ইমাম খাইর, সিবিএন:
কক্সবাজারের সদরের চৌফলদন্ডিতে প্রস্তাবিত “বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা ইনস্টিটিউট” এর নাম পরিবর্তন, লবণের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত, লবণ বোর্ড গঠনসহ ১২ দফা দাবি দিয়েছে লবণ চাষী কল্যাণ সমিতি।
বুধবার (২ অক্টোবর) দুপুরে শহরের একটি আবাসিক হোটেলের কনফারেন্স হলে সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবিসমূহ উত্থাপন করেছেন সমিতির সভাপতি এডভোকেট মো. শাহাব উদ্দীন।
১২ দফা দাবিসমূহ:
১. লবণ চাষীদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি ও আগামীতে আরো বেশী লবণ উৎপাদন করার উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্য অতি দ্রুত কমপক্ষে ৩ লক্ষ মেঃ টন লবণ রপ্তানীর ব্যবস্থা করা
২. লবণের উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক মোটরের ব্যবহার সহজলভ্য করা, জমির লীজমানি কমানো এবং প্রকৃত প্রান্তিক লবণ চাষীকে সরকারের খাস জমি বরাদ্দ প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণ
৩. অসুস্থ ও দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় মাঠ পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত লবণ চাষীদের সরকার কর্তৃক চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা
৪. বর্ষা মৌসুমে প্রান্তিক লবণ চাষীদের ১০ টাকা কেজি মূল্যে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাউল বরাদ্দ
প্রদানের ব্যবস্থা
৫. বিসিকের মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতিতে লবণ চাষে প্রকৃত লবণ চাষীদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ
৬. দেশে লবণের খাতভিত্তিক চাহিদা নিরুপণের জন্য পুর্ণাঙ্গ জরিপ করে জাতীয় লবণ নীতি- ২০২২ এর সংশোধন
৭. জরীপের মাধ্যমে লবণ জমির পরিমাণ চিহ্নিত করাসহ লবণ চাষীদের পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরি করে প্রত্যেককে আইডি কার্ড প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ
৮. অল্প জমিতে অধিকতর, পরিপক্ক, দানাদার ও গুনগত মানসম্পন্ন লবণ উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে লবণ গবেষণা ইউনিষ্টিটিউট ও লবণ চাষী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন
৯. লবণ চাষীদের নামে মাত্র নয়, বাস্তবিকভাবেই সহজ শর্তে ব্যাংক বা অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রান্তিক লবণ চাষিদের স্বল্পমূল্যে লবণ উৎপাদনের উপকরণ (পলিথিন ও জ্বালানী) সরবরাহ
১০. জাতীয় লবণ চীয় লবণ নীতি অনুযায়ী সরকারিভাবে ১ লক্ষ মেঃ টন লবণের “বাফার স্টক” গড়ে তোলার ব্যবস্থা গ্রহণ
১১. নামে মাত্র লবণ উপদেষ্টা বোর্ড নয়, লবণ শিল্পের নিবিড় তদারকির জন্য পৃথক লবণ বোর্ড গঠন
১২. কক্সবাজারের সদরের চৌফলদন্ডিতে প্রস্তাবিত “বঙ্গবন্ধু লবণ গবেষণা ইনস্টিটিউট” এর নাম পরিবর্তন করে লবণ “বাংলাদেশ লবণ গবেষণা ইনস্টিটিউট” নামকরণ
আসন্ন ২০২৪-২৫ লবণ মৌসুমে লবণ চাষীদের লবণ উৎপাদনের জন্য মাঠে নামানোর লক্ষ্যে মজুদ লবণ রপ্তানী করাসহ ১২ দফা দাবিতে লবণ চাষী কল্যাণ সমিতির সংবাদ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম হাসান, সহ-সভাপতি এ জেড এম গিয়াস উদ্দিন, ডা. মোহাম্মদ সোহেল, অর্থ সম্পাদক একরাম উদ্দিন নূরী, চকরিয়া উপজেলা সভাপতি মো. হাবিবুল মতিন, টেকনাফ উপজেলা সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বাবলু, জেলা কমিটির সদস্য নিজাম উদ্দিন নুরী (উজ্জ্বল), ধলঘাটা ইউনিয়ন সভাপতি ডা. নুরুল ইসলাম (মনি), মহেশখালী সভাপতি মোঃ জাফর আলম জফুর, হোয়ানক ইউনিয়ন সভাপতি আরিফ উল্লাহ সিকদার, বদরখালী ইউনিয়ন সভাপতি এখলাছুর রহমান, সমিতির নেতা আবুল কাশেম, নুরুল হোসাইন, মো. শরীফসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
দেশীয় লবণ শিল্প বাঁচাতে ১২ দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে সভাপতি এডভোকেট মো. শাহাব উদ্দীন বলেন, লবণ একটি বিকল্পবিহীন নিত্য ব্যবহার্য্য ভোগ্য পণ্য এবং লবণ শিল্প দেশের সর্ববৃহৎ শ্রম নিবিড় শিল্প। বাংলাদেশে শুধুমাত্র কক্সবাজার জেলায় ৯০% ও ১০% চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার মোট ৯০০ বর্গ কিঃমিঃ উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদন হয়। যা দিয়ে দেশের লবণের চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে। লবণ উৎপাদন হতে ভোক্তার হাত পর্যন্ত প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ এ শিল্পের সাথে জড়িত। জিডিপিতে প্রায় ১০% অবদান রাখছে লবণ শিল্প।
কক্সবাজার জেলা এবং বাঁশখালীতে প্রায় ৫০ হাজার লবণ চাষীসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অত্র এলাকার প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ লবণ উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল। এই অঞ্চলের আর্থ- সামাজিক মর্যদা নির্ভর করে লবণ চাষের উপর।
তিনি বলেন, ২০১১ সালে জাতীয় লবণ নীতি প্রণয়ন করা হয়। সে সময় সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে দেশে লবণের যে চাহিদা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা যুক্তি-যুক্ত। তারপর আমরা দেখলাম ২০১৬ হতে ২০২০ পর্যন্ত সময়ে দেশে পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন হওয়ার পরও মিথ্যা তথ্য দিয়ে নানা অজুহাতে ঘাটতি দেখিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী/আমদানীকারক ভারত থেকে লবণ আমদানী করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে দেশীয় স্বনির্ভর লবণ শিল্পকে ধ্বংস করে ভারতীদের তাবেদার বানানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল। আমরা নানাভাবে প্রতিবাদ করে যাচ্ছিলাম। বিগত সরকার লবণ আমদানীতে বিধি নিষেধ আরোপ করার ফলে অসাধু লবণ আমদানীকারক ও ব্যবসায়ীর প্ররোচনায় বা মিথ্যা তথ্যের আলোকে বিগত সরকার ২০২২ সালে জাতীয় লবণ নীতি প্রণয়ন করার সময় দেশে লবণের চাহিদা অতিরিক্ত দেখানো হয় ২৫.২৮ লক্ষ মেঃ টন। বিভিন্ন হিসাব মতে ২২ লক্ষ মেঃ টনের বেশী হওয়ার কথা নয়।
একটি দৃষ্টান্ত টেনে লবণ চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি বলেন, জাতীয় লবণ নীতি ২০১১ বা ২০১৬ এর আলোকে ২০২২ সালের শুধুমাত্র শিল্পখাতে লবণের চাহিদা হয় ৪.৬০ লক্ষ মেঃ টন। কিন্তু জাতীয় লবণ নীতি ২০২২ অনুযায়ী তা হল ৬.৯২ লক্ষ মেঃ টন।
উল্লেখ্য যে, ২০১১ সালের নীতিতে ৫% বৃদ্ধি ধরা হলেও ২০২২ সালের লবণ নীতিতে ১৫% বৃদ্ধি ধরা হয়েছে যা অসম্ভব। অর্থাৎ ২০২৪ সালের শিল্প খাতে চাহিদা ১০.২০ লক্ষ মেঃ টন (প্রসেস লসসহ) এবং ২০২৫ সালে তা বৃদ্ধি হয় ১১.৮২ লক্ষ মেঃ টন। বাস্তবতা হল এই খাতে চাহিদা কোনক্রমেই ৭.০০ লক্ষ মেঃ টন এর বেশী নয়।
বিসিকের হিসাব অনুযায়ী সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে অর্থাৎ ৬৩ বছরের মধ্যে ২০২৩-২৪ লবণ মৌসুমে আমরা লবণ চাষীরা সর্বোচ্চ ২৪.৩৮ লক্ষ মেঃ টন লবণ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু চাহিদা অতিরিক্ত থাকায় তা স্পর্শ করতে পারিনি। উৎপাদন চাহিদা ২৫.২৮ লক্ষ মেঃ টন হতে ০.৯০ লক্ষ (৯০ হাজার) মেঃ টন কম। আমরা চাহিদার যে হিসাব তা সঠিক নয় বলে মনে করেন লবণ চাষী কল্যাণ সমিতির নেতৃবৃন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নির্ধারিত চাহিদা অনুযায়ী চলতি বছরের নয় মাসে ১৯ লক্ষ মেঃ টন লবণ ব্যবহার হওয়ার কথা। সে আলোকে ৫ লক্ষ মেঃ টন লবণ মজুদ থাকার কথা নয়। কারণ গত বছরের কোন লবণ মজুদ ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা হল ২৩ সেপ্টেম্বর’ ২৪ তারিখে বিসিকের হিসাব অনুযায়ী লবণ মাঠে ৭.৭৮ লক্ষ মেঃ টন এবং মিল পর্যায়ে ২.৩৬ লক্ষ মেঃ টন মোট ১০.১৪ লক্ষ মেঃ টন লবণ মজুদ আছে। বাস্তবতায় তা আরো বেশী। মাঠ পর্যায়ে লবণ বেচা-কেনাও অনেক কম, দামও গত বছরের চেয়ে মণপ্রতি প্রায় ২০০/- টাকারও কম। এই বিক্রয় মূল্যে উৎপাদন খরচ তোলাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে লবণ চাষীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তাদের দীর্ঘ দিনের দাবী ছিল, একটি লবণ বোর্ড গঠন করার। কিন্তু সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুলা ঝুলানোর মত লবণ উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করেছেন, যা দিয়ে লবণ শিল্পের কোন কাজই হয়নি।
লবণ চাষীদের জীবন-মান উন্নয়নে ১২ দফা দাবি বাস্তবায়নে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন নেতৃবৃন্দ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।