প্রায়ই আঘাতপ্রাপ্ত, বর্জনীয়, অনিরাপদ, রাগান্বিত বা দুঃখ বোধ করতে পারে। এটা তাদের একটা অস্বস্তিকর করে তুলতে পারে যে তারা তাদের সম্প্রদায়ের স্বাগত বোধ করে না। এটি প্রসিকিউটরের সিদ্ধান্ত নেওয়ার উপর নির্ভর করে যে প্রমাণগুলি এতটা শক্তিশালী কিনা যে কাউকে ঘৃণার জনসাধারণের উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করা এবং বিচার করা যায় কিনা? অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী না নির্দোষ তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মামলার শুনানি নেয়া বিচারকের উপর নির্ভর করে।

টেকসই ন্যায়বিচার হল সমাজের মান রক্ষা করার জন্য বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ। বাংলাদেশে টেকসই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় অন্তর্নিহিত সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করে তা সমাধান করতে হবে এবং স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সেগুলো প্রচার করতে হবে. সামাজিক টেকসই তা কতটা উদ্বেগজনক তার উপরে উল্লেখিত সংবাদ শিরোনামে উঠে এসেছে। এখানে বিচ্ছিন্ন শক্তির বিরুদ্ধে টেকসই উপায়ে সমাজকে রক্ষা করা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার করার উপর জোর দিতে হবে কোর্ট এবং বারকে। আমাদের বিশ্বাস সৌহার্দ মূলক সামাজিক স্থায়িত্ব একটি মৌলিক আইনী নীতি হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত , যেমন গুড ফেইথ, ন্যায্যতা এবং যুক্তিসঙ্গততা।

২০১৭ সাল থেকে ডাচ বিচারব্যবস্থায় শীর্ষ অগ্রাধিকার পেয়েছে সামাজিকভাবে কার্যকর ন্যায়বিচারের ধারণা। আইন পেশা এবং বিচারবহির্ভূত দ্বন্দ্ব সমাধানের ক্ষেত্রের মতো অনুমোদিত সেক্টরগুলি যেভাবে কাজ করে তা বিচার ব্যবস্থায় দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করে। টেকসই ন্যায়বিচারকে আইন পেশার জন্য কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিরূপ হিসাবে ও বিবেচনা করা হয় । বিচারপতিদের দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান বিচার ব্যবস্থা ও সমাজে অনুকরণীয়। ‘জাস্টিস’ শব্দটিকে সেক্টরের জন্য উপযুক্ত একটি শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে, টেকসই অ্যাডভোকেসি, টেকসই প্রসিকিউশন, টেকসই পুলিশিং, টেকসই পরীক্ষা, টেকসই মধ্যস্থতা ইত্যাদি সংজ্ঞার দ্বারা। দেশবাসী কাল বিলম্ব না করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদালতে আগুন নিভাতে উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে টেকসই মধ্যস্থতার মাধ্যমে এর একটি স্থায়ী সমাধান চায়।

[লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার, সভাপতি, বাংলাদেশ নর্থ আমেরিকান জার্নালিস্টস নেটওয়ার্ক, কানাডা নিবাসী]