পেকুয়া প্রতিনিধি:

কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলায় ইউনিয়ন পর্যায়ে বিচার ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ স্তর “গ্রাম আদালত” কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটিতে ইউপি চেয়ারম্যান বা প্যানেল চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকায় গ্রাম আদালতের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ। এতে সামাজিক নিরাপত্তা ও শান্তি শৃঙ্খলা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিশিষ্টজনরা।

বুধবার (২০ আগস্ট) সকাল ১০ টায় উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় গ্রাম আদালতের অচলাবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্পের আওতায় দিনব্যাপী এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

কর্মশালার প্রধান অতিথি ছিলেন পেকুয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নুর পেয়ারা বেগম। সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রকল্প সমন্বয়কারী ফারহানা ইদ্রীস। প্রকল্প বাস্তবায়নে নীতিগত আলোচনা করেন সৈয়দ মোহন উদ্দিন।

আলোচনায় অংশ নেন বারবাকিয়া ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মাওলানা বদিউল আলম, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোছাইন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান মঞ্জু, প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক এম. আবদুল্লাহ আনসারী, সাংবাদিক এফ.এম. সুমন, ছাত্র প্রতিনিধি হিরণ ছরওয়ার, ইউপি সদস্য আবুল কালাম, ফয়সাল আকবর, শাহেদুল ইসলামসহ অনেকে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৩ মাসে পেকুয়া সদর ইউনিয়নে ৮৩১টি মামলা রজু হয়েছে, যার মধ্যে ৮০৭টি নিষ্পত্তি হয়েছে। বারবাকিয়ায় ১১৫টির মধ্যে ৯৩টি, মগনামায় ৯৮টির মধ্যে ১০০টি (পূর্বের মামলাসহ), উজানটিয়ায় ২০টির মধ্যে ১৬টি, শিলখালীতে ৮টির মধ্যে ৭টি, টইটংয়ে ৭টির মধ্যে ৫টি এবং রাজাখালীতে ১৯টির মধ্যে ৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।

এই পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট যে, যেসব ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ও প্যানেল চেয়ারম্যান সক্রিয়, সেখানে গ্রাম আদালত তুলনামূলকভাবে কার্যকর। অন্যদিকে, বাকিগুলোর অবস্থা নাজুক। প্রশাসনিক স্থবিরতা, রাজনৈতিক বিভাজন ও আইনি জটিলতার কারণে কার্যক্রম সচল রাখা সম্ভব হয়নি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের একটি বিশেষ রাজনৈতিক ঘটনার পর পেকুয়ার ৫টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পলাতক বা অনুপস্থিত হয়ে পড়েন। ফলে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রেই প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হয়নি।

বিশেষ করে মগনামা, উজানটিয়া ও রাজাখালী ইউনিয়নে উপজেলা সহকারী কমিশনারকে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হলেও প্যানেল গঠনের অনুপস্থিতিতে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। টইটং ও শিলখালী ইউনিয়নে একই অবস্থা বিদ্যমান।

কর্মশালায় বক্তারা বলেন, “যেসব ইউনিয়নে ইউপি চেয়ারম্যানরা মামলার আসামী হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন, সেসব ইউনিয়নে প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচন না হওয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যত অচল। এতে সাধারণ জনগণ আইনি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”

কর্মশালায় একমত হয়ে প্রস্তাব করা হয় যে, সক্রিয় ইউপি সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচন করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট সুপারিশ আকারে পাঠাতে হবে। এতে অন্তত প্রশাসনিক ও বিচারিক কার্যক্রমে গতিশীলতা ফিরে আসবে।

এছাড়া প্রস্তাব এসেছে, গ্রাম আদালত বিষয়ে সাধারণ জনগণকে অবহিত করতে ব্যাপক প্রচার চালানো, ইউপি সদস্য ও চেয়ারম্যানদের বিচারিক এখতিয়ার বৃদ্ধি করা, ইউপি প্রতিনিধিদের সম্মানী ভাতা বাড়ানো, ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমিয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ রাখা।

বক্তারা মনে করেন, গ্রাম আদালত মূলত প্রচলিত আদালতের একটি সহায়ক ব্যবস্থা। এটি অল্প খরচে, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল, আইনি সহায়তা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এই ব্যবস্থাটি অনেক জায়গাতেই অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পেকুয়ার অবস্থা সেই বাস্তবতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।