আলমগীর মাহমুদ

১.
জীবনে কি পাইলাম।কি হারাইলাম হিসেব মিলানো কঠিন।জীবনের বৈচিত্র‍্যে মাখা এক আত্নজীবনী পড়েছিলাম। বইটির নাম ‘তীর্থ আমার গ্রাম ‘। লেখক মিজানুর রহমান শেলী।ছাত্রজীবনে পড়া আত্নজীবনীটি আজও জীবন্ত ।ভুলতে পারিনি কোনক্ষণেই।
লেখক কানাডায় অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে ধারন করে কাটিয়েছে জীবনের শীত গ্রীষ্মের স্বর্ণালী দিনগুলো।জীবনের শেষ রাস্তার পথিক হয়ে জীবনের যে নির্যাস তাই ই তিনি তুলে ধরেন নিখাদভাবে।
২.
মেধাবী ছাত্র ছিলাম।জীবনে যে মেধা, জ্ঞান,প্রজ্ঞার অর্জন তাহ দিয়ে দেশের সেবা করব এই ছিল বাসনা।শুরু করেছিলাম। ধূপে ঠিকিনি।
আমার জীবনীর শ্রেষ্ট সৃষ্টি উপহার দিতে গিয়েই পড়লাম মহাবিপদে। কেউ আমার সাথে একমত হয় না।আমি বেঠিক তাই বলে নয় অমত ।কেন তারা অমত করে বিষয়টি গভীরে যাবার পর অবাক তন্ময় হই।
কেউ অমত করে তাদের ব্রেইনের মানে আমার দেয়া তত্ত্বটি দশবছর আগানো চিন্তার বলে বুঝে না।আবার আমার সমকক্ষ যারা তারা বুঝেও বুঝে না।কারন ভালকাজে আগিয়ে গেলে দেশ,জাতি হবে উপকৃত।আমি হব বিখ্যাত।বসের পাব মূল্যায়ন। পৃথিবীর বড় গবেষনাগার গুলোতে পড়বে ডাক।প্রতিহিংসায় পড়ে আমার গবেষনায় সৃষ্টির চিন্তা থেকে প্রতিহিংসায় ক্ষতির চিন্তা আমাকে এলেমেলো করে।
আমি ভীষণ দাহ নিয়ে রাজধানী শহর থেকে আমার গ্রামের বাড়ী সাতকানিয়া চট্টগ্রামের অজ পাড়া গাঁয়ের স্নে্হসিক্ত আমার এক স্যারের কাছে বুঝিয়ে মনদাহ নিবারনে পরামর্শ চাইলাম।কি আমার করণীয় স্যার?
উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলিন বদনে ম্রীয়মানভাবে ‘আফসোস তোদের মত সম্ভবনাময় মেধাবীদের সম্ভবনার দুয়ারটা পারলাম না খুলে দিতে।এ সমস্যা আমাদের সৃষ্টি। আমরাই আমাদের উঠার মইটার সিঁড়ি টেনে হেঁচড়ে করি ছারকার।দেশ রাষ্ট্র কেউ নয় এর দায়ী। আমার দায়ী আমি। ”
৩.
শুন, “গবেষনা,উপাসনা,লেনাদেনা টেনশনে হয় না।’যে টেনশন দাহ তোকে ল্যাব থেকে অজপাড়ায় আসতে করেছে বাধ্য, এদেশে তোর গবেষক হওয়া হবে কঠিন।যে জাতি মেধারে পূঁজা করে ঐ জাতির কাছে চলে যা।যারা পূঁজায় ফুল দিতে জানে তারা ভালবাসতে ও জানে।তাদের মূল্যায়নেও পাবি অমূল্যের উপহার।
স্যারের বাসা থেকে ঘরমুখো ফিরতি যাত্রায় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত।পাড়ি জমাতে হবে ইউরোপ। একবছর পার হতে না হতে কানাডায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর চান্স হয় আমার।শুরু করেছিলাম শূণ্য থেকে।
৪.
আজ পৃথিবীর দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয় আমার তালিমে।পৃথিবীর বিখ্যাত অধ্যাপক হবার পরও যখন একাকী হই। ভাবনায় হিসেব মিলাই, জীবনের কোথায় যোগের চিহ্ন।কোথায় আমার বিয়োগের চিহ্ন।
আজ কাঁড়ি কাঁড়ি মূদ্রা ছাড়া আমার কিছুই নেই নৈবেদ্যের।
দেশের সেবা করব।শুক্রবারে মা’র কবর জিয়ারত করতে করতে জানান দিব,”তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মা।”জীবনের ব্যস্ততায় সব হইল।পৃথিবীর সব সম্ভব এবং সম্ভবনা আমার হাতের মূঠোয়। অথচ শুক্রবারে মা,র কবরের পাশে দঁাড়িয়ে জানাতে পারি না–‘অ..মা আমি তোমার মিজান যার জন্য আমাদের বাড়ীর শেষ সন্বল দুধের গাভীটারে বিক্রি করে আমার কলেজের ভর্তির টাকা যোগাড় করেছিলে।আমি তোমার সেই পুত্রধন। পৃথিবীর শক্তিশালী মুদ্রায় গোলাঘর ভরতি। তোমারে এই শক্তিশালী মূদ্রায় ঘুম পাড়িয়ে বলতে পারলাম না।মা,আমি সুখী হয়েছি।সুখী সমৃদ্ধির প্রয়োজনে সাত সাগর তের নদীর তীরে এসেছি।আজ তোমার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে পারিনা।’মা আমি সুখী, সমৃদ্ধ হয়েছি।
‘জীবনের অর্জনে সমৃদ্ধশালী হয়েছি মা, সুখী হতে পারিনি।’
৫.
সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রী মমতাজ মারা যাবার কালে সম্রাটকে ডেকে চারটি কথা বলেছিলেন।১/সম্রাট আমি মনে হয় আর বাঁঁচবো না।আমি যদি মারা যাই তুমি আর একটা বিয়ে করবে।২/আমি যদি মারা যাই আমার সন্তানদের চোখে চোখে রাখবে, দরদে। ৩/আমাকে তুমি ভালবাসতে এটা যাতে পৃথিবীবাসী জানে এমন একটা কাজ করবে।৪/আমার প্রত্যেক মৃত্যু দিবসের ফজরের নামাজের পর তুমি আমার কবরের পাশে এসে বসবে।
সম্রাট শাহজাহান পৃথিবীর সপ্তম আচার্যের একটি, তাজমহল নির্মান করে পৃথিবীবাসীকে জানান দিয়েছিল আমি মমতাজকে ভালবাসি।জীবনের বাসনা শেষ পূর্ণতা দিয়ে যেতে পারেন নি।শাহজাহানের অন্তিম ইচ্ছা ছিল শ্বেতপাথরের তাজের মহলে মমতাজ ঘুমাবে মধ্যে যমুনা থাকবে প্রবাহমান।তার উপরে নির্মিত হবে নান্দনিক সেতু যমুনার ওপারে নির্মিত হবে কাল পাথরের আরো একটি তাজমহল যেটিতে ঘুমাবে শাহজাহান।
শাহজাহানের পুত্রদের উউত্তরাধিকারী যোদ্ধে ভাই ভাইকে হত্যা করে কাপড়ে মুড়িয়ে বাবাকে উপহার দিয়েছিল ভাইয়ের (কল্লা)মাথা বিচ্ছিন্ন করা অংশ।আওরঙ্গজেব বাবাকে বন্দী করে দখল করে মসনদ।জাহানারা ভাইদের আপোষ মীমাংসায় পুরা ভারতবর্ষ ভাইদের ভাগ করে রফা করতে চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সংসার ধর্ম ত্যাগ করে বাবার সাথে যমুনার তীরে বাবার কারাগারের সাথী হয়েছিলেন।
শাহসুজা আরাকানে আশ্রয় নিতে গিয়ে ট্রেজেডিময় জীবন হয়েছিল ললাট লিখন। আত্নহুতিতে বিদায় নিতে হয় পৃথিবীর বিষাদেরসিন্ধু থেকে।
ভারতবর্ষের প্রতাপশালী সম্রাট শাহজাহান পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী জীবনকালে পুত্রের কাছে শেষ একটা ফরিয়াদ,’অ পুত্র তোর কাছে মোর শুধুই একটা নিবেদন,আমারে কারগারের উপরে মিনা মসজিদে মক্তব পড়ানোর সুযোগটা দে!
৬.
খুলনার এরশাদ সিকদার হাজারো কুকীর্তি করে বানিয়েছিলেন বিলাসবহুল বাড়ি, নাম রেখেছিলেন ‘স্বর্ণকমল’।ফাঁসির কাষ্টে ঝুলানোর আগে তাকে জানতে চাওয়া হয়েছিল, জীবনের শেষ ইচ্ছার কথা।সাবলীল ভাষায় জবাব ছিল,’আমার মৃতদেহটারে যেন ‘স্বর্ণকমলে’ নেয়া না হয়।
৭.
আগের বেডফোর্ট কোম্পানির বাসগুলোই ছিল আমাদের যাতায়তের একমাত্র মাধ্যম।এই বাসগুলোর সামনের সাইট ছিল লম্বা সাইজের।ষ্টাট করতে হত সামনে হাতলের মত এক্টা লোহার রডের বানানো ইংরেজী Z আদ্যাক্ষরের মত যন্ত্র দিয়ে।
এই বাস গুলোর ভেতরে লেখা থাকত বেশকিছু নান্দনিক শ্লোক।, ব্যবহার বংশের পরিচয়।মহিলা আসিলে পুরুষ সিট ছাড়িয়া দিবেন।অপরিচিত লোকের দেয়া কিছু খাবেন না।পকেট সাবধান। কোন অভিযোগ থাকিলে চালককে জানান।চালকের মাথার উপরে লেখা থাকত ‘চলন্ত অবস্থায় চালকের সাথে কথা বলিবেন না।নামার দরজায় যেখানে হেল্পপার দাঁড়ানো তার উপরে লেখা থাকতো, জনাব! কিছু ফেলে গেলেন কি?
আমরা সবাই জীবনগাড়ীর প্যাসেঞ্জার বিদায়ের বেলায় যখন ঐ লেখাটা দেখি….তখন কি আফসোসে ডাক দিয়ে বলতে ইচ্ছে হয় না….’যাহ ফেলে গেলাম তাহ কি ফেরত দওন যাইব’!!
লেখক:–
উখিয়া কলেজের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক।
alamgir83cox@gmail.com