এইচ এম আবু ছিদ্দিক

স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার পালানোর পর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কেমন ছিল, কমবেশি সবাই জানে। সে সময় সর্বোচ্চ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতা গ্রহণের পর শক্ত হাতে লুটপাট হওয়া দেশের হাল ধরেন। ব্যাংকে টাকা নেই, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রায় বন্ধ, ভারতের আধিপত্য, মিয়ানমারের চাতুরী—সবদিক থেকেই যেন ভঙ্গুর দেশ।

হাসিনা পালালেও ভারত সরকার ও পতিত সরকারের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। মোদি সরকার ও ভারতের মিডিয়াগুলো কোমরে কাপড় বেঁধে বিশ্ববাসীর কাছে অপপ্রচারে নেমেছিল। তারা প্রচার করার চেষ্টা করেছিল, বাংলাদেশের ছাত্রজনতা যেন নির্বাচিত হাসিনা সরকারকে অবৈধভাবে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে। নোবেলজয়ী ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকায় ভারতের মোদি সরকার তেমন পাত্তাই পায়নি।

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে যে কয়েকটি নির্বাচন হয়েছিল, সেগুলো একেবারেই প্রহসনের নির্বাচন ছিল। জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্টেও তা প্রতীয়মান হয়েছে।

ইউনূস সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর ছাড়া সব রাজনৈতিক দলই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্র সংস্কারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিল। ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছিলেন, তিনি ক্ষমতায় থাকতে আসেননি। সংস্কার শেষে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অর্পিত দায়িত্ব শেষ করবেন। তিনি আরও বলেছিলেন, আধাআধি সংস্কার করলে ডিসেম্বর ২০২৫ এবং পুরোপুরি সংস্কার করলে জুন ২০২৬ সালের মধ্যে নির্বাচন হবে।

কিন্তু পুরোপুরি সংস্কার কাজ শেষ হতে না হতেই প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির শীর্ষ নেতারা ডঃ মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য শুরু করলেন। একেক নেতার একেক বক্তব্য— কেউ বললেন, নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া অনির্বাচিত সরকার সংস্কার করতে পারে না। আবার কেউ বললেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে নির্বাচনে অংশ নেবেন না। কেউ আবার বললেন, ডঃ মুহাম্মদ ইউনূস স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার মতোই আচরণ করছেন। সবচেয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যটি হলো— “প্রকৃতি ছেড়ে দিলে সবাই ভেসে যাবে।”

বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। তারা মনে করছে, নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যাবে। ক্ষমতায় যেতে পারলে তো লাভই লাভ।

২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির মহাসচিব বললেন, শুধু বিএনপি নয়, পুরো জাতিকে হতাশ করা হয়েছে। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো ডিসেম্বরের কথা বলেছিল, কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা সেগুলো আমলে না নিয়ে অনুপযোগী বর্ষা ও পরীক্ষার সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। সার্বিক বিবেচনায় জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হলে সেটিই গ্রহণযোগ্য হতো।

তবে ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারিতে আসাটাও বিএনপির কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা বলে মনে হয়। এখন প্রশ্ন হলো, প্রধান উপদেষ্টা কত সময়ের মধ্যে প্রায় দুই হাজার শহিদের আত্মার শান্তি এবং বিশ হাজারের বেশি আহত যোদ্ধাদের প্রত্যাশা পূরণ এবং জনগণের চাওয়া-পাওয়া শেষ করে নির্বাচন দিতে পারবেন, সেটি সরকারের কাজের অগ্রগতির ওপর নির্ভর করবে। তবে ইউনূস সরকার এপ্রিলের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন—এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এখন মাত্র ২ মাস নিয়ে বাড়াবাড়ি করে দেশের ক্ষতি করা কারও কাম্য নয়। বিএনপির মঙ্গল হবে, আধিপত্যবাদ পরিহার করে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সহযোগিতা করা। একমাত্র শহীদ জিয়াউর রহমানের শাসন আমল ছাড়া বিএনপির আমলনামা অত্যন্ত দুর্বল।

এনসিপি
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নির্বাচনের দিনক্ষণের ঘোষণা নিয়ে প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। তবে তার আগে জুলাই সনদ, দৃশ্যমান বিচার এবং সংস্কার সম্পন্ন করতে হবে।

জামায়াতে ইসলামি
দলটির আমির ডঃ শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের দিন ঘোষণায় সন্তোষ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে এবং ঘোষিত সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জাতি আশা করে।

ইসলামী আন্দোলন
দলটির বাংলাদেশের আমির মুফতি ছৈয়দ রেজাউল করিম (পীর সাহেব চরমোনাই) এক বিবৃতিতে বলেছেন, নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতা প্রশমিত হয়েছে।

হেফাজতে ইসলাম
দলটির নায়েবে আমির মহিউদ্দিন রাব্বানী এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে দিন ঘোষণা করেছেন, তা সঠিক নাকি ভুল—এই বিবেচনা দেশবাসী করবেন। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আমরা মনে করি, এপ্রিল থেকে দুই-এক মাস আগেও নির্বাচন হতে পারে। তবে সেটি প্রধান উপদেষ্টার বিবেচনার ওপর ছেড়ে দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বিশ্বাস প্রধান উপদেষ্টা কোনো চাপের কারণে এই তারিখ ঘোষণা করেননি। তিনি কেবল অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন।

গণসংহতি আন্দোলন
প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচনের দিন ঘোষণায় স্বাগত জানিয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তবে নির্বাচনের সময়টা তিনি সমর্থন করেননি। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উপযুক্ত সময় নির্ধারণের আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন করা যায় কি না—তা ভেবে দেখা যেতে পারে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মত
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ডঃ আবদুল আলিম বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময় যৌক্তিক। সব রাজনৈতিক দলগুলোর এটি মেনে নেওয়া উচিত। এখনো নির্বাচন কমিশনের অনেক কাজ বাকি। ভোটার তালিকা হালনাগাদ, পর্যবেক্ষক বিধিমালা ও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের কাজ আছে। এই নয় মাস সময় নির্বাচন কমিশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা জনগণের ভিন্নমত থাকতে পারে—এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেভাবে মানুষ কথা বলতে পারছে এবং রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে পারছে, অতীতে কোনো সরকারের আমলে তা সম্ভব হয়নি।

যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে জবাবদিহিতামূলক সরকার প্রতিষ্ঠা করা গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ। তবে শুধু একটি সুষ্ঠু নির্বাচন গণতন্ত্রের নিশ্চয়তা দেয় না। এর পাশাপাশি সাম্যবাদী শাসন, স্বাধীন বিচার বিভাগ ও বিচারকদের নিরপেক্ষতা, বিরোধী মতের যৌক্তিক প্রস্তাব মেনে নেওয়া, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বচ্ছতা, সর্বোপরি মন্ত্রী-এমপি ও ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতা—এবং অন্যান্য মৌলিক বিষয়সমূহ গণতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

যে দেশে ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি বিরোধী মতকে দমন-পীড়ন চালিয়ে প্রতিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করার চেষ্টা করে, সেই দেশে কাগজে-কলমে গণতন্ত্র থাকলেও সর্বসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত হয়।

সংসদে বা সংসদের বাইরে, মাঠে-ময়দানে শক্ত বিরোধী দল থাকলে সরকারে থাকা দলের সুবিধা হওয়া উচিত, অসুবিধা নয়। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সব পরিকল্পনা সঠিক হবে—বা সবাই ধোয়া তুলসীপাতা—এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। তাদের ভুলত্রুটি শোধরানোর জন্য শক্ত বিরোধীমত ছাড়াও গুণী সমাজ এবং স্বাধীন গণমাধ্যম অপরিহার্য। অন্যথায় সুবিধাবাদীরা সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটসহ জাতির অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করবে।


লেখক: কলামিস্ট, সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, দৈনিক কক্সবাজার বানী।