– মুহম্মদ নূরুল ইসলাম
বঙ্গোপসাগরের প্রান্ত ঘেঁষে কক্সবাজারের দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। সৈকতে রয়েছে হরেক রকমের জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী। এসব জলজ উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির ও বিভিন্ন বর্ণের। জলজ প্রাণীর মধ্যে অসংখ্য কাঁকড়া দৃশ্যমান। তৎমধ্যে খুব সহজেই এক প্রকার টকটকে লাল জলজ প্রাণী সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই টকটকে জলজ প্রাণীটি হচ্ছে লাল কাঁকড়া। হাজারো রকমের কাঁকড়ার ঝাঁকে যাকে সহজেই আলাদা করা যায়। লাল কাঁকড়ার মোহিনী রূপ সহজেই যে কাউকে আকর্ষণ করতে পারে। লাল কাঁকড়ার সৌন্দর্যের কাছে আপনিও হার মানবেন। আপনিও প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য।
সেই লাল কাঁকড়ার প্রেমে পড়েছে ইমু।
ইমু তার স্কুলের বন্ধুদের কাছে সমুদ্র সৈকতের অনেক গল্প শুনেছে। সমুদ্রে স্পিড বোটে ঘুরে বেড়ানো, ঘোড়ায় চড়া, সাইকেলে চড়া, মোটর সাইকেলে চড়া, রাইডার, ক্যাবল কার, বেলুন নিয়ে আকাশে উড়া, ঘুড়ি নিয়ে আকাশে উড়া, নাগর দোলায় চড়া আরো কত কী?
ইমু ভাবে নি এতো কিছু? ইমু মনে করতো সমুদ্র সৈকত মানে শুধু সমুদ্রের স্বাস্থ্যকর নির্মল হাওয়া, সাগরের রেত বালুতে দৌঁড়া-দৌঁড়ি করা। কিন্তু সাগরের রেত বালুতে দৌঁড়ানো খুবই কঠিন কাজ। বন্ধুদের কাছ থেকে এতো কিছু শুনে ইমু মনে মনে অনেক রোমাঞ্চিত হলো। ইমুর মাথায় এখন শুধু একটি ভাবনা, কখন সে সব দেখবে। কখন রাইডারে করে ঘুরে বেড়াবে।
এসব কিছু মাথায় আসলেই ইমু উদাসিন হয়ে পড়ে। পড়ালেখায় মন বসে না।
একদিন দুইদিন, এভাবে কেটে গেলো কয়েকটা দিন।
বিষয়টি তার মায়ের দৃষ্টি এড়ায় নি। ইমুর মা সুরাইয়া বেগম একদিন রাতের বেলায় খাওয়-দাওয়ার পরে ইমুর বাবাকে বললেন, ছেলের দিকে আপনার কোন নজর আছে? ওর তো পড়লেখার প্রতি নজর আছে বলে মনে হচ্ছে না। সে তো সবসময় আনমনা হয়ে কি যেনো ভাবতে থাকে।
ইমুর বাবা বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। তিনি সুরাইয়াকে বললেন, বাচ্চা মানুষ কদিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু দিন যায় রাত আসে। ইমুর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসে না। এর মধ্যে স্কুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা হয়ে গেলো। পরীক্ষার রেজাল্ট দিলো। ইমু সব বিষয়ে ফেল করেছে। এতে করে ইমুর বাবা জাহেদ সাহেবের টনক নড়লো।
ইমুর বাবা একদিন বেলা থাকতেই বাড়ি ফিরে এলেন। এতে বাড়ির সবাই বিস্মিত। তবে খুশিও।
ইমুর বাবা জাহেদ সাহেব ব্যাংকের বড় কর্তা। তিনি প্রতিদিন ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান আর অনেক রাত করে ঘরে ফিরেন। ইমু ঘুমিয়ে পড়ে। ফলে রাতের বেলায় বাবা ও ছেলের দেখা হয় না।
শুক্রবারে ইমুর বাবা বাড়িতে থাকেন। অনেক সময় তিনি গ্রামের বাড়ি চলে যান। গ্রামে রয়েছে ইমুর দাদা-দাদি। বন্ধের দিনেও ইমু বাবাকে তেমন একটি কাছে পায় না। কিন্তু আজ বেলা থাকতেই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসাতে ইমুও আশ্চর্য হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইমুর সেই চাহনিতে অনেক প্রশ্ন। ইমু ভাবতেই পারছে না এই অসময়ে বাবা কেনই বা অফিস থেকে ফিরলেন।
ইমুর বাবা বেলা থাকতে বাড়ি ফিরে আসার সুবাদে ঘরে ধুপি পিঠা বানানোর ধুম পড়ে গেলো।
ইমুর বাবা জাহেদ সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়ে ঘরে এলেন। বাবা ঘরে আসতেই ইমুর মা সুরাইয়া খাবার টেবিলে ধুমায়িত ধুপি পিঠা নিয়ে এলেন। কাঁচা মরিচ দিয়ে রান্না করা মুরগির গোস্ত। সাথে মাইট্টা আলুর তরকারি। ধুপি পিঠার সাথে মাইট্টা আলুর তরকারি ও মুরগির গোস্তা বরাবরই ইমুর বাবার খুবই প্রিয়। ইমুর কাছেও তরকারিটি খুবই পছন্দের।

জাহেদ সাহেব ইমুকে সাথে নিয়ে খেতে বসলেন। ইমুর মা’ও টেবিলে এসে বসলেন। মা পিতা-পুত্রকে খাবার পরিবেশন করছেন। খেতে খেতে জাহেদ সাহেব ইমুকে একথা সেকথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। বাপ-বেটার খাওয়া শেষ।
জাহেদ সাহেব ইমুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘বাপ, তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট কি?
ইমু নিরুত্তর। লজ্জায় তার মুখ লাল হয়ে গেলো। সে বাবার দিকে থাকাতে পারলো না। চোখ ছল ছল করে উঠলো। দুÕএকফোটা জল গড়িয়ে পড়লো কপোলে। সে নিচের দিকে মুখ করে থাকলো।
জাহেদ সাহেব জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে তোমার? তুমি কাঁদছো কেনো?
ইমু নিরুত্তর।
সুরাইয়া এগিয়ে এসে ইমুকে ওখান থেকে নিয়ে গেলো।
জাহেদ সাহেব বুঝতে পারলেন কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফলে কথা না বাড়িয়ে ওখান থেকে উঠে গেলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, কাল শুক্রবার বিকেলে আমরা বেড়াতে যাবো।
বেড়ানোর কথা শুনেই ইমুর মন খুশিতে আটখানা। মনের মধ্যে কী যে আনন্দ তা প্রকাশ করার নয়। ইমু রাতে পড়ার জন্য বই নিয়ে টেবিলে বসলো। কিন্তু পড়াতে মন নেই, খাবারেও আগ্রহ নেই। খাবারে আগ্রহ নেই বললে তো আর হবে না। খেতে তো হবে। না খেলে মা, বাবা বকা দেবে। তারা টেনশন করবে।
রাতের খাবারের জন্য মা ডাক দিলো। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খেতে গেলো টেবিলে। রাতের খাবারের পরে বিছানায় গেলো ঘুমাতে। কিন্তু এতো সহজে কী আর ঘুম আসে? ইমুর চোখ থেকে ঘুম আজ যেনো নির্বাসনে গেছে। ইমুর মাথায় শুধু একটি চিন্তা কখন সকাল হবে। সকালের পরে কখন বিকাল হবে। বাবা কখন তাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে? কোথায় নিয়ে যাবে? ঘুম তো আর আসে না। ভোররাতে ঘুমের সাথে আর পেরে উঠলো না। কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো সে বুঝতে পারে নি। সকালে বেশ বেলা করেই ইমুর ঘুম ভাঙ্গলো। মাও ঘুম থেকে জাগায় নি।
আজ শুক্রবার স্কুল বন্ধ।
ঘুম ভাঙ্গতেই ইমু দড় ফড় করে উঠে পড়লো। ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। ক্ষুধায় পেট চু চু করছে। ঘুমের কারণে এতক্ষণ বুঝতে পারে নি। ত্বরিৎ বিছানা ছেড়ে উঠে মুখ হাত ধুয়ে খেতে গেলো টেবিলে। কিন্তু খাবার নেই। ইমু খাবারের জন্য মাকে ডেকে বললো, মা নাস্তা দাও।
মা রান্না ঘর থেকে গলা উঁচিয়ে বললো, আসছি, তুমি টেবিলে বসো।
মা গরম গরম লুচি, হালুয়া নিয়ে টেবিলে হাজির।
ইমু নাস্তা খেতে খেতে মা’র কাছ থেকে জানতে চাইলো, বাবা আজ আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে?
মা ছেলেকে কোনো উত্তর দিতে পারলো না। বললো, তোর বাবাতো আমাকে বলে নি কোথায় নিয়ে যাবে।
মা বললো, হ্যাঁ, তোর বাবা আমাকেও যেতে বলেছে।
দেখতে দেখতে ইমুর খাওয়া শেষ।
আজ জুম্মা বার। কিছু সময় পরেই ইমু গোসল সেরে নিলো। মসজিদে জুম্মার নামাযের আযান হচ্ছে। জাহেদ সাহেব মসজিদে যাওয়ার জন্য কাপড় পড়ে তৈরি। ইমুও পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে নিলো। মাথায় রূমি টুপি। ইমুও বাবার সাথে মসজিদে গেলো। বাড়ির পাশেই মসজিদ। জুম্মার নামাজ শেষে পিতা-পুত্র বাড়ি ফিরে এলো। এদিকে পিতা-পুত্র মসজিদ থেকে আসার আগেই ইমুর মা টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখলো। ঘরে মানুষ বলতে ইমু, ইমুর মা ও ইমুর বাবা। হ্যাঁ, আরো একজন আছে। কাজের মেয়ে টুনি। সবাই এক সাথে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলো।
দুপুর গড়িয়ে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়লো।
ইমুর বাবা বললো, সবাই কাপড় পরে রেডি হয়ে নাও। আমরা একটু পরেই বেরিয়ে পড়বো।
এবার বাইরে যাওয়ার পালা।
জাহেদ সাহেব গাড়ি বের করলেন। নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাবেন। আজ শুক্রবার ড্রাইভারের ছুটি। কাজের মেয়ে টুনিসহ সবাই গাড়িতে উঠে পড়লো। কাজের মেয়ে টুনিও বয়সে ছোট। অনেকটা ইমুর বয়সের। টুনির মা-বাবা দুইজনই মারা গেছে অনেক আগে। টুনির মা জাহেদ সাহেবের বাড়িতে কাজ করতো। জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় টুনি মাকে হারায়। তারও একবছর আগে তুফানের সময় টুনির বাবা মারা যায়। তুফানের সময় বাড়ি চাপা পড়ে টুনির বাবা মারা গেছে। ভাগ্য ক্রমেই টুনিও টুনির মা বেঁচে যায়। তুফানে দমকা হাওয়ায় টুনিদের নড়বড়ে ঘরটি ধ্বসে পড়ে। বাতাসের তোড়ে ঘরের খড়ের ছাউনি উড়ে গেছে আগেই। পরে ঘরটি যখন ধ্বসে পড়লো তখন টুনি আর তার মা ঘরের ঢেঁকির পাশেই ছিলো। আর এতে রক্ষা। ঘরটি ধ্বসে পড়লেও ঢেঁকি খাড়া ছিলো।
গৃহহারা টুনির মা জাহেদ সাহেবের বাড়িতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করলো। টুনিকে নিজের মেয়ের মতো করেই ঘরে আশ্রয় দিয়েছে জাহেদ সাহেব ও সুরাইয়া বেগম। টুনির মা মারা গেলে টুনি একদম নিঃস্ব হয়ে যায়। বাবা-মাকে হারিয়ে দুনিয়াতে এতিম হয়ে পড়ে। কিন্তু ইমুর বাবা-মা টুনিকে সেটা বুঝতেই দেয় নি। তাই কোথাও গেলে টুনিকেও সাথে নিয়ে যায়। ঘরে খাবার সময় তারা চারজনই একসাথে খায়। টুনিও তার মা-বাবাকে হারিয়ে এতিম সেটা বুঝতে পারে না।
জাহেদ সাহেব নিজেই গাড়ি চালিয়ে সমুদ্র সৈকতের লাবণী পয়েন্টে পৌঁছলেন। পার্কিং-এ গাড়ি লক্ড করে চারজনই নেমে পড়লেন সমুদ্রের বালিয়াড়িতে। বালির ঢিবি ডিঙ্গিয়ে, সৈকতের বুনো লতাফুল মাড়িয়ে তারা পানির ধারে নেমে পড়লেন।
সৈকতের বালিয়াড়িতে নামতে নামতে ইমু অবাক বিস্ময়ে চারদিকে চেয়ে নিলো। সমুদ্রে দেখা যাচ্ছে বিশাল বিশাল জাহাজ। পাশে রয়েছে ছোট ছোট ইঞ্জিন নৌকা। সে সব নৌকাতে লোকজন মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত। নৌকার উপরে সাদা গাঙচিলের ঝাঁক উড়াউড়ি করছে। কোনো কোনো গাঙ্গচিল ছুঁ মেরে জাল থেকে মাছ নিয়ে উর্ধ্বাকাশে উড়াল দিচ্ছে। এভাবে গাঙ্গচিলের খেলা দেখতে দেখতে ইমু তন্ময় হয়ে গেলো। তার আর কোনো দিকে খেয়াল নেই। তার বাবা তাকে তার স্বরে ডাকছে কিন্তু সে দিকে খেয়াল নেই ইমুর। বাবা এসে ইমুকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো আরো দক্ষিণে।
লাবণী পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ দিকে কলাতলী। ওদিকে যেতে যেতে ইমু দেখতে পেলো বিভিন্ন রকমের রাইডার। কেউ ঘোড়ায় চড়ে দৌঁড়াচ্ছে, কেউ বিচ বাইকে চড়ছে, কেউ সাইকেলে ছুটছে, কেউ বা প্যারাসুটে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, কেউ বা ঘুড়িতে চড়ে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, কেউ বা বেলুনে করে উড়ে বেড়াচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে ইমু শিহরিত হলো। আবার আতঙ্কিতও হলো। যদি উড়তে উড়তে আকাশ থেকে ছিটকে পড়ে যায়। ভাবতেই গা হিম হয়ে আসছে। আবার দেখে স্পিডবোট নিয়ে কেউ বা সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। স্পিডবোটগুলো সমুদ্রের সফেদ ফেনার উপর লাফিয়ে লাফিয়ে নাচছে। কলাতলীর কাছে পৌঁছতেই চোখে পড়লো বিচিত্র একটি জিনিস। চিনতে না পেরে সে তার জিজ্ঞেস করলো, বাবা, আকাশের উপর ওটা কিসের গাড়ি?
বাবা জিজ্ঞেস করলো, আকাশে গাড়ি দেখলে কোথায়।
ইমু আকাশের দিকে আংগুল তুলে দেখিয়ে দিও, ওটা।
জাহেদ সাহেব ছেলেকে বললো, হ্যাঁ, তুমি ঠিক ধরেছো, ওটাও একটি গাড়ি। ওটাকে বলে ক্যাবল কার। বিদ্যুৎ তারের মাধ্যমে এই গাড়ি চলে বলেই এই গাড়ির নাম ক্যাবল কার।
ইমু বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে থাকলো আকাশের গাড়ির দিকে।
পাহাড়ের উপর থেকে এসব ক্যাবল কার একটি তারের সাথে নিচে নামছে। ক্যাবল কারটিকে মনে হচ্ছে আকাশের উপর একটি ছোট্ট খেলনার বক্স। খেলনার বক্সটা যতই নিচে নামছে ততই তা বড় হচ্ছে। ইমু দেখতে পেলো বক্সের ভেতরে মানুষও আছে। মনে হচ্ছে এখনই ছিঁড়ে পড়ে যাবে। ক্যাবল কার কলাতলী সমুদ্র সৈকতের পানিতে নেমে যাচ্ছে?
ইমু আতঙ্কিত হয়ে বাবাকে বললো, বাবা, বাবা, গাড়িটি পানিতে নেমে যাচ্ছে।
ইমুর বাবা ছেলেকে অভয় দিয়ে বললো, না, ক্যাবল কার পানিতে নামবে না। ওখানে ক্যাবল কারের একটি স্টেশন আছে।
স্টেশনেই ক্যাবল কারটি থামলো। কারের ভেতর থেকে শিশু, নারী-পুরুষ চারজন নামলো।
ইমুকে বাবা জিজ্ঞেস করলো, ক্যাবল কারে চড়বে?
ইমু ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বাবার হাত শক্ত করে ধরে বললো, না, বাবা আমি ক্যাবল কারে চড়বো না। আমার ভয় করছে।
বাবা স্বস্নেহে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ভয় পাওয়ার কি আছে। দেখলে না তোমার চোখের সামনেই তো ছোট শিশুটা তার বাবা-মার সাথে ক্যাবল কারে চড়ে নামলো।
একথা বলে জাহেদ সাহেব সবাইকে নিয়ে ক্যাবল কার স্টেশনে গেলেন। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট নিলেন। পরে একটি কারে উঠে পড়লো সবাই।
ক্যাবল কার চলতে শুরু করলো। ইমু এতদিন ক্যাবল কারের নাম শুনেছে কিন্তু দেখে নি বা সেই কারে চড়ার সুযোগ হয় নি। আজ কার যেমন দেখলো তেমনি তাতে চড়ারও সুযোগ হলো। ইমু দেখলো ক্যাবল কার বলতে একটি গাড়িই। ইমু বুঝতে পারলো ক্যাবল হচ্ছে বিদ্যুৎ তার, আর কার হচ্ছে গাড়ি। সেই কারের ভেতরে আছে সামনা সামনি দুইটি সিট। প্রতিটি সিটে তিনজন করে বসা যায়। কিন্তু ইমু, তার বাবা-মা ও কাজের মেয়ে টুনি একটি কারে চড়ে বসলো। কার ক্রমে সৈকত পয়েন্ট থেকে পাহাড়ের দিকে উঠতে লাগলো। চারজন যাত্রী নিয়ে একটি ছোট্ট কার কী করে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে ইমুর কাছে সেটা বড় বিস্ময়। যত উপরের দিকে যাচ্ছে কার ততই ভয়ে ইমুর অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে ইমু মায়ের কোলে মুখ লুকালো।
ছেলের অবস্থা দেখে মা জিজ্ঞেস করলো, ইমু তোর কি হয়েছে? এভাবে ভয় পাওয়ার কি আছে? আমরা সাথে আছি না?
মায়ের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে সাহস সঞ্চয় করে ইমু মায়ের কোল ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। দেখা দেখি টুনিও দাঁড়িয়ে বিশাল বঙ্গোপসাগর ও পাহাড়ের অপূর্ব© দৃশ্য দেখতে লাগলো।
ইমু বললো, তুমিও দাঁড়াও মা, দেখো না কি সুন্দর দৃশ্য।
ছেলের আহবানে মাও উঠে দাঁড়ালো। তারা উভয়েই দেখতে লাগলো একটি তারের উপর ভর দিয়ে একটি চারজনের গাড়ি কী করে চলাচল করে। দেখতে দেখতে তাদের গাড়ি কলাতলীর পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলো। পাহাড়ের চূড়া থেকে সমুদ্র সৈকত অনেক নিচে মনে হচ্ছে। কলাতলীর পাহাড়ের চূড়ায় ক্যাবল কার থেমে গেলো। ইমুরা আবার টিকেট কেটে নিচে সৈকতে নামলো। নিচ থেকে উপরে আবার উপর থেকে নিচে নামার ফলে ইমুর ভয় একদম কেটে গেলো।
তারা সবাই ক্যাবল কার থেকে নেমে দক্ষিণ দিকে হাঁটতে লাগলেন। ক্যাবল কারে চড়তে পেরে ইমুর খুশি কে দেখে। তারা সবাই আর একটু দক্ষিণ দিকে যেতেই ইমুর চোখ ছানাবড়া। পুরো সমুদ্র সৈকত লালে লাল হয়ে গেছে। যেনো লাল রঙ এনে কেউ পুরো কলাতলীর সমুদ্র সৈকতকে রাঙিয়ে দিয়েছে। ইমুরা আরো দক্ষিণ দিকে হাঁটতে লাগলো। একি! লাল রঙ এখন আগের জায়গায় নেই। সমস্ত লাল রঙ দ্রুত সরে যাচ্ছে। কী বিচিত্র! লাল রঙ আবার হাঁটতে পারে? ইমুর মনে হলো লাল রঙ দ্রুত হাঁটছে। ইমু যত কাছে যেতে লাগলো ততই লাল রঙ হাঁটতে লাগলো। ইমুর মনে কৌতুহলের শেষ নেই। ইমুর এখন একমাত্র লক্ষ্য সেই লাল রঙের কাছে পৌঁছা। কোনো দিকে তাকাবার ফুরসুৎ নেই। বাবা, মা, টুনি কোথায় সেদিকে খেয়াল নেই। ইমু হাঁটছে তো হাঁটছে। কিন্তু লাল রঙের কাছে পৌঁছতে পারছে না। এদিকে ইমু হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে গেলো। ওদিকে ইমুর বাবা, মা, টুনি ইমুকে না দেখে অস্থির হয়ে পড়েছেন।
ইমুর বাবা জাহেদ সাহেব এদিক ওদিকে তাকিয়ে ছেলেকে না দেখে ইমুর নাম ধরে ডাকতে লাগলো, ইমু, ইমু তুমি কোথায়?
বাবার আহবানের প্রতি ইমুর খেয়াল নেই।
জাহেদ সাহেব আবার ডেকে উঠলো, ইমু, ইমু তুমি কোথায়?
এরপরেও ইমুর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে জাহেদ সাহেব বিচলিত হয়ে উঠলেন। এরপরে তিনি দক্ষিণ দিকে হাঁটা শুরু করলেন এবং একটু এগুতেই ইমুকে দেখতে পেলেন। এতে জাহেদ সাহেবের ধড়ে প্রাণ এলো। জাহেদ সাহেব বলো উঠলো, আমি এদিকে তোমাকে ডেকে ডেকে গলা ফাটাচ্ছি কিন্তু তোমার কোনো সাড়া শব্দ নেই।
ইমু বাবার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে উল্টো বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা লাল রঙগুলো হাঁটছে কেনো? আমি লাল রঙের কাছে যাবো।
জাহেদ সাহেব ছেলের কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝেতে পারছে না।
ছেলেকে বুঝিয়ে বললো, ওগুলো লাল রঙ নয়। ওগুলো লাল কাঁকড়া।
তিনি বললেন, লাল কাঁকড়াকে সহজেই ধরা যায় না। লাল কাঁকড়া খুবই বুদ্ধিমান। সাগরের বালিতে গর্ত করে বসবাস করে। মানুষের নড়চড়া পেলেই মানুষকে বোকা বানিয়ে মূহুর্তের মধ্যেই গর্তে ঢুকে পড়ে। শুধু কি তাই, এই লাল কাঁকড়া নিজের গর্ত খুঁজে না পেলেও খুব দ্রুতই নতুন গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে যায়।
জাহেদ সাহেব ছেলেকে বলতে লাগলো, লাল কাঁকড়া অন্য কাঁকড়ার মতো হিং¯্র নয়। অন্য কাঁকড়া মানুষকে কামড়ে রক্ত বের করে। কিন্তু লাল কাঁকড়ার দাঁত অন্য কাঁকড়ার মতো ধারালো নয়। ফলে মানুষকে কামড়ালেও রক্ত বের হয় না বা ব্যথা পায় না। তবে লাল কাঁকড়াকে ধরতে গেলে করাতের মতো দাঁত খিচিয়ে শরীরের উপরের উজ্জ্বল রঙের দুইটি চোখ দিয়ে ডেবডেব করে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুইটিকে দেখতে ধারালো শিং-এর মতো মনে হয়। লাল কাঁকড়া এই শিং দুটি দিয়েই মানুষকে ভয় পাইয়ে দেয়।
দেখতে দেখতে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। সূর্যটাকে দেখতে একটি লাল থালার মতো মনে হচ্ছে। অনেকটা ডিমের ভেতরের লাল কুসুম। থালাটা ক্রমেই অতল সাগরে ডুবে যাচ্ছে। আর ধরণীকে অন্ধকার গ্রাস করছে।
সূর্য ডোবার আগে সবাই মিলে ছবি তুললো।
সমুদ্র সৈকত থেকে কূলে উঠে তারা মারমেড ইকো রিসোর্টে গেলো সান্ধ্যকালীন চা-নাস্তা খেতে। ইকো রিসোর্টের ঝাড় বাতি পুরো হোটেল চত্বরের পরিবেশকে মোহময় করে তুলেছে।
হোটেলের অভ্যন্তরে গিয়ে বসতেই বয় এসে একটি বই দিয়ে গেলো। ইমুর বাবা বই-এর পাতা উল্টেপাল্টে বয়কে কি কি যেন আনতে বললো। চা-নাস্তা সেরে বাড়ি ফিরে এলো।
ইমু এখন পড়তে বসলে চোখের সামনে কেবল ভেসে উঠে লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। ইমু লাল কাঁকড়া সম্পর্কে আরো জানার জন্য লাইব্রেরি থেকে বই সংগ্রহ করলো। ইমু বই পড়ে জানতে পারলো, লাল কাঁকড়া খুবই নিরীহ জলজপ্রাণী। কক্সবাজারের কলাতলী ও টেকনাফের জইল্যারদিয়া ও ন্যাটং পাহাড়ের লালমুখো প্রজাতির বানরেরা শুধু লাল কাঁকড়া খায়। লাল কাঁকড়া খায় বলেই বানরের মুখ লাল হয়েছে। মা লাল কাঁকড়া একসাথে অনেকগুলো ডিম দেয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেই ডিম থেকে বাচ্চা বের হয়। লাল কাঁকড়া মানুষের ক্ষতি করে না। কিন্তু মানুষ নাগালের মধ্যে পেলেই লাল কাঁকড়া ধরে। লাল কাঁকড়ার গর্ত বন্ধ করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মানুষ লাল কাঁকড়া মারতে আনন্দ পায়। লাল কাঁকড়া মানুষের কোনো ক্ষতি না করলেও মানুষ লাল কাঁকড়াকে কেনো আক্রমণ করে ইমু বুঝতে পারে না।
বেশ কিছুদিন পরেই ইমু তার বাবার কাছে বায়না ধরলো। সে বললো, ‘বাবা চলো না আবার সমুদ্র সৈকতে বেড়িয়ে আসি।
জাহিদ সাহেব ছেলের আবদানে আবার সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলো। বাবা বললো, ঠিক আছে আগামী শুক্রবার অফিস বন্ধ আছে আমরা আবার সৈকতে যাবো।
যথারীতি শুক্রবার দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পরে তারা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেলো। সৈকতে গিয়ে ইমু বাবাকে কলাতলীর সৈকতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরলো।
ইমু বাবাকে বললো, বাবা চলো না কলাতলীতে লাল কাঁকড়ার ঝাঁক দেখে আসি।
ছেলের কথা মতো জাহেদ সাহেব কলাতলীতে সৈকতে গেলো যেখানে লাল কাঁকড়ার ঝাঁক দেখেছিলো। কিন্ত গিয়ে জাহেদ সাহেবের চোখ ছানা বড়া, দেখে ওখানে একটি লাল কাঁকড়াও নেই। এর মধ্যেই ইমু লাল কাঁকড়া দেখতে অস্থির হয়ে উঠলো। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা গেলো, ওখানে সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে তাই লাল কাঁকড়ার বসতি এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে করে লাল কাঁকড়াও অন্যত্র চলে গেছে।
শুনে ইমু মনে খুবই কষ্ট পেলো। পিতা-পুত্র স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করলো লাল কাঁকড়া কোন দিকে গেলে দেখা যাবে?
এলাকাবাসী জানালো, পেচাঁরদ্বীপে লাল কাঁকড়া দেখতে পাওয়া যেতে পারে। পেচাঁরদ্বীপ এখান থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দক্ষিণে।
ছেলের সাথে সাথে জাহেদ সাহেবও লাল কাঁকড়ার প্রেমে পড়ে গেলো। তাই ছেলেকে বললো, লাল কাঁকড়া দেখতে আগামী শুক্রবার তোমাকে পেঁচারদ্বীপে নিয়ে যাবো।
দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। সকাল থেকে ইমুর ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেলো। পিতার সাথে জুমার নামাজ পড়ে দুপুরে খেয়ে পেচাঁরদ্বীপ যাওয়ার জন্য বাড়ির সবাই তৈরি।
জাহেদ সাহেব নিজেই গাড়ি চালিয়ে পেচাঁরদ্বীপ সমুদ্র সৈকতে পৌঁছে গেলো। কিন্তু ওখানে পৌঁছে কোনো দ্বীপ দেখা গেলো না।
তারা ওখানে পৌঁছে স্থানীয় লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করলো এখানে তো কোনো দ্বীপ নেই, কিন্তু এলাকার নাম পেচাঁরদ্বীপ কেনো?
লোকজন এর কোনো উত্তর দিতে পারলো না। তবে কেউ কেউ বলতে চেষ্টা করলো, বুড়াবুড়িরা বলেছে এটা আগে নাকি একটি দ্বীপের আকারে ছিলো, সেজন্য এর নাম পেচাঁরদ্বীপ।
সড়কের একপার্শ্বে গাড়ি রেখে সবাই সমুদ্র সৈকতে রেমো পড়লো। ওখানে গিয়ে পাওয়া গেলো সেই লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। ইমু লাল কাঁকড়ার ঝাঁক পেয়ে তাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু লাল কাঁকড়া এতো সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করে না। ইমু বিষণœ মন নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
আগামী নভেম্বর মাসে ইমুর বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। তাই অন্যদিকে মনোযোগ না দিয়ে ইমু এখন পড়ালেখা নিয়েই ব্যস্ত।
যথারীতি পরীক্ষা শেষ হলো। এখন ইমুর হাতে অখণ্ড অবসর। স্কুল থেকে বার্ষিক শিক্ষা সফর ও পিকনিকে যাবে টেকনাফ নাইট্যং পাহাড়ের কাছে কেরুনতলীতে। সে সুযোগে ন্যাটং পাহাড়ের ধারের লাল কাঁকড়া ও লাল মুখো বানর দেখার জন্য ইমুর মনের সুপ্ত বাসনা উঁকি দিলো। ন্যাটং পাহাড় যেখানে নাফ নদীর সাথে মিশে গেছে।
কক্সবাজার শহর থেকে দীর্ঘ দুই ঘন্টা গাড়ি চলার পর কেরুনতলী পিকনিক স্পটে গিয়ে পৌঁছলো। স্কুলের সবাই যখন স্পটে পৌঁছলো ইমু সুযোগ বুঝে ছুটে গেলো জইল্যারদিয়ায়, যেখানে রয়েছে লাল মুখো বানর ও লাল কাঁকড়ার ঝাঁক। ইমু ইতোমধ্যে লাল কাঁকড়া দেখার জন্য তার আরো কিছু বন্ধুকে জুটিয়ে নিলো। ওখানে তারা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলো কিন্তু লাল কাঁকড়া ও লাল মুখো বানর দেখতে পেলো না। ইমু খবর নিয়ে জানতে পারলো, জইল্যারদিয়ার কাছে স্থল বন্দর স্থাপনসহ বিভিন্ন দালান কোঠা নির্মাণ করার কারণে লাল কাঁকড়া ও লাল মুখো বানর এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। ইমু মনক্ষুন্ন হয়ে ফিরে এলো।
ইমু বাড়ি ফিরে বাবাকে বললো, বাবা, কক্সবাজারের পরে টেকনাফেও লাল কাঁকড়া ও লাল মুখো বানর উদাও হয়ে গেছে।
বাবা ইমুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ঠিক আছে লাল কাঁকড়া দেখতে আমি তোমাকে নিয়ে যাব।
কিন্তু ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাবেন একথা বলেন নি।
জাহিদ সাহেব ডিসেম্বর মাসের বড়দিনের ছুটিতে সেন্টমার্টিন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি জানেন সেন্টমার্টিন দ্বীপের ছেরাদিয়াতে প্রচুর পরিমাণের লাল কাঁকড়া রয়েছে। সে কারণেই ছেলেকে লাল কাঁকড়া দেখাতে তিনি সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিয়ে যাবেন। ভাবলেন লাল কাঁকড়া দেখলে ছেলের মন ভালো হবে।
২৪ ডিসেম্বর বিকেলেই জাহিদ সাহেব সেন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। বিশেষ স্টিমারে করে তারা সেন্টমার্টিন দ্বীপের উদ্দেশ্যে টেকনাফ থেকে যাত্রা করলেন। সন্ধ্যা নাগাদ জাহিদ সাহেব সেন্টমার্টিন দ্বীপে পৌঁছে গেলেন। তারা একটি আবাসিক হোটেলে উঠলেন। হোটেলে উঠেই পিতা-পুত্র লাল কাঁকড়ার খুঁজে বেরিয়ে পড়লেন। তারা রাতের বেলায় চুপিসারে গেলেন ছেরাদিয়া। কিন্তু ওখানে গিয়ে পিতা-পুত্র তন্ন তন্ন করে লাল কাঁকড়া খোঁজাখুঁজি করলো। কিন্তু লাল কাঁকড়ার দেখা নেই। জাহিদ সাহেব আগে অনেকবার ছেরাদ্বীপের পাথরের খাঁজে, কেওড়ার ঝোঁপের ধারে লাখ লাখ লাল কাঁকড়া দেখেছেন। কিন্তু এখন কোনো কাঁকড়ার চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। ছেলের মনতো খারাপ হবেই। জাহিদ সাহেবের মনও খারাপ হয়ে গেলো সুদূর সেন্টমার্টিন দ্বীপে এসেও ছেলেকে লাল কাঁকড়া দেখাতে না পেরে। বিষণœ মন নিয়ে ফিরে আসলেন হোটেলে। ফিরেই হোটেল রিসেপসান থেকে জানতে পারলেন দ্বীপে অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে লাল কাঁকড়া কোথায় চলে গেছে। জাহিদ সাহেব মনে মনে ভাবলেন সেন্টমার্টিন দ্বীপে আসাটাই মাটি হয়ে গেলো। শেষ চেষ্টা হিসেবে দ্বীপের পশ্চিম পাশে, পূর্ব পাশে ও উত্তর পাশে এক বার সার্চ করে নেওয়ার জন্য তবু ইচ্ছার বিরুদ্ধে আরো একদিন থাকলেন। না; তাতেও কোনো ফল হলো না। পুরোদিন চষে বেড়ালেন জাহেদ সাহেব ও ইমু। কিছু কিছুতেই কিছু হলো না। দ্বীপের কোথাও লাল কাঁকড়ার টিকিটিও দেখা মিললো না।
জাহিদ পরিবারের একমাত্র ছেলে ইমু। ইমুর মন খারাপ হলে অন্যদের মন ভালো থাকে কী করে? মন খারাপ করে সেন্টমার্টিন থেকে বাড়ি ফিরে এলেন। সেন্টমার্টিন থেকে ফেরার পথে জাহিদ সাহেব ভাবতে লাগলেন সেন্টমার্টিনসহ পুরো কক্সবাজারের জীববৈচিত্রের এই সংকটময় অবস্থার কথা ভাবতেই অবাক লাগে।
ফেব্রুয়ারি মাসের এক বন্ধে জাহিদ সাহেব বাড়ির সবাইকে নিয়ে গেলেন সোনাদিয়া। সোনাদিয়া দ্বীপের অবস্থান বঙ্গোপসাগরে। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে। তবে জেলার দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর দক্ষিণ পাশে। মহেশখালী দ্বীপ ও সোনাদিয়ার মাঝখানে ছোট্ট একটি চ্যানেল রয়েছে মাত্র। স্পিড বোট নিয়ে সবাই সোনাদিয়া গেলেন এবং রাতে ওখানে অবস্থান করলেন। জাহিদ সাহেব ও ইমু খুব ভোরেই লাল কাঁকড়ার খুঁজে বেরিয়ে পড়লেন। পিতা পুত্র ভোর থেকে হাঁটা শুরু করলো আর একটু বেলা হতেই দ্বীপের চারপাশে একচক্ষর দেয়া হলো। সবশেষে গেলো দ্বীপের দক্ষিণ পাশের চরে। গিয়ে তো তারা থ বনে গেলেন। পুরো চর জুড়েই লাল কাঁকড়ার ঝাঁক, মনে হলো কয়েক লাখ লাল কাঁকড়ার সমাবেশ চলছে। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে কাঁকড়াগুলো জমায়েত হয়েছে। দ্বীপের পুরো চরটা লাল চাদরে মুড়ানো। পিতা-পুত্র ওখানে গিয়ে লাল কাঁকড়ার বিরক্তির উদ্রেগ ঘটালো না। ইমু ও তার বাবা একটু ব্যবধানে থেকে লাল কাঁকড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলেন। পিতা-পুত্র লাল কাঁকড়ার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তন্ময় হয়ে গেলো। দেখতে দেখতে কখন অনেক বেলা হয়ে গেলো ইমু ও তার বাবা বুঝতে পারেন নি। ক্ষুধায় যখন ইমুর পেট চু চু করতে লাগলো তখনই তারা খেয়াল করে দেখলো সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। অবশেষে পিতা-পুত্র খেতে গেলো যেখানে ইমুর মা ও টুনি অবস্থান করছে। খাবার পরে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারা আবার গেলো দ্বীপের দক্ষিণ পাশের চরে। গিয়ে দেখে লাল কাঁকড়াগুলো এখনো আগের অবস্থানেই আছে। জাহেদ সাহেব পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতেও সোনাদিয়ায় অবস্থান করলেন।
ভোরে হালকা চা-নাস্তা খেয়ে ইমু ও তার বাবা আবার দক্ষিণ দিকের চরে গেলো। চরে গিয়ে তারা যা দেখলো তাতে তাদের চোখ বিস্ফারিত হলো। চরেই চোখ আটকে রইলো। কালকে লাল কাঁকড়া যা দেখেছিলো আজ তাদের পরিমাণ অনেক বেশি। বিশাল চরে লাল কাঁকড়া ছাড়া আর কিছুই নেই। চরে তিল ধারণের জায়গা নেই। কোথাও বালি দেখা যাচ্ছে না লাল কাঁকড়া ছাড়া।
ইমু ও তার পিতা কৌশলে গুণে গুণে আটটি লাল কাঁকড়া ধরলো। কাঁকড়াগুলো খাঁচায় ভরে দ্রুত স্পীড বোটে করে তারা বাড়িতে ফিরে এলো। ইমু কাঁকড়াগুলোকে নিয়ে বাড়ির ছাদে নার্সারী করার পরিকল্পনা করলো। যেই চিন্তা সেই কাজ। সাগর থেকে আনা হলো বস্তা ভর্তি করে নোনা বালু, বড় ড্রাম ভরে আনা হলো সাগরের লবণ পানি। বাড়ির ছাদে ফেলা হলো সাগরের বালু, বালুকে সমানভাবে বিছিয়ে দেওয়া হলো। এরপরে লবণ পানি ঢেলে বালু ডুবিয়ে দেওয়া হলো। বালুর উপর লবণ পানি দুই ইঞ্চি উচ্চতায় পুরো হয়ে থাকলো। যাতে লাল কাঁকড়া অনায়াসে পানির ভেতরেই ডুবে থাকতে পারে। লাল কাঁকড়া প্রজণনের নাসার্রী তৈরি হলো। পানি কমে গেলে বা শুকিয়ে গেলে নাসার্রীতে দেওয়ার জন্য ড্রামে আরো লবণ পানি সংরক্ষণ করা হলো। এরপর ইমু লাল কাঁকড়াগুলোকে পানিতে ছেড়ে দিলো। কাঁকড়াগুলোকে কাকসহ অন্যান্য পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ছাদের উপর দেয়া হলো নেটের ছাউনি। নাসার্রীতে কাঁকড়া ছেড়ে দিলেতো আর হবে না, কাঁকড়াগুলোকে ওখানে বেঁচে থাকতে হবে। সেই জন্য চাই লাল কাঁকড়ার খাবার। লাল কাঁকড়ার খাদ্য কি বা তা কোথায় কোথায় পাওয়া যায় ইমু কিছুই জানেনা। লাল কাঁকড়ার খাদ্যাভাস জানতে ইমু বই সংগ্রহ করলো। কম্পিউটারের গুগোলে ঢুকে লাল কাঁকড়ার জীবন প্রণালীসহ তাদের খাদ্যাভাস জানতে পড়ালেখা শুরু করলো। বিভিন্ন বই এবং গুগোল থেকে লাল কাঁকড়ার খাদ্যাভাস সংগ্রহ করে ইমু কাঁকড়ার খাবার সরবরাহ করতে লাগলো। কাঁকড়াগুলো অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ছাদটাকে আপন করে নিলো।
দিন যায়, মাস যায়। ইমুর প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও এগিয়ে এলো। ইমু লাল কাঁকড়া নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করলেও এবার কিন্তু পড়ালেখায় মন দিলো গভীরভাবে। দিনে লাল কাঁকড়ার পরিচর্যার পাশাপাশি অনেক রাত অবধি ইমু ক্লাশের বই নিয়েই ডুবে থাকে। যথারীতি পরীক্ষা হলো। ইমু ভালভাবেই পরীক্ষা দিলো। এখন ফল প্রকাশের অপেক্ষায়।
দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরো দুই, দুইটি মাস। একপর্যায়ে কাঁকড়াগুলো ছাদের এককোণে অনেকগুলো ডিম ছাড়লো। লাল কাঁকড়ার অনেকগুলো ডিম দেখে ইমুর খুশি দেখে কে? আরো তিন সপ্তাহ পরে ডিম ফুটে শতাধিক লাল কাঁকড়ার বাচ্চা দেখা গেলো। ইমু লাল কাঁকড়া ও বাচ্চাগুলোকে ভালবাসা দিয়ে, মায়া-মমতা দিয়ে খুবই আপন করে নিলো।
লাল কাঁকড়ার বাচ্চা খুশির খবরের মধ্যেই স্কুলে ইমুর পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। দেখা গেলো ইমু সব বিষয়ে শতভাগ নম্বর নিয়ে ক্লাশে ফাস্ট হয়েছে।
ছেলের পড়ালেখার জন্য জাহিদ সাহেবের পরিবারে গুমোট ও অস্বস্তি বিরাজমান ছিলো। কিন্তু ইমুর ভালো রেজাল্টে পরিবারে আনন্দ ফিরো আসলো।
islamcox56@gmail.com